Sunday, July 21, 2013

মইস্যার মনসার থানে

নদীমাতৃক দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বৃহত জেলা মেদিনীপুর । সেখানে যেমন আছে নদীর জলে পুষ্ট সবুজ গভীর জঙ্গল ঠিক তেমনি আছে ঐ জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে অগুন্তি সরীসৃপের পরিবার । ছোট বড় নদীর জল , ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা এই সরীসৃপদের মধ্যে বাংলার বিখ্যাত সব সাপেরা গড়ে তুলেছে এক সুন্দর ইকোসিস্টেম । তাদের খুব পছন্দের জায়গা পশ্চিমবাংলার এই স্থানটি । ঘন জঙ্গলের মধ্যে সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, বানভাসি শ্রাবণ-ভাদ্রের থৈ থৈ নদীর দুকুল ছাপিয়ে জল ও চলে আসে সেই জঙ্গলে আর মনের সুখে দিন যাপন করে শঙ্খচূড়, কালনাগিনী, গোখরো, খরিস, চন্দ্রবোড়া সমেত আরো নানা অজানা সাপেরা । এদিকে এই বিশাল জেলায় আছে অঢেল চাষযোগ্য জমি । তাই কৃষকেরা রোজ মা মনসাকে স্মরণ করে ক্ষেতে যায় চাষ করতে । শীতে একটু আরাম । সাপেরা তখন হাইবারনেট করে, গর্তের নীচে শীতঘুম দেয় কিন্তু প্রচন্ড গরমের দাবদাহে বাইরে চলে আসে । বর্ষায় দেখায় উদ্দাম নৃত্য। চাষীবৌ কুঁড়ের ধারে পথ চেয়ে বসে ভাবে স্বামীর কথা । বর্ষার হাঁটুজলে ধানচারা লাগাতে গিয়ে যদি সাপে কাটে তার স্বামীকে ।
সে জানে সাপকে নাকি জ্বালাতন না করলে সে কিচ্ছু করেনা কিন্তু তার ল্যাজে পা পড়ে গেলে সে ভয়ানক রেগে যায় । আর বিষধর সাপ হলে তো আর কথাই নেই ! কৃষক যখন আর হাল দিতে পারেনা বৌ তার চেলেমেয়েকে নিয়ে মাঠে যায় । গিয়ে আবার ঐ এক চিন্তা ঘোরে মাথার মধ্যে । সেবার সাপে কেটেছিল গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলেকে । ঝাড়ফুঁক করল ওঝা এসে । আয়ুর্বেদিক ডাক্তার এসে বিষ বের করে ওষুধ লাগিয়ে দিল । অনেক কষ্টে মা মনসার দয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গেল ছেলেটা । সন্ধ্যেবেলা কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে মেয়েরা মনসার ভাসান গীত গাইল । এইভাবে কাটে সব চাষীদের জীবন । ওরা ধান বোনে আমাদের জন্য কিন্তু সেই ধান বোনার পেছনে কত ভয় মেশানো কাহিনী থাকে তা তো আমরা জানিওনা । সেবার ধানের গোলায় সাপ ঢুকে সে কি বিপত্তি । আরেকবার মাটির ঘরের চালে লাউয়ের মাচা থেকে লাউ আনতে গিয়ে একটা সবুজ লাউডগা তো বাচ্চা একটা চাষীবৌয়ের হাতে জড়িয়ে সে কি কান্ড! মেয়েটা তো ভয়েই অজ্ঞান । ভাগ্যি লাউডগা সাপের বিষ নেই ! একটু বেশি বৃষ্টি হলে ঘর-উঠোন যখন জলে জলময় হয় তখন দু-একটা জলঢোঁড়া ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে । মাটির ঘরে না আছে ইলেকট্রিক না আছে পাকা ছাদ । বেশি বৃষ্টি হলে দু'একটা চিতি সাপকে চুপচাপ মশারীর দড়ির সাথে জড়িয়েও থাকতে দেখেছে ওরা । খোলস ছেড়ে সাপেরা যখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন কত বিচিত্র রংয়ের খোলস দেখে গ্রামের লোকে । আবার সেই ভয় মনের মধ্যে পুষে রেখে দিনের পর দিন বুক বেঁধে কাটায় ওরা !
অথচ সাপের ভয় থাকলে কি হবে এই মেদিনীপুরই ছিল ভারতের ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনের মুখ্য কেন্দ্র । