Friday, December 6, 2013

বিরিয়ানি, মুক্তো এবং পুজোর হায়দ্রাদাদে..


রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো
এবার  কোলকাতার ভীড়ভাট্টা ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পুজো কাটাতে  চাইল মন । 
দিন কয়েকের মত শিকেয় তোলা র‌ইল মহানাগরিক কোলাহল । কিন্তু তেলেঙ্গানা পৃথকীকরণের জের আর ধেয়ে আসা ঘূর্ণাবর্তের আশঙ্কায় আহ্লাদে আটখানা হতে পারলাম না ।   একটু মনখারাপও হোল তবুও  ভালো লাগল ছুটির আনন্দে ।  ছুটি যেমনই হোক  আর পুজোর ছুটি  সব ছুটির থেকে অন্যরকমের । তবে খুব মিস করছিলাম  ঢাকের শব্দ ।  এবছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে অকাল শ্রাবণের চোখরাঙানি এ শহরকেও তাড়া করে চলেছে । বৃষ্টি শরতের মুখে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে ।  মনখারাপের বাঁধ ভেঙে কবিতায় পেয়ে বসল আমায় ।


দুর্গা তোমার দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি কেন বলো ?
দুর্গা তোমার দৃষ্টি সুদূরে আঁধারে কিম্বা আলো ।
দুর্গা তোমার ঘামতেল আজ বিষণ্ণতার ছোঁয়া
ধুলোমুঠি শাড়ি মলিন আঁচল তবুও শিউলি ধোয়া ।
...

ছোটবেলায় ষষ্ঠীর ভোরে  মা'কে দেখতাম স্নান সেরে এসে প্রত্যেক দরজার মাথায় তেল-হলুদ-সিঁদুরের ফোঁটা দিতে । মা দুর্গাষষ্ঠীর ব্রতকথা পড়ে হাতে প্রসাদ দিতেন ।  সুদূরে বসে সেই স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই । সেই শুভসূচনার সাথে সাথে মায়ের আগমনের শুরু হয়ে যেত  । হোটেলের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাদের স্কুল যাওয়ার তাড়া । অফিসকাছারি যাবার কর্মব্যস্ততা ।  কোলকাতার সাথে কোনো তুলনা নেই এ শহরের পুজোর । হোটেলের ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে গিয়ে নিরামিষ ফলাহার সেরে নিলাম ষষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে ।
হোটেলের টেলিভিশনে ডিটিএইচ পরিষেবার মাধ্যমে আকাশবাণী কলকাতা পেয়ে দিব্যি খুশি হলাম । একে একে পুরোণোদিনের গান আর কলকাতার পুজোর আপডেট পেতে থাকলাম । প্যান্ডেল হপিং না করেই সেলেবদের খুচরো গসিপ আর বাংলা গান এর চেয়ে ভালো ছুটি কাটানো কিসে হতে পারে ? মাঝেমধ্যে ডিডিবাংলায় পুজো পরিক্রমা দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটালাম । আমার মনের ছুটির ঘন্টা আর ঢাকের বাদ্যি ততক্ষণে কোলকাতাকে এনে দিয়েছে চোখের সামনে । মায়ের আমন্ত্রণ, অধিবাস, বোধন চলছে ।
 সপ্তমীর শারদপ্রাতের সূচনায়  মনখারাপের মেঘ জমেছে । কলাবৌ স্নানের কোনো লক্ষণ নেই এ শহরে । হয়ত বা হচ্ছে তার প্রস্তুতি দূরে কোথাও , বহু দূরে । মনে পড়তে লাগল ঢাক, শাঁখের আওয়াজ.. ন'টি উদ্ভিদ চারা দিয়ে তৈরী কলা-বৌকে স্নান করিয়ে,  লাল পাড় সাদা শাড়ী পরিয়ে   মা দুর্গারূপে পুজো করা ।  
 গোলকুন্ডা ফোর্ট


   
                                                হুসেন সাগরের বুদ্ধমূর্তি
আমারা  ছিলাম   হায়দ্রাবাদের হাইটেক সিটির কাছে কোন্ডাপুরে । সেখান থেকে সপ্তমীর দিন গেলাম হুসেন সাগর নামে এক বিশাল লেকে । কি পরিচ্ছন্ন! হুসেনসাগর হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ এই দুই যমজ শহরকে পৃথক করে রেখেছে । 
 আর সেখানে ঐ বিশাল জলাশয়ের মধ্যে একটি অভিনব বুদ্ধমূর্তি দেখতে যাওয়া হল লঞ্চে করে । তারপর গোলকুন্ডা ফোর্ট ও চারমিনার ।
হায়দ্রাবাদের কোন্ডাপুর থেকে কোঠ্ঠা গুদাম জংশন পেরিয়ে গাচ্ছিবৌলি, নেহেরু আউটার রিং রোড দিয়ে ছুটে চললাম আমরা দুর্গ শহর গোলকুন্ডার দিকে ।   ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাকাতীয় রাজবংশের হাতে তৈরী এই অভিনব দুর্গ ভারতের অন্যতম স্থাপত্য । কুতুবশাহী রাজাদের হাতে ক্রমাগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এই দুর্গের । সাত কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পুরো গোলকুন্ডা ফোর্টটি । এখানেই একদিন ছিল সেই ঐতিহাসিক কোহিনূর হীরে । পুরোটা ঘুরে দেখতে গেলে পুরোটা দিন লেগে যাবে । 

                                                            চারমিনার
 সপ্তমীর দিন আমাদের বাড়িতে খুব রান্নাবান্না হত ।   বিশেষ আমিষ পদ.. মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সেই  স্মৃতি নিয়ে পৌঁছে গেলাম   হায়দ্রাবাদের সবচেয়ে পুরোণো রেস্তোঁরা প্যারাডাইসে । বিরিয়ানি   রায়তা ও কাবাব দিয়ে সপ্তমীর ভোজ সারা হল ।

সন্ধ্যের ঝুলে ডোমালগুডায় রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজো দেখতে গেলাম । সন্ধ্যারতির পর পোহা প্রসাদ পেলাম ।

                                      হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের দুর্গাপুজো
 এবার পাশেই ইন্দিরা পার্কের উল্টোদিকে  হায়দ্রাবাদ বাঙালী এস্যোসিয়েশানের ৭২বছরের পুরোণো পুজো দেখতে গেলাম ।  ওখানকার পুজোতে গিয়ে পুরোণো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা একটা বিরাট প্রাপ্তি ।   বাঙালী যেখানেই থাকুক ঠিক চেষ্টা করে যায় তার সাহিত্য-কলা-কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে ।বিরিয়ানি আর মুক্তার শহর  হায়দ্রাবাদও তার ব্যাতিক্রম নয় ।  সেখানেও এক আকাশের নীচে সব বাঙালী মানুষ  গান, নাচ, নাটকের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোকে পালন করছে । তবে এদের কোনো পুজোতেই কোলকাতার মত অনিয়ন্ত্রিত ভীড় নেই বা অহেতুক সেলিব্রিটি প্রদর্শনের হিড়িক নেই । আর নেই থিম পুজোর জাঁকজমক ।  কোলকাতার এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন। শুধু বেঁচে র‌ইল স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মহাষ্টমীতে সেরা পোষাকটি পরে অঞ্জলি দেওয়া । সারা বছরের মত মায়ের কাছে বাঙালীর যত কিছু চাওয়া  । "রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি"... ইত্যাদি আরো কত কিছু ।

মহাষ্টমীর ভোরে স্নান সেরে নিয়ে  হায়দ্রাবাদেও নতুন শাড়ি । তারপর আবার রামকৃষ্ণ সারদা মঠের দুর্গাপুজোয় সামিল হলাম ।ঠিক বেলুড়মঠের মত একচালার হলুদ মূর্তি মা সহ তাঁর পরিবারের । মূল মন্দিরে  ঠাকুর রামকৃষ্ণ  টুকটুকে লাল দক্ষিণি পট্টবস্ত্রে, মা সারদা টুকটুকে লাল জরিপাড় মাহেশ্বরী শাড়িতে ও স্বামী বিবেকানন্দ গেরুয়া রঙের কাঞ্জিভরম ধুতিতে ।    চন্ডীপাঠের সকাল । মন্ত্রমুগ্ধ আবহ । স্তোত্রপাঠের পর  আরতি, পুষ্পাঞ্জলি ।  সবকিছুই বেলুড়মঠের রীতি অনুসারে । কিন্তু ভীড় কম বলে আরো যেন কাছে পাওয়া সেই দুর্গাপুজোকে । কোলকাতার পুজোতে যেন অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি বড্ড বেশি কৃত্রিম মনে হয় আজকাল । এরপর হোমযজ্ঞ । তারপর প্রসাদ বিতরণ । অভিনব ভোগপ্রসাদ । মাঠের ওপর পেতলের বিশাল হাঁড়িতে ঘিভাত বসেছে কাঠের জালে । আর সেই ঘিভাতের সাথে তেলুগু সবজী, চাটনী, পাঁপড়  ও মিষ্টি ডালপুরী । পরিতৃপ্তিতে ভরপুর মন ।  হোটেলে ফিরে এসে ডিডিবাংলায় সরাসরি বেলুড়মঠের সন্ধিপুজো দেখতে পেয়ে গেলাম ।
মনখারাপ হল তীব্র গতিতে ছুটে আসা ঘূর্ণিঝড়  পিলিন এর কথা শুনে । অন্ধ্র ও উড়িষ্যার উপকূলে ধেয়ে আসছে সেই ঘূর্ণাবর্ত । সে রাতে  অজানা আশঙ্কায় ঘুম এলনা দুচোখে ।
 বৃষ্টি কোলকাতাকে পুজোতে মুক্তি দেয়নি  কিন্তু শরতের আকাশের অনেকটা নীল দাক্ষিণাত্য মালভূমির এই শহরে  ধরা দিল । পিলিন অষ্টমীর রাতে ঊড়িষ্যার উপকূলে আছাড়ে পড়েছে এর‌ই মধ্যে । ততক্ষণে পিলিন শান্ত হয়েছে   অন্ধ্রে  । তবে ঊড়িষ্যায় বিপুল ক্ষতি করেছে । 

                                       সালার জাং মিউজিয়ামের বিখ্যাত ভেলড রেবেকা
 নবমীর সকালে এ শহরের আরো এক মুখ্য আকর্ষণ সালার-জাং মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে থকে যাওয়া আর নবমীনিশিতে আবার মন উচাটন কোলকাতার ধুনুচিনাচের জন্য । আর সেই সোনার প্রতিমা ভাসানের সুর যেন বেজে উঠল কানে কানে ।

 মনে মনে গেয়ে উঠলাম " নবমীনিশি রে তোর দয়া নাই! এত করে সাধিলাম ..."