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম বসুর মত মানুষের জন্মস্থান এই মেদিনীপুর । কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, শিলাবতী প্রভৃতি নদীর জলে পুষ্ট, ধনধান্য-পুষ্প-ভরা এই জেলার মাটি । কুরুম্ভেরা, গোপগড়, কর্ণাগড়, ময়নাগড়, বর্গভীমা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী, পাথরার মত মন্দিরময় । ঝাড়গ্রামের মত স্বাস্থ্যকর ট্যুরিষ্ট স্পট আছে এখানে । পূর্ব মেদিনীপুরে আছে দীঘার সমুদ্র সৈকত । বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আরো আরো ট্যুরিষ্ট কেন্দ্র হয়েছে তাজপুর, মন্দারমণি আর চন্দনেশ্বরে ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জকপুরের কাছে এমন এক জঙ্গল আছে যাকে গ্রামের মানুষেরা মনসার জঙ্গল বলে । ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ পাশে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তারিত এক গভীর খাল ছিল । বর্ষার সময় অতিবৃষ্টিতে ঐ খাল দিয়ে খড়গপুর সহ পশ্চিমের উঁচু জায়গায় বৃষ্টির জল হৈ হৈ করে বয়ে যেত পুব দিকে আর বন্যার আকারে জমেই থাকত সেখানে । শরতের কাশফুলের রমরমায় খালপাড় তখন মেতে উঠত পুজোর আনন্দে । এখানকার কৃষকেরা মনের আনন্দে ধানচাষ করে আরভাদু পরব উদ্‌যাপন করে মনের আনন্দে কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটু অশান্তি সর্বক্ষণের ...ঐ সর্পকুলে বসবাসের জন্য । মা মনসাকে সর্বদা স্মরনে-মননে রাখে । শ্রাবণ-ভাদ্রের শনি-মঙ্গলবারে মনসার পুজো দেয় । শুধু সাপের কারণেই নয় মনসাকে তারা কৃষিদেবী রূপেও মানে । তাদের রুজি-রোজগার, সম্বচ্ছরের খোরাকি সব ঐ ধান চাষকে ঘিরে । পর্যাপ্ত বর্ষায় প্রচুর ধানে মাঠঘাট যাতে সবুজে ভরে ওঠে, তাই সমস্ত চাষীরা একজোট হয়ে ঐ জঙ্গলের কোনো এক ধারে মা মনসার আরাধনা করে চলে বছরের পর বছর ধরে । পাকা ধান তোলার সময় প্রত্যেকে এক আঁটি করে পাকা ধান মাথায় করে মা মনসার থানে রেখে এসে মা'কে মিনতি জানায়: "মা গো, আমরা ছাপোষা মানুষ, দিন আনি দিন খাই, পেটের দায়ে চাষ করছি, আমাদের অপরাধ মার্জনা কোরো, সম্বচ্ছর সন্তানদের দুধেভাতে রেখো, পরের বছর যেন আবার চাষ করে তোমাকে ফসল দিয়ে পুজো দিতে পারি মা "
প্রায় চারশো বছর আগে জকপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায় একদিন ভোর রাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পেলেন । তিনি স্পষ্ট দেখেন, চতুর্ভুজা মা মনসা হাত নেড়ে নেড়ে তাকে বলছেন, ঐ জঙ্গলেই মা আছেন । জমিদার যেন মায়ের পুজোর প্রচার করেন ।
ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে জমিদার কাঁপতে কাঁপতে ঘটি ঘটি জল খেয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে জমিদার বাড়িতে যে যেখানে ছিল হাজির হয়ে যায় । ঐ জঙ্গলের সাপের কথা সকলের জানা । মা মনসার থান বলে জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ । একথা সকলে প্রত্যক্ষ করেছে । সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর আদেশ দেন । ক্রমে কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে কিছুটা সাফ করে ফেলে । মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হতে থাকে । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে । উইঢিপিটিকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় । পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয় উইঢিপির মাটি দিয়ে । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে মনসার থানকে মর্যাদা দেন জমিদার যোগেশ্বর রায় । নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় সেখানে । যেমন করে আমরাও পুজো করলাম ফুল, দুধ আর কলা কিনে । উইঢিপির ওপরেই দিধ ঢেলে সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করা হল মা মনসা কে । ইচ্ছামত যা খুশি দাও । না দিলেও কেউ কিছু বলবেনা । পান্ডা বা পূজারীরও উপদ্রব নেই ।
বর্তমানে যে স্থানে মায়ের পুজো হয় সেই স্থানে আমরা গেছিলাম খড়গপুর থেকে ।
খড়গপুর থেকে NH-2 ধরে কোলকাতার দিকে গিয়ে জকপুর রেলষ্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ডুবগোহাল স্কুলের পাশ দিয়ে ম‌ইশ্যা গ্রামের ভিতর দিয়ে মনসা মন্দিরে যাওয়া যায় । খড়গপুর স্টশন থেকে লোকাল ট্রেনে জকপুর বা মাদপুর স্টেশনে নেমে ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়িতে মন্দিরে যাওয়া যায় । কোলকাতা বা হাওড়া থেকে লোকালে মাদপুর বা জকপুর নেমে এক‌ইভাবে মন্দিরে আসতে হয় ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সে এক এডভেঞ্চার! আমাদের হাতে গুগ্‌লম্যাপ । আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গ্রামের সরু মেঠো লাল রাস্তার মধ্যে দিয়ে হঠাত আবিষ্কার করলাম ম‌ইশ্যা । গাড়ির কাঁচ নামাতেই বনফুলের সোঁদা গন্ধ নাকে এল । আর পাখপাখালির কিচিরমিচির । কোথাও একটু ধানজমি কোথাও আবার সর্ষে ক্ষেতের হলুদ । সজনেফুলের গন্ধ বাতাস চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে । আমগাছে মুকুল এসেছে সবে । কুঁড়ে ঘরের লাগোয়া একফালি জমিতে কত কত আলু, ফুলকপি, টমেটো ! কি ভলো লাগে আমার এসব তারিয়ে তারিয়ে দেখতে ! সেই জমিদারের আমল থেকে ঐ মনসা থানে মা বিষহরির পুজো হয়ে আসছে । খোলা অকাশের নীচে ঐ উইঢিপির কুন্ডলী ও পদ্মফুলে সারা বছর ধরে পুণ্যার্থীরা ফুল চড়াতে আসেন শুধু কৃষির জন্য এবং সাপের দংশনে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই জন্য । কথায় বলে "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর" তাই প্রতিবছর চৈত্রমাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে এখানে মনসামায়ের মহাপূজা আর মেলা হয় । নিজের হাতে পুজো দেন দলে দলে পুণ্যার্থী । পশ্চিমবাংলায় গঙ্গাসাগরের মেলার পর এটি দ্বিতীয় বড় জনসমাগমের মেলা । সেই জমিদারের আমলে এই পুজোর রমরমা শুরু হতে থাকে । তারপর বৃটিশ সরকার মাদপুর থেকে জকপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করে। মায়ের থানে দাঁড়িয়ে রেললাইন এবং অনবরত ট্রেন যাওয়া আসা দেখা যায় । মন যেন হারিয়ে যায় কোথায় । সেই ট্রেনের বাঁশী আর মন্দিরের স্থান-মাহাত্ম্য মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় এক আকাশের নীচে ।
স্থানীয় মানুষ বৃটিশদের অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়ে মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিল । সাহেবরা হেসে কুটিপাটি ! সেই কথা শুনে বলেছিল "হিন্দুডের ওয়াটার, স্কাই, ফায়ার, এসবের ডেব্‌টা আঠে । বাট্‌ স্নেকের ডেব্‌টা! হোয়াট ইজ দিস?" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে । মানুষেরা সাহেবকে অনেক ভয় দেখাল এবং সম্মিলিত হয়ে বাধা দিল। তাদের বাধা তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার বাইরে থেকে আনা শ্রমিক দিয়ে বাহুবলের দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে অতঃপর সেই বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এসে ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন লাগিয়ে দিল জঙ্গলে । সর্পকুল বিনষ্ট হবে এই আশায় । কিন্তু বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেল তারা । তারপর জমিদার প্রজাদের সঙ্গে করে জঙ্গলের মধ্যে সরু রাস্তা কাটিয়ে অনায়াস যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আবার সশরীরে ফিরে এলেন প্রজাদের নিয়ে । মা মনসা নিজের মন্দিরে প্রবেশের পথ এইভাবে করে দিলেন । 