নবমীর দুপুরে মাংস খাওয়ার রেওয়াজ সব বাঙালী বাড়িতে । কাবাব-বিরিয়ানি-তন্দুরীর শহরে তার জন্য হাপিত্যেশ নেই । অলিগলিতে মুখরোচক দোকান । ঐদিন এ শহরে নবরাত্রির সাজগোজ যেন একটু বেশিমাত্রায় নজরে এল । 
দশমীর দুপুর থেকে বাড়িতে শুরু হয়ে যেত নিমকী-নাড়ু আর ঘুগনীর তোড়জোড় । কত মানুষ আসবে বাড়িতে । কিন্তু এখন কোলকাতায় সেই রেওয়াজ যেন অনেকটাই স্তিমিত । দল বেঁধে যাওয়া হত বিজয়া করতে । প্রবাসে বসে আরো যেন এইগুলো পেয়ে বসে আমাকে । মনে হয় আমি যেন দলছুট এক কোলকাতাইয়া । তবে হাইটেক সিটি ছেড়ে যেতে যেতে কেবল মনে হতে লাগল আমার শহরের কথা । হায়দ্রাবাদ কোলকাতা দুই পুরোণো শহর । কিন্তু এ শহরে শুধু শিল্পের জোয়ার । শেষদিন খেতে গেছিলাম এক রেস্তোঁরায় । সেখানে বাঁকুড়ার এক বাঙালী যুবক হোটেলে কাজ করে । সে বলল তার দুঃখের কথা । দেশ ছেড়ে পুজোর সময় তার মোটেও ভালো লাগছেনা কিন্তু বাঁকুড়ায় পড়ে থাকলে তার সংসার চলবেনা  তাই কাজের জন্য দলে দলে ছেলেরা বাঁকুড়া ছেড়ে হায়দ্রাবাদে পাড়ি দিয়েছে .. সে জানাল ।   আবারো মনটা ভারি হয়ে গেল তার কথাগুলো শুনে ।
দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকুক কোলকাতার বাঙালী । যদি মাদুর্গা ভবিষ্যতে প্রসন্না হন তবে আমাদের এই শহরেও শিল্পের জোয়ার আসবে ।  সেই সুপ্ত বাসনা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে ।  
আমাদের পরবর্তী  পিটষ্টপ ভাইজ্যাগ্-আরাকু ভ্যালিতে ।  ইষ্টকোষ্টের ধার ঘেঁষে  গোদাবরী এক্সপ্রেস ছুটে চলল । 

Monday, August 5, 2013

খোদিত পাষাণে, বুদ্ধের শরণে...



সে অনেক যুগ আগের কথা ।  মৌর্য সম্রাট অশোক  বুদ্ধ বিগলিত অন্তরে কেঁদে বললেন,  "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি,   ধর্মং শরণং গচ্ছামি" । প্রচুর প্রভাবপ্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে উড়িষ্যার ধৌলী পাহাড়ের গায়ে , দয়ানদীর তীরে হাজার হাজার মানুষের রক্তপাত ঘটতে দেখে সাম্রাজ্যবাদের উচ্চাশা ত্যাগ করে  শেষমেশ তিনি   বেছে নিলেন অহিংস রাজনীতির পথ । কলিঙ্গযুদ্ধের  এই ভয়াবহ পরিণতি তাঁকে   সম্পূর্ণ রূপান্তরিত করল অন্য সত্তায়; সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের মধ্যে তিনি শুধুমাত্র বেছে নিলেন সত্ত্বগুণকে । শরণ নিলেন গৌতমবুদ্ধের্, আশ্রয় নিলেন ধর্মের । সম্রাট অশোকের "চন্ডাশোক" থেকে "ধর্মাশোকে" উত্তরণ ঘটল ।


অশোক যখন উজ্জয়িনীর ভাইসরয় ছিলেন তখন বিদিশার সওদাগরের কন্যা বেদিশা মহাদেবী বা দেবীকে বিবাহ করেন । কলিঙ্গ যুদ্ধের মৃত্যুমিছিলের শোকে  ব্যাথিত, ক্লিষ্ট, অনুতপ্ত রাজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার এই স্ত্রী দেবী । তার দুখের ঘায়ে প্রলেপ দিয়ে মনের জালা জুড়িয়েছিলেন  এই দেবী। বৌদ্ধধর্মের আদর্শে তাঁকে অণুপ্রাণিত করেছিলেন । বিদিশা মধ্যপ্রদেশের একটি শহর। যার দশ কিমি দূরে অশোক স্থাপন করলেন অধুনা  বিশ্ব-হেরিটেজ মর্যাদা সম্পন্ন বৌদ্ধমন্দির যা সাঁচী স্তূপ নামে খ্যাত । সিন্ধুসভ্যতার সবচেয়ে সংরক্ষিত নিদর্শন এই সাঁচীস্তূপ । মধ্যপ্রদেশের  রাইসেন জেলায়, ভোপালের ৪৬ কিমি দূরে, বেতোয়া নদীর ধারে এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনুমেন্টটি এখনো রাজকীয়তায় পরিপূর্ণ ।  বৌদ্ধ স্থাপত্যের সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য অর্থাত স্তূপ, মন্দির, স্তম্ভ, বিহার এবং চৈত্য সবকিছুই নিঁখুত ভাবে রয়েছে এখানে ।   



কয়েক একর জায়গা জুড়ে সাঁচী স্তূপ, মন্দির চৈত্য এবং স্তম্ভগুলি । সারাদিন লেগে যাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে ।  কিন্তু সবগুলি স্থাপত্য সম্রাট অশোকের আমলে তৈরী হয়নি ।  বহুবছর ধরে গড়ে উঠেছিল সাঁচী । অশোক সাঁচীর মৃত্তিকায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন শান্তির টুকরো টুকরো কণা। সাঁচীর বাতাসে অনুভব করেছিলেন অহিংসার গন্ধ । উপাসনার আদর্শ স্থান, আরাধনায় দিব্যদৃষ্টি  হয়ত পেয়েছিলেন অশোক । কিম্বা নিছক শান্তির পরিমন্ডল তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল কলিঙ্গযুদ্ধের রক্তপাত ।


বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও পতনের সাথে সাথে সাঁচীস্তুপের অনেক সংযোজন, সংস্করণ এবং পরিবর্তন হয়েছে । অশোকের মৃত্যুর পর শুঙ্গবংশের রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রায্যের শত্রু পুষ্যমিত্র শুঙ্গের দ্বারা অনেক ক্ষতিসাধন হয়েছিল সাঁচীর আদি স্তুপের । পরে তার পুত্র অগ্নিমিত্রের আমলে এই সাঁচীস্তুপের বিবিধ উন্নতিসাধন হয় । অগ্নিমিত্র নিজে বৌদ্ধধর্মের অনুরক্ত ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছিল ।  তিনি যেমন একাধারে এই স্তুপের  রক্ষণাবেক্ষণ করেন তেমনি ছোট বড় অনেক তোরণ এবং স্তূপ তৈরীও করেছিলেন ।  শুঙ্গবংশের পর সাতবাহনদের আমলে সাতবাহন রাজাদের চাঞ্চল্যকর স্থাপত্য কীর্তি সাঁচী স্তুপকে বিশেষ মাত্রা দেয় ।    স্তম্ভগুলিতে খোদাই করা ব্রাহ্মিলিপি থেকে অনেক কিছু জানা গেছে । সাঁচী শব্দটির উত্পত্তি সংস্কৃত এবং পালি শব্দ সাঁচ থেকে যার অর্থ হল to measure  বা মাপা। হিন্দীতে সাঁচীর অর্থ হল  Moulds of stones
প্রধান স্তূপটি যেটি অশোক তৈরী করেছিলেন সেটি বিশাল এবং রাজকীয় । অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই বিশাল সাঁচীস্তূপটির ওপরে একটি  তিন প্রস্থ ছাতা যাকে বলে ছত্তাবলী রয়েছে  যা এক চতুষ্কোণ রেলিংয়ের  মধ্যে আবদ্ধ । কিছুদূর উঠে একটি বারান্দা বা মেধি যার বাইরে দিয়ে পাথরের বেষ্টনী । পাথর বিছানো মিছিল পথ বা প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে মাটীতে যাকে ঘিরে আবার পাথরের বেষ্টনী ।




প্রধান এই স্তূপের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে চারটি প্রবেশদ্বার বা তোরণ রয়েছে । প্রত্যেকটি তোরণ অসাধারণ সুন্দর পাথরের কারুকাজ করা । ওপরে জাতকের গল্প , গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী এবং স্থপতির নাম ব্রাহ্মি লিপিতে খোদাই করা ।  বুদ্ধের রেলিক্‌স বা দেহাবশেষ (অস্থিভস্ম)রাখা রয়েছে  স্তূপের নীচে । দক্ষিণ তোরণের বাঁদিকে লক্ষ্য করা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি যা পড়ে জানা যায় যে বিদিশার হাতীরদাঁতের কারুশিল্পীর স্থপতিদের দ্বারা তৈরী হয়েছিল এই স্থাপত্য ।  উত্তরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে ধর্মচক্র যা আমাদের ভারতীয় জাতীয় পতাকার মধ্যে নীল রঙে আঁকা থাকে । সেখানে আরো দেখা যায় একটি বানরকে যে ধ্যানস্থ বুদ্ধকে মধু উত্সর্গ করছে । দেখা যায় বুদ্ধভক্ত সুজাতাকে যে পায়েস দান করছে । পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারে পাথরে খোদাই করা গাছ এবং পশুপাখি পরিবেষ্টিত সিংহাসনারূঢ় বুদ্ধকে । পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বারে কুশীনগরে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লক্ষ্য করা যায় ।  স্তম্ভের গায়ে পাথরের খোদাই যে কতটা নিপুণ এবং স্থপতির শিল্পীসত্তা যে কতটা উন্নতমানের তা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না । এইভাবে কোনোটিতে  বুদ্ধের তাঁর শিষ্যদের বাণী প্রচারা, অরেকটিতে অশোকের বোধগয়া যাত্রা , আবার আরেকটিতে দোলাছত্রধারী জনতার মাঝে বুদ্ধের নিরঞ্জনা নদীতে গমন । আবার ছোটবেলায় ইতিহাস ব‌ইতে পড়া বুদ্ধের জন্মের কাহিনী, কপিলাবস্তুতে রাজা শুদ্ধোদনের রাণীর স্বপ্নে শ্বেতহস্তী দর্শন  আর সর্বপরি বুদ্ধের সিদ্ধিলাভের সময় ঐহিক সব প্রলোভনের কাহিনী সব ঐ পিলারগুলির গায়ে বিবৃত হতে দেখে মনে হল এতদিন ধরে যা আমরা পড়ে এসেছি এবং বিশ্বাস করে এসেছি কোনোটিই অসত্য নয়  ।  দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক অশোক স্তম্ভ যা ভারতের জাতীয় প্রতীক । সেই পাথরে নিখুঁত খোদাই করা চারমুখে চারটি সিংহের মুখ ।    আমার ইতিহাস ব‌ইয়ের পাতা আজ জীবন্ত আমার চোখের সামনে । এই অশোক স্তম্ভ এবং অশোকচক্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন গর্বিত মনে হল নিজেকে ।    খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এই স্থাপত্যের চিহ্ন আমরা বহন করে চলেছি এখনো, অক্লেশে, ঐতিহ্যের সাথে, সম্মানের সঙ্গে ।
আমরা  ভোপাল থেকে সাঁচী পৌঁছলাম ঘন্টা দুয়েক পরে । পথে পেরোলাম কর্কটক্রান্তি রেখা । আমাদের যাত্রাপথকে তেরছা ভাবে কেটেছে সেই পথে । কেমন অভাবনীয় ভাবে এসে পড়লাম ঐ রেখার ওপর । এতদিন যার অস্তিত্ব ছিল ভূগোল ব‌ইয়ের পাতায়, মানচিত্রে  সেই ট্রপিক অফ ক্যানসারের ভারতীয় অংশ আমার পায়ের তলায় । ভারতের মাটি চিরে ঐ পথে রেখাটি চলে গেছে ।