মেদিনীপুর সহ সমগ্র দক্ষিণবাংলার মানুষ পুত্রলাভের আশায়, বেকারের চাকুরীর আশায়, হারানো গরুর খোঁজে, মারণ ব্যাধির নিরাময়ে মায়ের থানে মানত করে যায় । মেলা ও মহাপুজোর দিন নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুজো কমিটি । স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, দুঃস্থ ছাত্রদের পুস্তকদানের মত উন্নয়ন মূলক কাজও করে থাকে এই পুজো কমিটি ।


ছোটদের ই-পত্রিকা ইচ্ছামতী গ্রীষ্মসংখ্যা ২০১৩ তে প্রকাশিত  


ময়নাগড় অভিযান



খড়গপুর থেকে ডেবরা হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের দিকে । কোলাঘাট অবধি ন্যশানাল হাইওয়ে ৬ ধরে সোজা চলেছিলাম শীতের ছুটির সকালে । তারপর গাড়ি থামিয়ে স্মার্টফোনের গুগ্‌ল ম্যাপ বাকী পথের দিশা দেখাল । কোলাঘাট থেকে হলদিয়ার পথ ধরলাম এবার । কাগগেচ্ছা গ্রাম হয়ে নিমতৌড়ি । সেখানে গিয়ে স্থানীয় পুছতাছ । বুঝলাম ময়নাগড় এসে গেছে । এতক্ষণ চলছিল হাইওয়ের ধারে হলুদ সর্ষে ক্ষেত, জলে ডোবা ধানক্ষেতে গুছগুচ্ছ ধানচারার ওপর মাঘের রোদ-কণার লুটোপুটি । এবার গ্রামের কুঁড়ের লাগোয়া সজনে ফুলের গন্ধে মম করা বাতাস, বাঁশঝাড় আর চিংড়ির আড়ত । খড়ের ছায়ার ঘেরা পানের বরজ ।


একটা নদীর ব্রিজ পেরোতেই লেখা স্বাগতম ১০০০ বছরের পুরোণো ময়নাগড়ে । গ্রামের নাম গড়সাফাত । মাঠের ওপর বিদ্যাসাগর পাঠাগারের সামনে গাড়ি রেখে এবার অভিযান ময়নাগড় ।


রাজবাড়ির বিশাল গেটের ওপরে লেখা রয়েছে ইতিবৃত্ত । ধর্মমঙ্গল কাব্যগ্রন্থে ময়নাচৌড়া বা ময়নাগড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়|