পড়ন্ত রোদের আলোয় সাঁচীকে বড় উজ্জ্বল মনে হ'ল এবং প্রকৃতপক্ষে তা এখনো বৌদ্ধস্থাপত্যে ভাস্বর । সবুজ লন । একটা স্থানে ছোট ছোট জীব যেমন খরগোশ, হাঁস, পায়রা ছেড়ে রেখে দেওয়া হয়েছে ।তাদের পালন করা হচ্ছে ।   বৌদ্ধধর্মের অহিংসার একটি অন্যতম ধারা যা বহন করছে । সূর্যডোবার সেই মূহুর্তে সাঁচীস্তূপে দাঁড়িয়ে মনে হল সম্রাট অশোক সেই খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কত প্রতিকূলতার মধ্যে এই সাঁচী পাহাড়ে পৌঁছেছিলেন আর অমন দৃষ্টিনন্দন একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং স্তূপ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন যা এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের মনে শিহরণ জাগায় ।

ভারত বিচিত্রা এপ্রিলসংখ্যা ২০১৩  

http://www.hcidhaka.org/bharat_bichitra.php

Sunday, July 21, 2013

মইস্যার মনসার থানে

নদীমাতৃক দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বৃহত জেলা মেদিনীপুর । সেখানে যেমন আছে নদীর জলে পুষ্ট সবুজ গভীর জঙ্গল ঠিক তেমনি আছে ঐ জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে অগুন্তি সরীসৃপের পরিবার । ছোট বড় নদীর জল , ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা এই সরীসৃপদের মধ্যে বাংলার বিখ্যাত সব সাপেরা গড়ে তুলেছে এক সুন্দর ইকোসিস্টেম । তাদের খুব পছন্দের জায়গা পশ্চিমবাংলার এই স্থানটি । ঘন জঙ্গলের মধ্যে সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, বানভাসি শ্রাবণ-ভাদ্রের থৈ থৈ নদীর দুকুল ছাপিয়ে জল ও চলে আসে সেই জঙ্গলে আর মনের সুখে দিন যাপন করে শঙ্খচূড়, কালনাগিনী, গোখরো, খরিস, চন্দ্রবোড়া সমেত আরো নানা অজানা সাপেরা । এদিকে এই বিশাল জেলায় আছে অঢেল চাষযোগ্য জমি । তাই কৃষকেরা রোজ মা মনসাকে স্মরণ করে ক্ষেতে যায় চাষ করতে । শীতে একটু আরাম । সাপেরা তখন হাইবারনেট করে, গর্তের নীচে শীতঘুম দেয় কিন্তু প্রচন্ড গরমের দাবদাহে বাইরে চলে আসে । বর্ষায় দেখায় উদ্দাম নৃত্য। চাষীবৌ কুঁড়ের ধারে পথ চেয়ে বসে ভাবে স্বামীর কথা । বর্ষার হাঁটুজলে ধানচারা লাগাতে গিয়ে যদি সাপে কাটে তার স্বামীকে ।
সে জানে সাপকে নাকি জ্বালাতন না করলে সে কিচ্ছু করেনা কিন্তু তার ল্যাজে পা পড়ে গেলে সে ভয়ানক রেগে যায় । আর বিষধর সাপ হলে তো আর কথাই নেই ! কৃষক যখন আর হাল দিতে পারেনা বৌ তার চেলেমেয়েকে নিয়ে মাঠে যায় । গিয়ে আবার ঐ এক চিন্তা ঘোরে মাথার মধ্যে । সেবার সাপে কেটেছিল গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলেকে । ঝাড়ফুঁক করল ওঝা এসে । আয়ুর্বেদিক ডাক্তার এসে বিষ বের করে ওষুধ লাগিয়ে দিল । অনেক কষ্টে মা মনসার দয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গেল ছেলেটা । সন্ধ্যেবেলা কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে মেয়েরা মনসার ভাসান গীত গাইল । এইভাবে কাটে সব চাষীদের জীবন । ওরা ধান বোনে আমাদের জন্য কিন্তু সেই ধান বোনার পেছনে কত ভয় মেশানো কাহিনী থাকে তা তো আমরা জানিওনা । সেবার ধানের গোলায় সাপ ঢুকে সে কি বিপত্তি । আরেকবার মাটির ঘরের চালে লাউয়ের মাচা থেকে লাউ আনতে গিয়ে একটা সবুজ লাউডগা তো বাচ্চা একটা চাষীবৌয়ের হাতে জড়িয়ে সে কি কান্ড! মেয়েটা তো ভয়েই অজ্ঞান । ভাগ্যি লাউডগা সাপের বিষ নেই ! একটু বেশি বৃষ্টি হলে ঘর-উঠোন যখন জলে জলময় হয় তখন দু-একটা জলঢোঁড়া ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে । মাটির ঘরে না আছে ইলেকট্রিক না আছে পাকা ছাদ । বেশি বৃষ্টি হলে দু'একটা চিতি সাপকে চুপচাপ মশারীর দড়ির সাথে জড়িয়েও থাকতে দেখেছে ওরা । খোলস ছেড়ে সাপেরা যখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন কত বিচিত্র রংয়ের খোলস দেখে গ্রামের লোকে । আবার সেই ভয় মনের মধ্যে পুষে রেখে দিনের পর দিন বুক বেঁধে কাটায় ওরা !
অথচ সাপের ভয় থাকলে কি হবে এই মেদিনীপুরই ছিল ভারতের ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনের মুখ্য কেন্দ্র । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম বসুর মত মানুষের জন্মস্থান এই মেদিনীপুর । কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, শিলাবতী প্রভৃতি নদীর জলে পুষ্ট, ধনধান্য-পুষ্প-ভরা এই জেলার মাটি । কুরুম্ভেরা, গোপগড়, কর্ণাগড়, ময়নাগড়, বর্গভীমা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী, পাথরার মত মন্দিরময় । ঝাড়গ্রামের মত স্বাস্থ্যকর ট্যুরিষ্ট স্পট আছে এখানে । পূর্ব মেদিনীপুরে আছে দীঘার সমুদ্র সৈকত । বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আরো আরো ট্যুরিষ্ট কেন্দ্র হয়েছে তাজপুর, মন্দারমণি আর চন্দনেশ্বরে ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জকপুরের কাছে এমন এক জঙ্গল আছে যাকে গ্রামের মানুষেরা মনসার জঙ্গল বলে । ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ পাশে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তারিত এক গভীর খাল ছিল । বর্ষার সময় অতিবৃষ্টিতে ঐ খাল দিয়ে খড়গপুর সহ পশ্চিমের উঁচু জায়গায় বৃষ্টির জল হৈ হৈ করে বয়ে যেত পুব দিকে আর বন্যার আকারে জমেই থাকত সেখানে । শরতের কাশফুলের রমরমায় খালপাড় তখন মেতে উঠত পুজোর আনন্দে । এখানকার কৃষকেরা মনের আনন্দে ধানচাষ করে আরভাদু পরব উদ্‌যাপন করে মনের আনন্দে কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটু অশান্তি সর্বক্ষণের ...ঐ সর্পকুলে বসবাসের জন্য । মা মনসাকে সর্বদা স্মরনে-মননে রাখে । শ্রাবণ-ভাদ্রের শনি-মঙ্গলবারে মনসার পুজো দেয় । শুধু সাপের কারণেই নয় মনসাকে তারা কৃষিদেবী রূপেও মানে । তাদের রুজি-রোজগার, সম্বচ্ছরের খোরাকি সব ঐ ধান চাষকে ঘিরে । পর্যাপ্ত বর্ষায় প্রচুর ধানে মাঠঘাট যাতে সবুজে ভরে ওঠে, তাই সমস্ত চাষীরা একজোট হয়ে ঐ জঙ্গলের কোনো এক ধারে মা মনসার আরাধনা করে চলে বছরের পর বছর ধরে । পাকা ধান তোলার সময় প্রত্যেকে এক আঁটি করে পাকা ধান মাথায় করে মা মনসার থানে রেখে এসে মা'কে মিনতি জানায়: "মা গো, আমরা ছাপোষা মানুষ, দিন আনি দিন খাই, পেটের দায়ে চাষ করছি, আমাদের অপরাধ মার্জনা কোরো, সম্বচ্ছর সন্তানদের দুধেভাতে রেখো, পরের বছর যেন আবার চাষ করে তোমাকে ফসল দিয়ে পুজো দিতে পারি মা "
প্রায় চারশো বছর আগে জকপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায় একদিন ভোর রাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পেলেন । তিনি স্পষ্ট দেখেন, চতুর্ভুজা মা মনসা হাত নেড়ে নেড়ে তাকে বলছেন, ঐ জঙ্গলেই মা আছেন । জমিদার যেন মায়ের পুজোর প্রচার করেন ।
ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে জমিদার কাঁপতে কাঁপতে ঘটি ঘটি জল খেয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে জমিদার বাড়িতে যে যেখানে ছিল হাজির হয়ে যায় । ঐ জঙ্গলের সাপের কথা সকলের জানা । মা মনসার থান বলে জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ । একথা সকলে প্রত্যক্ষ করেছে । সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর আদেশ দেন । ক্রমে কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে কিছুটা সাফ করে ফেলে । মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হতে থাকে । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে । উইঢিপিটিকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় । পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয় উইঢিপির মাটি দিয়ে । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে মনসার থানকে মর্যাদা দেন জমিদার যোগেশ্বর রায় । নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় সেখানে । যেমন করে আমরাও পুজো করলাম ফুল, দুধ আর কলা কিনে । উইঢিপির ওপরেই দিধ ঢেলে সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করা হল মা মনসা কে । ইচ্ছামত যা খুশি দাও । না দিলেও কেউ কিছু বলবেনা । পান্ডা বা পূজারীরও উপদ্রব নেই ।
বর্তমানে যে স্থানে মায়ের পুজো হয় সেই স্থানে আমরা গেছিলাম খড়গপুর থেকে ।
খড়গপুর থেকে NH-2 ধরে কোলকাতার দিকে গিয়ে জকপুর রেলষ্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ডুবগোহাল স্কুলের পাশ দিয়ে ম‌ইশ্যা গ্রামের ভিতর দিয়ে মনসা মন্দিরে যাওয়া যায় । খড়গপুর স্টশন থেকে লোকাল ট্রেনে জকপুর বা মাদপুর স্টেশনে নেমে ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়িতে মন্দিরে যাওয়া যায় । কোলকাতা বা হাওড়া থেকে লোকালে মাদপুর বা জকপুর নেমে এক‌ইভাবে মন্দিরে আসতে হয় ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সে এক এডভেঞ্চার! আমাদের হাতে গুগ্‌লম্যাপ । আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গ্রামের সরু মেঠো লাল রাস্তার মধ্যে দিয়ে হঠাত আবিষ্কার করলাম ম‌ইশ্যা । গাড়ির কাঁচ নামাতেই বনফুলের সোঁদা গন্ধ নাকে এল । আর পাখপাখালির কিচিরমিচির । কোথাও একটু ধানজমি কোথাও আবার সর্ষে ক্ষেতের হলুদ । সজনেফুলের গন্ধ বাতাস চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে । আমগাছে মুকুল এসেছে সবে । কুঁড়ে ঘরের লাগোয়া একফালি জমিতে কত কত আলু, ফুলকপি, টমেটো ! কি ভলো লাগে আমার এসব তারিয়ে তারিয়ে দেখতে ! সেই জমিদারের আমল থেকে ঐ মনসা থানে মা বিষহরির পুজো হয়ে আসছে । খোলা অকাশের নীচে ঐ উইঢিপির কুন্ডলী ও পদ্মফুলে সারা বছর ধরে পুণ্যার্থীরা ফুল চড়াতে আসেন শুধু কৃষির জন্য এবং সাপের দংশনে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই জন্য । কথায় বলে "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর" তাই প্রতিবছর চৈত্রমাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে এখানে মনসামায়ের মহাপূজা আর মেলা হয় । নিজের হাতে পুজো দেন দলে দলে পুণ্যার্থী । পশ্চিমবাংলায় গঙ্গাসাগরের মেলার পর এটি দ্বিতীয় বড় জনসমাগমের মেলা । সেই জমিদারের আমলে এই পুজোর রমরমা শুরু হতে থাকে । তারপর বৃটিশ সরকার মাদপুর থেকে জকপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করে। মায়ের থানে দাঁড়িয়ে রেললাইন এবং অনবরত ট্রেন যাওয়া আসা দেখা যায় । মন যেন হারিয়ে যায় কোথায় । সেই ট্রেনের বাঁশী আর মন্দিরের স্থান-মাহাত্ম্য মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এক আকাশের নীচে ।
স্থানীয় মানুষ বৃটিশদের অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়ে মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিল । সাহেবরা হেসে কুটিপাটি ! সেই কথা শুনে বলেছিল "হিন্দুডের ওয়াটার, স্কাই, ফায়ার, এসবের ডেব্‌টা আঠে । বাট্‌ স্নেকের ডেব্‌টা! হোয়াট ইজ দিস?" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে । মানুষেরা সাহেবকে অনেক ভয় দেখাল এবং সম্মিলিত হয়ে বাধা দিল। তাদের বাধা তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার বাইরে থেকে আনা শ্রমিক দিয়ে বাহুবলের দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে অতঃপর সেই বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এসে ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন লাগিয়ে দিল জঙ্গলে । সর্পকুল বিনষ্ট হবে এই আশায় । কিন্তু বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেল তারা । তারপর জমিদার প্রজাদের সঙ্গে করে জঙ্গলের মধ্যে সরু রাস্তা কাটিয়ে অনায়াস যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আবার সশরীরে ফিরে এলেন প্রজাদের নিয়ে । মা মনসা নিজের মন্দিরে প্রবেশের পথ এইভাবে করে দিলেন । 

মেদিনীপুর সহ সমগ্র দক্ষিণবাংলার মানুষ পুত্রলাভের আশায়, বেকারের চাকুরীর আশায়, হারানো গরুর খোঁজে, মারণ ব্যাধির নিরাময়ে মায়ের থানে মানত করে যায় । মেলা ও মহাপুজোর দিন নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুজো কমিটি । স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, দুঃস্থ ছাত্রদের পুস্তকদানের মত উন্নয়ন মূলক কাজও করে থাকে এই পুজো কমিটি ।


ছোটদের ই-পত্রিকা ইচ্ছামতী গ্রীষ্মসংখ্যা ২০১৩ তে প্রকাশিত  


ময়নাগড় অভিযান



খড়গপুর থেকে ডেবরা হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের দিকে । কোলাঘাট অবধি ন্যশানাল হাইওয়ে ৬ ধরে সোজা চলেছিলাম শীতের ছুটির সকালে । তারপর গাড়ি থামিয়ে স্মার্টফোনের গুগ্‌ল ম্যাপ বাকী পথের দিশা দেখাল । কোলাঘাট থেকে হলদিয়ার পথ ধরলাম এবার । কাগগেচ্ছা গ্রাম হয়ে নিমতৌড়ি । সেখানে গিয়ে স্থানীয় পুছতাছ । বুঝলাম ময়নাগড় এসে গেছে । এতক্ষণ চলছিল হাইওয়ের ধারে হলুদ সর্ষে ক্ষেত, জলে ডোবা ধানক্ষেতে গুছগুচ্ছ ধানচারার ওপর মাঘের রোদ-কণার লুটোপুটি । এবার গ্রামের কুঁড়ের লাগোয়া সজনে ফুলের গন্ধে মম করা বাতাস, বাঁশঝাড় আর চিংড়ির আড়ত । খড়ের ছায়ার ঘেরা পানের বরজ ।


একটা নদীর ব্রিজ পেরোতেই লেখা স্বাগতম ১০০০ বছরের পুরোণো ময়নাগড়ে । গ্রামের নাম গড়সাফাত । মাঠের ওপর বিদ্যাসাগর পাঠাগারের সামনে গাড়ি রেখে এবার অভিযান ময়নাগড় ।


রাজবাড়ির বিশাল গেটের ওপরে লেখা রয়েছে ইতিবৃত্ত । ধর্মমঙ্গল কাব্যগ্রন্থে ময়নাচৌড়া বা ময়নাগড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়|

 রাঢ়বঙ্গের মহাকাব্য এই ধর্মমঙ্গলের প্রধান নায়ক ছিলেন রাজা লাউসেন। ইনি ছিলেন ময়নাগড়ের ধর্মরাজের প্রতিষ্ঠাতা । হিন্দুধর্মের তন্ত্রবিদ্যা এবং মহাযানী বৌদ্ধদের মতবাদের পাশাপাশি মুসলমান ধর্মের এক সুন্দর সমন্বয় ঘটেছিল এই অঞ্চলে । ময়নাগড় এই কিংবদন্তী পালরাজা লাউসেন নির্মিত গড় বা কেল্লার জন্য এককালে প্রসিদ্ধ ছিল । এখন সেই কেল্লার অবস্থান কেবলমাত্র ইতিহাসের পাতায় । এরপর অনেক জল গড়িয়েছে । পলাশীর যুদ্ধের পর ওয়ারেন হেষ্টিংসের আক্রমণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ময়নাগড় । কিন্তু এই ধর্মরাজ্য স্থানান্তরিত হয়নি । কংসাবতী নদীর মধ্যে দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ এই নয়নাভিরাম ময়নাগড় । এমনকি মধ্যযুগে মারাঠাদস্যু বর্গীর আক্রমণেও প্রাচীনতম দুর্গটির ক্ষতি হয়নি । ময়ানাগড়ের বৈশিষ্ট্য হল শান্ত পরিবেশের মধ্যে গাছগাছলি ঘেরা বিশাল নদীর পাড় । নারকেল গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে হেঁটে বুঝলাম ওপারে অপূর্ব একটি মন্দির রয়েছে ।

কিন্তু সেখানে পৌঁছাব কি করে ? তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর । নদীর ঘাটে দু একটা ডিঙি নৌকো বাঁধা কিন্তু মাঝি নেই একটাও । একটা বুড়ি নদীর জলে কি যেন ধুচ্ছিল তাকে শুধালাম । সে বাড়ি গিয়ে তার কোন এক আত্মীয়কে ডেকে দিল । সেই ছেলেটি আমাদের ডিঙিনৌকো করে ওপারে পৌঁছে দিল । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি । রাজবাড়ীর প্রকান্ড ধ্বংসাবশেষের বারমহল পেরিয়ে চলেছি আমরা মন্দিরমহলে । প্রথমে তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে রাধাকৃষ্ণ মন্দির । অপূর্ব বিগ্রহ । নিত্য পুজোপাঠ হয় । সকাল সকাল এসে বলে রাখলে ভোগপ্রসাদও পাওয়া যায় । মন্দিরের একপাশে সতীরাণীর ঘাট । ফলপাকড়ের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা মুগ্ধ করে । সেখান থেকে শিবমন্দির । টেরাকোটার অপূর্ব কাজ মন্দিরের গায় । ভেতরে স্বয়ংভূ শিবলিঙ্গ পাতাল থেকে প্রোথিত আর রংকিনীদেবীর বিগ্রহ যিনি এখানে ভদ্রকালী রূপে পূজিতা । মহাদেবের নাম লোকেশ্বর । মন্দিরের বাইরে একটি পাথরের নততলে গাঁথা রয়েছে সূর্যশঙ্খ । সূর্যের পুজো করার জন্য এই শাঁখে জল দেওয়া হত পূর্বে ।


কার্তিকমাসে রাশ পূর্ণিমার সময় এখানে সবচেয়ে বেশী ভীড় হয় । পাশের আরেকটি দ্বীপে নৌকায় করে দলবল নিয়ে রাধাকৃষ্ণ রাসলীলায় সামিল হন আর রাসমঞ্চে হাজির হন । প্রতিবছর রং, ধোয়া মাজার কারণে রাসমঞ্চটি বেশ ঝকঝকে । তখন এখানে বিশাল মেলা হয় । নয়াগ্রাম থেকে পটশিল্পীরা এসে পটচিত্রের পসরা বসিয়ে হাতের আঁকা শিল্পকর্মের সাথে গেয়ে শোনান তাদের ঘরাণার কাব্যগান । পাথরের ও বাঁশের কাজেরও বিক্রিবাটরা চলে । আশপাশের গ্রাম থেকে লাখ দুয়েক মানুষ এসে জড়ো হন এই উত্সবে ।


রাসপূর্ণিমার সময় নৌকোগুলিকে আলো দিয়ে অসাধারণ সাজানো হয় আর সেই আলোর ছায়া কাঁসাইয়ের জলে প্রতিফলিত হয়ে এক মোহময়তার সৃষ্টি করে । সংস্কৃতি উতসব হয় তখন এই ময়নাগড়ে ।


মন্দিরের বাইরে সিংহবাহিনীর প্রতিকৃতি আর দেওয়ালে টেরাকোটার সিপাই থেকে শুরু করে ঘোড়সওয়ার, ময়ূরপঙ্খী নৌকোর নিখুঁত শিল্পকর্ম যা কালের স্রোতে কিছুটা ম্রিয়মান কিন্তু তবুও ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী ।



আমাদের নৌকোর মাঝিই আমাদের গাইড হয়ে সব একে একে ঘুরে ঘুরে দেখালো । মন্দির দুটি দেখে সে আমাদের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল । কাঁটাঝোপের মধ্যে যেতেযেতে দেখি গাছের পাতায় পাখির বিষ্ঠায় সাদা আলপনা । মাঝি শুধালো ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী সামখোল পাখি প্রতিদিন সূর্যিডোবার প্রদোষে এসে নদীর জল খায় । সেই নদীর ধারে নেমে গেলে দেখা গেল দূরে পীরবাবার জাগ্রত দরগা ।