 রাঢ়বঙ্গের মহাকাব্য এই ধর্মমঙ্গলের প্রধান নায়ক ছিলেন রাজা লাউসেন। ইনি ছিলেন ময়নাগড়ের ধর্মরাজের প্রতিষ্ঠাতা । হিন্দুধর্মের তন্ত্রবিদ্যা এবং মহাযানী বৌদ্ধদের মতবাদের পাশাপাশি মুসলমান ধর্মের এক সুন্দর সমন্বয় ঘটেছিল এই অঞ্চলে । ময়নাগড় এই কিংবদন্তী পালরাজা লাউসেন নির্মিত গড় বা কেল্লার জন্য এককালে প্রসিদ্ধ ছিল । এখন সেই কেল্লার অবস্থান কেবলমাত্র ইতিহাসের পাতায় । এরপর অনেক জল গড়িয়েছে । পলাশীর যুদ্ধের পর ওয়ারেন হেষ্টিংসের আক্রমণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ময়নাগড় । কিন্তু এই ধর্মরাজ্য স্থানান্তরিত হয়নি । কংসাবতী নদীর মধ্যে দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ এই নয়নাভিরাম ময়নাগড় । এমনকি মধ্যযুগে মারাঠাদস্যু বর্গীর আক্রমণেও প্রাচীনতম দুর্গটির ক্ষতি হয়নি । ময়ানাগড়ের বৈশিষ্ট্য হল শান্ত পরিবেশের মধ্যে গাছগাছলি ঘেরা বিশাল নদীর পাড় । নারকেল গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে হেঁটে বুঝলাম ওপারে অপূর্ব একটি মন্দির রয়েছে ।

কিন্তু সেখানে পৌঁছাব কি করে ? তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর । নদীর ঘাটে দু একটা ডিঙি নৌকো বাঁধা কিন্তু মাঝি নেই একটাও । একটা বুড়ি নদীর জলে কি যেন ধুচ্ছিল তাকে শুধালাম । সে বাড়ি গিয়ে তার কোন এক আত্মীয়কে ডেকে দিল । সেই ছেলেটি আমাদের ডিঙিনৌকো করে ওপারে পৌঁছে দিল । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি । রাজবাড়ীর প্রকান্ড ধ্বংসাবশেষের বারমহল পেরিয়ে চলেছি আমরা মন্দিরমহলে । প্রথমে তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে রাধাকৃষ্ণ মন্দির । অপূর্ব বিগ্রহ । নিত্য পুজোপাঠ হয় । সকাল সকাল এসে বলে রাখলে ভোগপ্রসাদও পাওয়া যায় । মন্দিরের একপাশে সতীরাণীর ঘাট । ফলপাকড়ের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা মুগ্ধ করে । সেখান থেকে শিবমন্দির । টেরাকোটার অপূর্ব কাজ মন্দিরের গায় । ভেতরে স্বয়ংভূ শিবলিঙ্গ পাতাল থেকে প্রোথিত আর রংকিনীদেবীর বিগ্রহ যিনি এখানে ভদ্রকালী রূপে পূজিতা । মহাদেবের নাম লোকেশ্বর । মন্দিরের বাইরে একটি পাথরের নততলে গাঁথা রয়েছে সূর্যশঙ্খ । সূর্যের পুজো করার জন্য এই শাঁখে জল দেওয়া হত পূর্বে ।


কার্তিকমাসে রাশ পূর্ণিমার সময় এখানে সবচেয়ে বেশী ভীড় হয় । পাশের আরেকটি দ্বীপে নৌকায় করে দলবল নিয়ে রাধাকৃষ্ণ রাসলীলায় সামিল হন আর রাসমঞ্চে হাজির হন । প্রতিবছর রং, ধোয়া মাজার কারণে রাসমঞ্চটি বেশ ঝকঝকে । তখন এখানে বিশাল মেলা হয় । নয়াগ্রাম থেকে পটশিল্পীরা এসে পটচিত্রের পসরা বসিয়ে হাতের আঁকা শিল্পকর্মের সাথে গেয়ে শোনান তাদের ঘরাণার কাব্যগান । পাথরের ও বাঁশের কাজেরও বিক্রিবাটরা চলে । আশপাশের গ্রাম থেকে লাখ দুয়েক মানুষ এসে জড়ো হন এই উত্সবে ।


রাসপূর্ণিমার সময় নৌকোগুলিকে আলো দিয়ে অসাধারণ সাজানো হয় আর সেই আলোর ছায়া কাঁসাইয়ের জলে প্রতিফলিত হয়ে এক মোহময়তার সৃষ্টি করে । সংস্কৃতি উতসব হয় তখন এই ময়নাগড়ে ।