ফেরার পথে স্থানীয় হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক ঝোল-ভাত । মেদিনীপুরের বিখ্যাত কালীবাংলা বা কালীঢল পান সহযোগে মধুরেণ সমাপয়েত হল ময়নাগড় অভিযানের উইকএন্ড ।

ছোটদের ই-পত্রিকা দিয়ালা একাদশ সংখ্যায় প্রকাশিত 

একছুট্টে রাজরপ্পা




মাঘের মিঠে রোদ পিঠে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাঁচী থেকে একটা গাড়ি নিয়ে রাজরপ্পার দিকে । রামগড় থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে আর রাঁচি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে রামগড় ও চিতোরপুর রোডের ওপরেই রাজরপ্পা । হাজারিবাগ রোড ধরে খেলগাঁও দিয়ে চলতে লাগলাম । ন্যাশানাল হাইওয়ে ৩৩ এর ওপরে ঝকঝকে সাজানো আর্মি ক্যান্টনমেন্ট "দীপাটলি" এল । ছোটনাগপুর মালভূমির সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে আমাদের চলা । বেশ মনোরম জলবায়ু আর সবুজ প্রকৃতি । কিছুপরেই এল রামগড় ঘাঁটি । একটু চড়াই আবার সামান্য উতরাই পথ দিয়ে চলতে চলতে পালামৌ, বিভূতিভূষণ মনে পড়ছিল । গাড়ির কাঁচ খুলে নাম না জানা, অচেনা ফুলের বুনো গন্ধ নিতে নিতে ভাবছিলাম অধুনা ঝাড়খন্ডের এই অংশটির কথা । বৈচিত্র্যময় ঝাড়খন্ডের এই ভূখন্ডটির সম্পদ হল পাহাড়-মাটীর স্তূপের মধ্য দিয়ে অগুন্তি ছোট-বড় নদী আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে ঝরে পড়া ঝোরার কলকলানি । সেবার গেছিলাম রাঁচি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে দশম ফলস । মনে পড়ছিল সেই কথা । কি অপূর্ব সেই রূপ ! সুবর্ণরেখা নদীর এক শাখা নদী কাঁচীর দশটি সাবলীল ধারা অবলীলায় ৪৪মিটার ওপর থেকে ঝরে পড়েছে একসাথে নীচে । এছাড়াও হুন্ড্রু, জোনহা, হিরণি, পাঁচ গাঘ ফলস, সীতা ফলস, কাঁকে ড্যাম, রাঁচি লেক ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশটি ঘিরে যেন এক ন্যাচারাল নবরত্নের মালা গেঁথে সাজিয়ে রেখেছে নিঁখুত ভাবে । আর সাঁওতাল মানুষের জীবনযাপন, ধামসা-মাদল, অনবরত ঝরে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল ভুর্জ্যপত্রের ওপর লিখে রেখে যায় কত সময়ের দলিল। বছরের পর বছর ধরে যা পুরোণো হয়না । মহুয়ার ঝিম ধরা নেশার মত সেই গল্প উঠে আসে বারবার কত লেখকের কলমে, বীরসা মুন্ডার জীবন যুদ্ধে ।

এখানকার সবচেয়ে বড় নদী দামোদর । রাঁচি ও হাজারিবাগ মালভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের আরেক নদী ভৈরবী বা ভেরার সাথে মিলিত হয়েছে দামোদর আর সেই সঙ্গমেই রাজরপ্পা জলপ্রপাত । প্রায় ৯ মিটার উঁচু থেকে ভেরা নদীর অবিরত ধারা ঝরেছে দামোদরের বুকে । রাজরপ্পা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যই নয় ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমস্তিকার মন্দিরের জন্যও যথেষ্ট বিখ্যাত । সতীর দেহ ত্যাগের পর মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সতীর মস্তকটি না কি এখানে পড়েছিল তাই দশমহাবিদ্যার অন্যতম ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দিরটি একান্ন সতীপিঠের একটি বলে অনেকেই দাবী করেন । সতীপিঠ হোক বা না হোক গাড়ি নীচে রেখে সামান্য চড়াই পাহাড়ী পথ ধরে মন্দিরের দিকে এগুতে লাগলাম আর কেমন যেন একটা এথান মাহাত্ম্য অনুভূত হল । বহুদিন আগে যখন এই রাস্তা হয়নি তখন নদী পেরিয়ে মন্দিরে আসতে হোত । এখন রাজরপ্পা বেশ অনেকটাই আধুনিক এবং ভেতরে প্রবেশ করে দেখি কঙ্ক্রিটের বাহুল্যে কিছুটা হলেও কৃত্রিম । তবে মা ছিন্নমস্তার মন্দির এবং রাজরপ্পা জলপ্রপাতটি ভুলিয়ে দেয় সবকিছু । ছিন্নমস্তার মন্দির বড় একটা দেখা যায়না তাই আমার এত আগ্রহ ছিল । অনেকটা কামাখ্যা মন্দিরের ঢঙে নির্মিত মূল মন্দিরটি । আর এই মন্দিরকে ঘিরে কালীর দশ মহাবিদ্যা রূপের অন্য গুলি অর্থাত তারা, কমলা, বগলা, ভৈরবী, ধূমাবতী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, মাতঙ্গী প্রভৃতির মন্দির গুলি নির্মিত হয় অনেক পরে । মন্দির চত্বরে দর্শনার্থীদের বিশাল লাইন দেখে ঘাবড়ে গেলাম । কিন্তু কিছুপরেই অতি সুন্দর নিয়ম মেনে লাইন এগুতে দেখলাম আর একসাথে জনা কুড়ি মানুষকে পুজো দিতে সম্মতি দেওয়া হয় । কোনো পান্ডার উপদ্রব নেই । আর অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পুজো দেওয়া যায় । তাই গাড়ীর ড্রাইভারকে লাইন রাখতে বলে পুজোর ডালা কিনে নিয়ে ঘুরতে গেলাম নদীর ধারে । নৌকো করে ওপারে যাচ্ছে মানুষ । আর দুই নদীর সঙ্গমে রাজরপ্পা ঝোরার কলকলানি বড়ই দৃষ্টিনন্দন ।

তখন দুপুর একটা বাজে । সারি সারি শালগাছের মাথায় দুপুরের সূর্য সজাগ । আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-এক ঘর সাঁওতাল বসতি । লাইন দিয়ে মা ছিন্নমস্তার মন্দিরে প্রবেশ করলাম এক গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে ; সিঁদুর লেপা পাথরের গায়ে খোদাই করা হয়ত মায়ের মুখ । অন্ধকারে দেখা গেলনা । তবে পুজো নিয়ে অহেতুক আড়ম্বর নেই । পূজারীর দাদাগিরিও নেই । সেটাই বেশ ভালো লাগল ।বহু দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছেন মনস্কামনা পূরণ করতে ছাগল সাথে করে । স্থানীয় সাঁওতাল মানুষেরা ছিন্নমস্তাকে অসম্ভব ভক্তি করে এবং তাদের মৃত মানুষের অস্থিভস্ম এই দামোদর নদীতে ফেলে । মন্দির থেকে নেমেই যেতে হয় কালভৈরবের কাছে । নারকোল ভেঙে জল ঢেলে শিবের প্রণাম হল । তারপর আবার দুই নদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে পেছনপথ দিয়ে তীরে উঠে গাড়ির খোঁজ করা । 


কখন যাবেন : বর্ষাকালে গেলে ওয়াটার ফলস গুলির থৈ থৈ রূপলাবণ্য দেখা যায় । এছাড়া রজরপ্পা নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি যাওয়াই শ্রেয় । কারণ গরমের সময় প্রচন্ড দাবদাহ চলে এই অঞ্চলে ।
কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেসে রাঁচি ও সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে রাজরপ্পা যাওয়া যায় ।
কোথায় থাকবেন : রাঁচি শহরে নামী দামী অজস্র হোটেল আছে । বিশেষ ছুটিতে গেলে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভাল ।


Sunday, April 28, 2013

খাজুরাহো ---কে বলে শুধুই erotica ???



আমরা বারাণসী থেকে একটি গাড়ী ভাড়া করে সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম দীঘি নিনোরা-তাল দিয়ে ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম খাজুরাহের দিকে । বিন্ধপর্বতের কোলে এই গ্রামে ছিল অনেক খেঁজুর গাছ । সোনার মত গুচ্ছ গুচ্ছ খেঁজুর ঝুলে থাকত সেখানে । তাই নাম খাজুরাহো ।
রেওয়া হয়ে যেতে হবে আমাদের । মাঝখানে বেলার কাছে গোবিন্দগড় মোড়ে দুপুরের খাওয়া । তারপর সাতনার দিকে । পথে পড়ল পান্না টাইগার রিজার্ভ । ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল। রেওয়া পর্যন্ত রাস্তা খুব খারাপ । পান্নার পথ ন্যাশানল হাইওয়ে ৭৫ । খুব তাড়াতাড়ি চলেছিলাম । এই পথ সোজা যায় কাশী থেকে কন্যাকুমারী । একে বলে "দক্ষিণপথ" । বিন্ধ্যপর্বতের গা ঘেঁষে চলা । হাতী আছে নাকি এই জঙ্গলে । জানলার কাঁচ সরাতেই বুঝলাম আমরা ঘাটি উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলেছি । বনফুলের সোঁদা গন্ধে ম ম চারিদিক । বড় নদী মান্ডলা পেরোলাম ।

সন্ধ্যের ঝুলে হোটেলে পৌঁছে মালপত্র রেখেই বেরিয়ে পড়া ঝাঁ চকচকে ছোট্ট শহর খাজুরাহে । শুনলাম "সন-এট-লুমেয়াঁ" অর্থাত "লাইট এন্ড সাউন্ড” শো সন্ধ্যে সাড়েছ'টায় । মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম আয়োজিত হিন্দী ও ইংরেজীতে ধারাভাষ্যে একঘন্টা ধরে সেই প্রদর্শনী ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপ অফ টেম্পলসের প্রকান্ড মাঠে । এত ছোট্ট শহরে হাতের মুঠোয় সবকিছু । দীপাবলীর পর বেশ ঠান্ডা । দোকানপাট রমরমিয়ে চলছে। হোটেল, পলিনেশিয়ান রেস্তোঁরা আর ফরেন ট্যুরিষ্টের ভীড় বেশী । টিকিট কেটে চেয়ারে বসলাম । ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যা ছিল গতকাল অবধি । আকাশে প্রতিপক্ষের একসূতো চাঁদের ফালি আর কয়েকটা ফুটফুটে তারা । ভাষ্যপাঠের শুরু । দূরে-কাছের মন্দিরের সীমারেখা জ্বলে উঠল । illumination ! রঙীন ও কৃত্রিম আলোয় কালো আকাশের পর্দায় ভেসে উঠল মন্দিরের স্কেচ। কি অপূর্ব । স্বর্গের অপ্সরা, ঊর্বশী রম্ভা, কিন্নর-কিন্নরী সব আছেন মন্দিরগাত্রে । প্রতিদিন আলোকের ঝর্ণাধারায় ধুয়ে যায় এদের কালিমা ।
ঘন্টাধ্বনির শুরু একযোগে । দেবদাসীর নূপুরের সিঞ্জিনী। ঘুঙুরের শব্দ, আবার ভাষ্যপাঠ । চন্দ্রবর্মণের জন্ম ও মন্দির তৈরীর কারণ শুরু থেকে শেষ একনাগাড়ে । একটুও একঘেয়েমি নেই । মনে হয় রাতটা এখানে থাকলেই ভালো হত ।
ইতিহাসের পাতায় তখন চান্ডেলারাজ তার জীবনদর্শন এঁকে চলেছেন । চান্ডেলারাজ চন্দ্রবর্মণ রচিত ইতিহাসের সাক্ষী আমরা । কালাঞ্জর, কাশী এবং খাজুরাহোর শাসক দেশের নামকরা ভাস্করদের আহ্বান জানান । তার ইচ্ছেয় চন্দ্রবংশীয় রাজচিহ্ন স্বরূপ এক যুবকের দ্বারা ধরাশায়ী সিংহের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করল ভাস্কর । আর তারপর রাজার আদেশে তৈরী হল একের পর এক অপূর্ব মন্দির । নগররীতিতে তৈরী মন্দিরে অভূতপূর্ব স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধন । শুধুই ছেনি-হাতুড়ি নয়, পাথর কুঁদে এমন শিল্পকর্মে লাগে ধৈর্য্য ও কল্পনা । অগণিত ভাস্করের শৈল্পিক কর্মে ফুটে উঠল কাইমুর স্যান্ডস্টোনে তৈরী অভিনব মন্দিরময় খাজুরাহো । গ্রানাইট পাথর এল পূর্বদিকের কেন নদীর ধারে পান্না পাথর খনি থেকে। চৌষট্টি যোগিনী মন্দির নির্মাণ হল । তারপর একে একে তৈরী হল কান্ডারিয়া মহাদেব, জগদম্বা, পার্শনাথ , লক্ষণ, দুলাদেও , বিশ্বনাথ , আদিনাথ, মার্তন্ডেয় মন্দির । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ বহন করছে এই মন্দিরগুলি । কেবলমাত্র মার্তন্ডেয় মন্দিরে বিশাল শিবলিঙ্গে পূজা হয় ।

বিকেলের আলতাগোলা আকাশে ফাগের রং চুঁইয়ে পড়ছে খাজুরাহোর স্থাপত্যে।
নারীমূর্তির কোমল পেলব প্রতিকৃতি মূর্ত হয়ে উঠছে সেই রংয়ে । পুরুষমূর্তিগুলিও প্রাণ পেল সেই প্রদোষে ।

মানুষের জীবন, দৈনন্দীন চাহিদা, নারী-পুরুষের সৃষ্টি রহস্যের মূলে মৈথুন, জাগতিক সবকিছু । যুদ্ধ, বিবাহ থেকে শুরু করে জীবনযাপনের অনুষঙ্গ সব নিয়ে ভাস্কররা তৈরী করেছিল মন্দিরের দেওয়াল, মন্ডপ, পোর্টিকো, তোরণ । মন্দিরের মধ্যে মন্দির । সেখানে মহাদেব, নন্দী, বিষ্ণুর বরাহ অবতার । ভাঙতে এসেছিল কুতুবুদ্দিন আইবক । তাকে রুখে দেওয়া হয়েছিল কালাঞ্জরে । কি অপূর্ব কারুকার্য ! বাত্স্যায়ণের কামসূত্র থেকে অপ্সরার রূপসজ্জা। কখনো নারী ত্রিভঙ্গ আবার কখনো বহুভঙ্গ রূপ । চোখে কাজল পরছে কিম্বা সিঁথিতে সিঁদুর । দর্পণে মুখ দেখছে কিম্বা এখনকার ফ্যাশন প্যারেডের মত দলে দলে তাদের শরীরি বিভঙ্গ বা নৃত্যরতা নর্তকীর ঘুঙুর বাঁধার দৃশ্য । রম্ভারূপসী পায়ের পাতা আঁকা বা ঊর্বশীর পায়ের নীচে কাঁটা বের করা । কোথাও দেখি ধ্যানমগ্ন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ বা মৃত্যুর দেবতা যমরাজ। কোথাও আবার সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নির্মিত চিত্রগুপ্ত মন্দির । চেয়ে দেখি কামদেব এর দুই পাশে রতি ও প্রীতি !


ভাস্করের হাতে যেন ছিল পরশপাথর । ছেনি-হাতুড়ির সমণ্বয়ে ফুটিয়েছিল মন্দিরগাত্রের কি অপূর্ব বৈচিত্রময়তা ! একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ! কিছু কিছু ভেঙে গেছে কালের স্রোতে । ভূমিকম্প-ঝঞ্ঝা ফাটল ধরাতে পারেনি এখনো বেঁচে থাকা পঁচাশিটি মন্দিরকে । অক্ষয় সেই স্থাপত্য, অব্যয় সেই ভাস্কর্য ।
শৃঙ্গাররত নরনারীর কামোদ্দীপক ভাস্কর্য । কিন্তু কে বলে শুধুই erotic sculpture আছে খাজুরাহে? প্রতি পঞ্চাশটির মধ্যে একটি হয়ত মৈথুন রত দম্পতির সুখ যাপনের চিত্র বাকী সব রিয়েল লাইফের টানা ও পোড়েন । হয়ত রাজার আদেশে অণুপ্রাণিত হয়েছিল ভাস্কর । স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফুটিয়ে তুলেছিল রমণ ক্রিয়া । কিন্তু সে তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুধু তো তাই নয় । সংসার, পুজোপার্বণ, রাজার যুদ্ধযাত্রা হিন্দু দেবদেবী সবকিছুই তো বাস্তব জীবনের অংশ ।
এমন হাজারে হাজারে স্থাপত্য । দেখে শেষ করা যায়না । কূল কিনারা পাইনা ভেবে সেই ভাস্করের হাতের শৈলীকে । কত বছর ধরে না জানি ছেনি-হাতুড়ি-বাটালির শব্দের তুফানে অনুরণিত হয়েছিল খাজুরাহের আকাশ বাতাস । ভাস্করের মনমন্দিরের কল্পনাপ্রসূত হয়ে জন্ম নিয়েছিল এই অভিনব শিল্পকর্ম ।





কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে বারাণসী ও সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে বারাণসী যাওয়া সবচেয়ে ভালো ।
কখন যাবেনঃ প্রখর গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল অবধি খাজুরাহো যাবার আদর্শ সময় ।
কোথায় থাকবেনঃ খাজুরাহোতে প্রচুর ভালো ভালো হোটেল আছে । তবে একটু ভালো হোটেল পেতে গেলে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভালো কারণ বিদেশী পর্যটকে উপছে পড়ছে ।

Thursday, April 4, 2013

তমলুকের শক্তিপিঠ দেবী বর্গভীমায়




আমরা সেদিন হঠাত বেরিয়ে পড়েছিলাম পাঁচজনে । গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্‌ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর অগতির গতি স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স । এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে । সেদিন ছিল শ্রাবণের আধো আলো আধো ছায়ায় মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের একটা ছুটির দিন ।

কোলকাতা মুম্বাই রোড ধরে ন্যাশানাল হাইওয়ে সিক্সের ওপর দিয়ে কোলাঘাট । কোলাঘাট থেকে হলদিয়া হাইওয়ে ধরে দীঘার রাস্তা ধরালাম । রোদবৃষ্টির খেলা চলল সাথে । সবুজ ক্ষেত, শ্রাবণী বনানীতে এবার বর্ষা অধরা । বৃষ্টিতে এদের সজীবতা আরো প্রকট হয় । কিন্তু এবার এদের শ্যামলতা কিছুটা নিষ্প্রভ । ধান নেই মাঠে । তবুও হাওয়ায় মৌসুমী গন্ধ । ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি নিয়ে তমলুক এল। বাঁদিকে বেঁকে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে কেলোমাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে লেভেলক্রসিং টপকে যাচ্ছি তখন । দীঘার ট্রেন এই রেলপথে যায় বুঝি । স্টেশনের নাম শহীদ মাতঙ্গিনী । এবার তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে । 
 

দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি) তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম । 
 
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী । মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে । মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে । 

 
মন্দিরে পুজো চড়িয়ে প্রসাদ খেয়ে এবার মহাপ্রভু নিরামিষ ভোজনালয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহারপর্ব । সেখান থেকে যাওয়া হল তমলুক রাজবাড়ি দেখতে । বিশাল চত্বরে রাজবাড়ির অবশেষ । তাক লাগানো বারমহল, অন্দরমহল, বিশাল দালান, সংলগ্ন মন্দির ঘুরে দেখলে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয় । মহাভারত্, ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ময়ূরধ্বজ রাজবংশের এই বাসস্থানের কিছুই পড়ে নেই । আছে শুধু বট-অশত্থ্ব-পিপলের শিকড়ে জীর্ণ রাজবাড়ির দেওয়াল । থাম, অলিন্দ ইত্যাদির পাশাপাশি আবডালের চিক-মহল লক্ষ্য করলাম যেখান থেকে হয়ত রক্ষণশীল মহিলারা উঁকি দিতেন বারমহলে । নূপুরের ছন্দে আর এস্রাজের অণুরণনে হয়ত বা ভেসে যেত রাজবাড়ির আনাচকানাচ । মাথার ওপর দিয়ে চামচিকে উড়ে গেল । কিন্তু তবুও লাল ইটের স্থাপত্য কীর্তি আজো জ্বলজ্বল করে ঝলমলে রোদে । মনে হল "কালের ধ্বনি শুনিতে কি পাও?" পাশেই বিশাল পুকুরের জলে হাত পা মুখ ধুয়ে ঠান্ডা হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায় জিরেন নিয়ে আবার ঘরে ফেরার পালা । কোলকাতা থেকে দীঘা, শঙ্করপুরের রাস্তায় ফেরার পথে ঘুরে আসা যেতেই পারে এই দুটি স্থান । 
 সকালবেলা ৪ এপ্রিল ২০১৩ 
 

Sunday, February 17, 2013

শ্রীমান তীর্থরাজ এবং জলপরি


 শোন নদীর উত্সমুখ  
বিলাসপুর থেকে ভাড়ার গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু মধ্যপ্রদেশের অনুপপুর জেলার অমরকন্টকের উদ্দেশ্যে । মন্দিরময় পুরোণো শহর অমরকন্টক যার আরেক নাম তীর্থরাজ । যেখানে ভারতের দুই উল্লেখযোগ্য পর্বত বিন্ধ্য এবং সাতপুরা মিলিত হয়েছে মৈকাল পর্বতের সাথে । আর সেই অমরকন্টক হল নর্মদা এবং শোন নদীর উত্পত্তি স্থল । 
 কপিলধারা
এই সেই নর্মদা নদী যে নাকি মৈকাল পর্বতের কন্যা । ভরা বর্ষায় তার জল থৈ থৈ রূপলাবণ্য নিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে গাল্ফ অফ খাম্বাতে গিয়ে তার আত্ম সমর্পণ । তার এই যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছে কত কত উপনদী, মিলিত হয়েছে তার সাথে হিরণ, তিন্ডোনি, কোলার, হাথনী, গোয়ী, তাওয়া, এবং গাঞ্জাল.. বন্ধুনদী হয়ে তার কোলে এসে পড়েছে । স্থান দিয়েছে তার তীরে কত কত কোল-ভীল-কিরাট-ব্যাধ উপজাতিদের । যাদের লালনে শিবমহিমা ব্যাপ্ত হয়েছে নর্মদার তীরে তীরে । মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই অমরকন্টককে ঘিরে । নর্মদা যার উত্পত্তিস্থল । মহাকবি কালিদাসের রচনায় অমরকন্টককে "অমরকূট" বা যে পাহাড়ের শৃঙ্গের বিনাশ হয়না কিম্বা "আম্রকূট" বা যে পাহাড়ের চূড়া আমগাছের প্রাচুর্য্যে সমৃদ্ধ বলে আমরা জানি । নর্মদার একরাশ পাহাড়ী ঝোরায় মাঝেমাঝেই লুকিয়ে পড়া আর হঠাত হঠাত তার কলকল শব্দে গহিন জঙ্গলে বয়ে চলা দেখে মনে হল পাহাড় আর নদীর এই লুকোচুরি, নর্মদার তিরতির করে ঝরে পড়া কিম্বা দুধ-সাদা ফেনিল জলরাশির মধ্যে যে আনন্দ তা কিশোরী বালিকা বা যুবতীর হাসির মতই স্বতস্ফূর্ত এবং সাবলীল । 



অমরকন্টকের প্রাচীন মন্দিরগুলি পুরোণো ভারতীয় মন্দিরের ঐতিহ্য বহন করছে । অসাধারণ সুন্দর তার স্থাপত্য । কলচুরি মহারাজ কর্ণের আমলে তৈরী এই মন্দিরগুলি । সপ্তরথের আকৃতি বিশিষ্ট একটি শিব মন্দির রয়েছে যার তিনটি গর্ভগৃহ । একে বলে কর্ণ মন্দির । অমসৃণ লাল পাথরের তৈরী । কর্ণমন্দিরের উত্তরে ১৬টি স্তম্ভ বিশিষ্ট মাছেন্দ্র নাথ মন্দির । এছাড়া রয়েছে পঞ্চরথের আকৃতি বিশিষ্ট পাতালেশ্বর মহাদেও মন্দির । কেশব নারায়ণ মন্দির । ঠিক পাশেই রয়েছে সূর্যকুন্ড । কথিত আছে, একসময় নর্মদা এই স্থান থেকে উত্সারিত হত এবং তাই মহারাজ কর্ণদেব মহাভারতের ৩০০০বছর পর এই সূর্যকুন্ডটি এবং সংলগ্ন পাতালেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কুমারী নর্মদাকে আশ্রয় দেবার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরী করা হয় যার নাম রঙমহল ।
পুরোণো মন্দির দেখে এবার গন্তব্য নর্মদা উত্সস্থল বা নর্মদা-উদ্‌গম এবং যাকে ঘিরে রয়েছে একটি বিশাল কুন্ড ও তার আশেপাশে একরাশ নতুন মন্দির । রাজকীয় প্রবেশদ্বার এই মন্দিরের। এখন নর্মদার উত্সমুখ জলের ১২ফুট নীচে যেখানে নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ রয়েছেন । মহাদেবের স্বেদগ্রন্থি থেকে সৃষ্ট এই নর্মদা । বছরে দু-একবার কুন্ডের পিছনে দরজা খুলে জল ছেঁচে ফেলে দিয়ে আবার কুন্ড ভর্তি করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় । সেই সময় নর্মদেশ্বর এবং তার মন্দিরে প্রবেশ করা যায় । 
 নর্মদা উত্সস্থল বা নর্মদা-উদ্‌গম
নর্মদার উত্তরতীরে কপিলধারা জলপ্রপাত যেখানে মহামুনি কপিল তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন । কপিলধারা থেকে ১কিমি পশ্চিমে রয়েছে দুগধারা জলপ্রপাত । ঋষি দুর্বাসা এখানে তপস্যা করেছিলেন । এছাড়াও রযেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে শম্ভূধারা এবং দুর্গাধারা জলপ্রপাত । ঝরণার অবলীলায় ঝরে পড়া আর পাহাড়-মাটী-নদীর এত সুন্দর সখ্যতায় অমরকন্টক যেন হয়ে উঠেছে চির নবীন । নদীর উচ্ছলতায় পাহাড় যেন কথা বলে ওঠে এখানে । 
 মাই-কি-বাগিয়া
ভার্জিন নর্মদা সুন্দরীর যৌবনপ্রাপ্তি এই অমরকন্টকে । কুমারী নর্মদা তখনো মা নর্মদা হয়ে ওঠেনি । প্রাচীন মন্দিরের কিছু দূরেই পড়ে  যেখানে রয়েছে চর্ণোদক কুন্ড । ঘন অরণ্যের মধ্যে ফল ও ফুলগাছের ছায়া সুনিবিড় ইকোসিস্টেমে কুমারী নর্মদা স‌ই পাতিয়েছিল গুল--বকোয়ালি ফুলের সাথে । অসাধারণ সুন্দর দেখতে এই ক্যাকটাসের ফুল । নর্মদার জোলো হাওয়ায় গভীর অরণ্যে ফুটে থাকে এই ফুল যার বৈজ্ঞানিক নাম এপিফাইলাম অক্সিপেটালাম। হিন্দীতে বলে নিশিগন্ধী বা গুল--বকোয়ালি । এটি একটি অত্যাশ্চর্য বনৌষধি ।
যাইহোক আমরা হলাম পরিদর্শক । কুমারী নর্মদা আর গুল--বকোয়ালির সখ্যতায় গড়ে ওঠা মা-কি বাগিয়া দেখে নিলাম চটপট । হোম, যজ্ঞ, পূজোপাঠ চলছে মহা ধূমধাম করে । খুব নাকি জাগ্র্ত এই স্থান ।
কিন্তু শীতে ফুলবন্ধুটির দেখা পেলাম না । মার্চমাসে আবির্ভাব হয় তার ।
মা কি বাগিচার ১ কিমি দক্ষিণে যাওয়া হল শোনমুডা বা শোন নদীর উত্সমুখ দেখতে । এটিকে অমরকন্টকের স্বর্গ বলা হয় । ব্রহ্মার বরপুত্র শোন । রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গিয়ে দেখা গেল একটি হনুমান মন্দিরের গায়ে শোনমুডা বা শোন নদীর উত্পত্তিস্থল । এখান থেকে অতি শীর্ণকায় শোন পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা এগিয়ে তারপর প্রেসিপিসের ওপর দিয়ে পাহাড় থেকে লাফ মেরে নীচের উপত্যকায় জলপ্রপাত হয়ে ঝরে পড়ে বেরিয়ে চলে গেছে উত্তর দিকে সুদূর গঙ্গার সাথে মিলিত হবার জন্য । আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে দুটি বড় নদী এত নিকটবর্তী স্থান থেকে উত্সারিত হয়ে দুটি দুদিকে বয়ে চলে গেছে । নর্মদা আরব্যসাগরের দিকে আর শোন উত্তরদিকে গঙ্গার মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে । প্রকৃতির এই ভৌগোলিক খেয়ালকে পুরাণে এক বেদনাদায়ক কাহিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা আছে । সেখানে বলা হয় নর্মদার সাথে শোনের বিবাহ নাকি কোনো কারণে বাঞ্চাল হয়ে যায় । আজীবনকাল এইভাবে নর্মদা ও শোন একে অপরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে ।
ছোটবেলা থেকে যে মান্ধাতার কথা আমরা শুনে আসছি সেই পৌরাণিক সূর্যবংশীয় রাজা মান্ধাতা আনুমানিক ৬০০০ বছর পূর্বে অমরকন্টকের নিকটবর্তী ঋক পর্বতের গায়ে রাজত্ব করতেন । এও শোনা যায় যে মান্ধাতার পুত্র পুরুকুত্সার রাণী নদী নর্মদার নামকরণ করেছিলেন । তবে ইতিহাসে এর কোনো উল্লেখ নেই । 
আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার, ২৬শে মে ২০১২, ওয়ানস্টপ ভ্রমণ

Friday, February 15, 2013

একটি প্রাগৈতিহাসিক চিঠি, ভীমবেটকার গুহা থেকে...


সেই গুহায় থাকত একদল আদিম মানুষ । সে প্রায় আন্দাজ দু'লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কোনো এক জায়গায় কোনোও এক বানর জাতীয় প্রাণী চতুষ্পদের কুব্জতা ছেড়ে দুপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মানব জাতিতে তাদের উত্তরণ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল।
সেই দ্বিপদ মানুষ আফ্রিকা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ছড়িয়ে পড়ে অধুনা ইউরোপ, এশিয়া এবং আমেরিকার দিকে । হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট থেকে জানা যায় যে এই জাতির একটি শাখা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে ভারতবর্ষের মাঝখান দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়া অতিক্রম করে আলাস্কার মধ্যে দিয়ে আমেরিকা প্রবেশ করে । কল্পনা করতে অসুবিধা হবেনা যদি আমরা ভাবি যে এই শাখার জনা কয়েক সদস্য ভারতবর্ষ অতিক্রম করার সময় বিন্ধ্য পর্বতের নিকটবর্তী অধুনা "ভীমবেটকা" নামক স্থানে কিছু অসাধারণ গুহা দেখে থমকে গিয়েছিল । তারা ভেবেছিল থাক আর সুদূর আমেরিকায় না গিয়ে ঐ স্থানেই ঘর-গেরস্থালি পাতা যাক । ১ লক্ষ বছর আগে থেমে যাওয়া জনৈক আদিম মানবের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের প্রথম জনপদ না হলেও শৈলাশ্রয় বা যাকে বলে রক-শেলটার । প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই ১লক্ষ বছরকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন : নিম্নপ্যালিওলিথিক যুগ ( ১০০০০০ - ৪০০০০ বছর ), মধ্য প্যালিওলিথিক যুগ ( ৪০০০০-২০০০০ বছর) , উচ্চ প্যালিওলিথিক (২০০০০-১০০০০ বছর) এবং মেসোলিথিক যুগ ( ১০০০০-২৫০০ বছর)


মেসোলিথিক যুগ আমাদের পৌঁছে দেয় আমাদের অতি পরিচিত ঐতিহাসিক যুগে। যার খবর আমরা ইতিহাসের পাতায় অনেক পড়েছি। কিন্তু আজকের কাহিনী পাঠককে পৌঁছে দেবে সেই আক্ষরিক অর্থের প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে যখন প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক যুগের সন্ধিক্ষণে যখন মানুষ প্রথমবার আহার, আশ্রয় এবং মৈথুন এর চিন্তা অতিক্রম করে সৃজনশীলতার বাতায়নে ভাসিয়ে দিল তার গা । ভাষার সফিষ্টিকেশন হয়ত তখনো হয়নি কিন্তু ক্ষুন্নিবৃত্তির অবকাশে সে তার মনের কথা দেওয়াল লিখনে রূপান্তরিত করে নিজের পারিপার্শ্বিক জনজীবনের ও দৈনন্দিন কর্মজীবনের একটা রেখাচিত্র ফুটিয়ে তুলল যা আজকে দশ হাজার বছর পরেও আমরা জানতে পারি ভীমবেটকার বিখ্যাত গুহাচিত্র বা রক-আর্ট রূপে ।

ভারতবর্ষের মানবসভ্যতার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ১৯৫৭-১৯৫৮ এ কে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন ডাঃ ভি এস ওয়াকাঙ্কার । প্রায় ৪০০টি চিত্রাঙ্কিত গুহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভীমবেটকার গভীর জঙ্গলে । এবং এই শৈলাশ্রয়গুলিকে এর প্রাচীনত্ব এবং মানব ইতিহাসে এর তাত্পর্য স্বীকার করে UNESCO তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ তো হল তত্ত্বকথা । আশ্চর্য বিষয় এই যে আজো একবিংশ শতাব্দীতে বিশাল এই গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে এবং গুহার দেওয়ালের চিত্রগুলি দেখলে মনে হয় আমরা আবার ফিরে গেছি সেই ১০০০০বছর পূর্বে যখন গৃহস্বামী শিকার করে কুলায় ফিরেছেন এবং "গৃহবধূ"সেই শিকারের মাংস আগুণে ঝলসাচ্ছেন ও অন্য কেউ হয়ত সেই অবকাশে গুহার দেওয়ালে মেলে ধরছে তার সৃজনশীলতা। স্থান মাহাত্ম্যের দাপটে গায়ে কাঁটা দেয় ।

পেশাদারি প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ভীমবেটকায় পাওয়া পাথরের অস্ত্র, প্রাগ্‌ঐতিহাসিক কঙ্কাল, ভস্মচূর্ণ এবং মৃত্পাত্রের টুকরো নিয়ে অনেক গবেষণা করে ১লক্ষ বছরের কাহিনী তৈরী করেছেন । কিন্তু আমাদের মত আপামর জনসাধারণের কাছে ভীমবেটকার মাহাত্ম্য হল তার গুহার দেওয়াল চিত্রণ। এখনো যা ঐতিহ্যের সাথে বর্তমান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । সময়ের দলিল বলছে যা পুরাতন । কালের স্রোত যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি । মুছে যায়নি সেই সব গুহাচিত্রের রং । অজানা কোন রঙে তুলি ডুবিয়ে আঁকা সেই গুহারা । আজকের মোটিফ রূপে যা পাঞ্জাবী, শাড়িতে আমরাও দেখি সেই লোকচিত্রের সারল্য নিয়ে স্বমহিমায় ভীমবেটকার গুহাচিত্রেরা অমলিন। যে গুহাচিত্রগুলি এখনো বর্তমান সেগুলির কাল নির্ণয় করে দেখা যায় যে সম্ভবতঃ ৯ হাজার বছর (মেসোলিথিক যুগ)থেকে ২৫০০বছর আগে অবধি এইগুলি আঁকা হয়েছিল । অতএব এই গুহাচিত্রগুলি ভারতবর্ষের মানব সভ্যতার ৬৫০০ বছরের দলিল । এই সাড়ে ৬ হাজার বছরের মানবজাতির যা চিন্তার পরিবর্তন হয়েছিল চিত্র অঙ্কনের প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছিল এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল তারও নজির রয়ে গেছে ভীমবেটকার এই দেওয়ালে । ছবির বিষয়বস্তু প্রথমে ছিল পশুপাখীর । পরে তার সাথে জুড়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুর অবয়ব । তার ও পরে পশুর সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ, পশুর পিঠে মানুষের আরোহণ ইত্যাদি । আবারো দেখা গেল কিছু তদানীন্তন সামাজিক পটভূমি । ঘোড়ায় চড়া ও মাথায় ছাতা নেওয়া রাজার ছবির অপূর্ব চিত্র যা এখনো নজর কাড়ে । এছাড়াও রয়েছে জ্যামিতিক নকশাচিত্র এর থেকে বোঝা যায় যে কালের আবর্তনে সমাজ কিভাবে পাল্টে গেছে ।

কিছু কিছু ছবিতে শিকারের দৃশ্য ও নৃত্যরত মানব মানবীর দেহ লক্ষ্য করা গেল । মজার ব্যাপার হল এই মানব মানবীর আঁকার ধরণটির সাথে এখনকার সাঁওতাল ও তফশিলী উপজাতির পুজোর সময় গৃহ অলঙ্করণের দেওয়াল চিত্রের বেশ ভালরকম মিল পাওয়া যায় । ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন এই ভীমবেটকা । সাড়ে ছ'হাজার বছরের বিবর্তনে ছবির বিষয়বস্তু যেমন বদলে গেছে ঠিক তেমনি পাল্টেছে ছবি আঁকার পদ্ধতি, ব্যবহৃত রঙ ও সরঞ্জাম। ভীমবেটকার গুহাচিত্রে তিন ধরণের ছবি দেখা গেল । যা এখনকার ভাষায় জল রং, তেল রঙ এবং শুকনো মোম রং। বেশীর ভাগ ছবি সাদা ও লাল রঙে আঁকা । কিন্তু কিছু কিছু সবুজ, কমলা, হলদে ও বেগুণী । এই সব রং, রঙ করার পদ্ধতি এবং ছবির বিষয়বস্তু দিয়ে ভারতের যে ইতিহাস ফুটে ওঠে তাতে একটি অসাধারণ ইঙ্গিত আছে । সম্ভাব্য ৫০০০ বছরের পূর্বে কোনো ছবিতে ঘোড়া জাতীয় কোনো পশু দেখা যায় না । এই থেকে মনে হয় যে ৫০০০ বছর আগে যখন আর্য সভ্যতা ভারতে প্রবেশ করে সেই সময় থেকেই দেশে ঘোড়া আমদানী হয় ।
মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের ৪৫ কিমি উত্তর পূর্বে ও হোসাঙ্গাবাদের ৩০ কিমি উত্তর পশ্চিমে, ওবাইদুলাগঞ্জ-ইটার্সি হাইওয়ের ( NH 69)ধারে ভীমবেটকার বিশাল জঙ্গল। দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপকণ্ঠে, বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমানার গা ঘেঁষে, মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার রাতাপানি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংক্চুয়ারির মধ্যে, একটি রুক্ষ এবং নীচু পাহাড়ী অঞ্চল জুড়ে ভীমবেটকার ব্যাপ্তি। ভীমবেটকার পর্ণমোচী (ডেসিডুয়াস) জঙ্গলমহল পাহাড় প্রকৃতির রুক্ষতাকে ঢেকে দিয়েছে অনেকটাই । ভীমবেটকার গা ঘেঁষে ভিয়ানপুর গ্রাম। ভীমবেটকার পাহাড়গুলি সমুদ্র লেভেলের ৬০০ মিটার উঁচুতে ।
নিঝুম সন্ধ্যায় বনমোরগ, কোয়েল, হুপো, শালিখ আর মাছরাঙারা দলে দলে এসে আশ্রয় নেয় ভীমবেটকার গুহার মধ্যে । পাইথন, কোবরা ও আপনমনে ঘোরে হেথায় হোথায় । মেঘ ডাকলে ময়ূর পেখম তুলে ময়ূরীর সাথে শৃঙ্গারের বার্তা পৌঁছে দেয় । আছে শ্লথ বেয়ার, হায়না, নীলগাই, চিতল হরিণ আর সজারু । গ্রামের মানুষ আর পশুপাখীর জন্য আছে বেতোয়া আর নর্মদা নদীর জল । মিডিয়াম আকৃতির দানা দানা স্যান্ড স্টোনের এই পাহাড় গুলির অনেকটাই মেটামরফোসিস হয়ে অর্থকোয়ারজাইট পাথরে রূপান্তরিত হওয়ায় দুধ সাদা রঙে হালকা গোলাপী ছোঁয়া এসেছে । ভীমবেটকার ঘন জঙ্গল সংলগ্ন উপত্যকায় ঘন জঙ্গলে বসন্তে পলাশের আগুন জ্বলে । মহুয়া ফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করে । এত প্রত্যন্ত পরিবেশে পশুপাখী, ডেসিডুয়াস বৃক্ষরাজি আর পাহাড়মাটির এই একাত্ম ইকোসিস্টেম ভীমবেটকার পরিবেশকে একটা অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে । প্রকৃতির খেয়ালে পাহাড় যেন কথা বলে ওঠে এখানে । এক একটি পাহাড়ের আকৃতি এক একরকম । সয়েল ইরোশানের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এগুলি । প্রাগ ঐতিহাসিক যুগে যখন মানুষ ছিলনা তখন এই পাহাড় ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি । তখন জলের খরস্রোতে তৈরী হয়েছিল গুহাগুলি । এবং কালের আবর্তনে সেই পাহাড় যখন সমুদ্র থেকে উঠে হিন্দুস্তানের মধ্যিখানে পৌঁছে যায় তখন আদিম মানুষ সেই গুহা আবিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করে আর আপনমনে মেলে ধরে তাদের সৃজনশীলতা যার ফলস্বরূপ আজো আমরা দেখতে পাই এই গুহাচিত্রগুলি। কোনোটি রচনা করেছে গুহার মধ্যে অডিটোরিয়ামের মত নিস্তব্ধ এম্বিয়েন্স । একখানা পাহাড় বিশাল কচ্ছপের মত আকৃতি নিয়ে মহাস্থবির জাতকের মত আবহমান কাল ধরে পাহাড়ের মাথায় বসে সব কিছু দেখে চলেছে । সৃষ্টি হয়েছে মাশরুমের মত একখানা দৈত্যাকার পাহাড় । এমন কত যে আকৃতি তা দেখে শেষ করা যায় না । কিন্তু সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হল গুহাচিত্র । বিশাল একখানা জু-রক রয়েছে যার ভেতরে আপন খেয়ালে বহু যুগ ধরে বহু মানুষ এঁকে গেছে একপাল পশুর রেখাচিত্র । কোনো ছবিতে ঘোড়সওয়ার নিয়ে চলেছে একপাল যোদ্ধা । কোনোটিতে কেউ এঁকে রেখেছে ১৯খানা মোষের প্রতিকৃতি। কোথাও আবার হাতীর পাল কিম্বা ছুটন্ত হরিণের সার । কেউ এঁকে রেখে গেছে ঘোড়ার পিঠে বাজনদার এবং নৃত্যরত মানুষ। কোনটিতে রাখাল বালক একপাল গবাদি পশুকে সামলাচ্ছে । এইভাবে জল, আর হাওয়ার দাপটে যুগ যুগ ধরে ভীমবেটকার গুহা গুলি বাঁচিয়ে রেখেছে এই দুষ্প্রাপ্য গুহাচিত্রগুলিকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাকে ছুঁতে পারেনি এবং ভ্যান্ডালিজম যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি ।


কথিত আছে পঞ্চপান্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় এইখানে বাস করেছিলেন । আর ভীমবেটকার সংলগ্ন লাক্ষাজুহার জঙ্গলে পান্ডবদের দুর্যোধন পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে লাক্ষা নির্মিত গৃহ সকৌশলে নির্মাণ করেন । মহাভারত ছিল এবং থাকবে । আজ এই কিংবদন্তী সত্য কি মিথ্যা তা আমরা যাচাই করার কেউ ন‌ই । আমাদের কাছে বহু প্রাচীন এবং প্রাগঐতিহাসিক ভারতের রূপরেখা নিয়ে ভীমবেটকা অতীতের সব ঝড়ঝাপটা সামলেও স্বমহিমায় বর্তমান ।




আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১২