মন্দিরের বাইরে সিংহবাহিনীর প্রতিকৃতি আর দেওয়ালে টেরাকোটার সিপাই থেকে শুরু করে ঘোড়সওয়ার, ময়ূরপঙ্খী নৌকোর নিখুঁত শিল্পকর্ম যা কালের স্রোতে কিছুটা ম্রিয়মান কিন্তু তবুও ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী ।



আমাদের নৌকোর মাঝিই আমাদের গাইড হয়ে সব একে একে ঘুরে ঘুরে দেখালো । মন্দির দুটি দেখে সে আমাদের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল । কাঁটাঝোপের মধ্যে যেতেযেতে দেখি গাছের পাতায় পাখির বিষ্ঠায় সাদা আলপনা । মাঝি শুধালো ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী সামখোল পাখি প্রতিদিন সূর্যিডোবার প্রদোষে এসে নদীর জল খায় । সেই নদীর ধারে নেমে গেলে দেখা গেল দূরে পীরবাবার জাগ্রত দরগা ।

ফেরার পথে স্থানীয় হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক ঝোল-ভাত । মেদিনীপুরের বিখ্যাত কালীবাংলা বা কালীঢল পান সহযোগে মধুরেণ সমাপয়েত হল ময়নাগড় অভিযানের উইকএন্ড ।

ছোটদের ই-পত্রিকা দিয়ালা একাদশ সংখ্যায় প্রকাশিত 

একছুট্টে রাজরপ্পা




মাঘের মিঠে রোদ পিঠে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাঁচী থেকে একটা গাড়ি নিয়ে রাজরপ্পার দিকে । রামগড় থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে আর রাঁচি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে রামগড় ও চিতোরপুর রোডের ওপরেই রাজরপ্পা । হাজারিবাগ রোড ধরে খেলগাঁও দিয়ে চলতে লাগলাম । ন্যাশানাল হাইওয়ে ৩৩ এর ওপরে ঝকঝকে সাজানো আর্মি ক্যান্টনমেন্ট "দীপাটলি" এল । ছোটনাগপুর মালভূমির সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে আমাদের চলা । বেশ মনোরম জলবায়ু আর সবুজ প্রকৃতি । কিছুপরেই এল রামগড় ঘাঁটি । একটু চড়াই আবার সামান্য উতরাই পথ দিয়ে চলতে চলতে পালামৌ, বিভূতিভূষণ মনে পড়ছিল । গাড়ির কাঁচ খুলে নাম না জানা, অচেনা ফুলের বুনো গন্ধ নিতে নিতে ভাবছিলাম অধুনা ঝাড়খন্ডের এই অংশটির কথা । বৈচিত্র্যময় ঝাড়খন্ডের এই ভূখন্ডটির সম্পদ হল পাহাড়-মাটীর স্তূপের মধ্য দিয়ে অগুন্তি ছোট-বড় নদী আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে ঝরে পড়া ঝোরার কলকলানি । সেবার গেছিলাম রাঁচি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে দশম ফলস । মনে পড়ছিল সেই কথা । কি অপূর্ব সেই রূপ ! সুবর্ণরেখা নদীর এক শাখা নদী কাঁচীর দশটি সাবলীল ধারা অবলীলায় ৪৪মিটার ওপর থেকে ঝরে পড়েছে একসাথে নীচে । এছাড়াও হুন্ড্রু, জোনহা, হিরণি, পাঁচ গাঘ ফলস, সীতা ফলস, কাঁকে ড্যাম, রাঁচি লেক ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশটি ঘিরে যেন এক ন্যাচারাল নবরত্নের মালা গেঁথে সাজিয়ে রেখেছে নিঁখুত ভাবে । আর সাঁওতাল মানুষের জীবনযাপন, ধামসা-মাদল, অনবরত ঝরে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল ভুর্জ্যপত্রের ওপর লিখে রেখে যায় কত সময়ের দলিল। বছরের পর বছর ধরে যা পুরোণো হয়না । মহুয়ার ঝিম ধরা নেশার মত সেই গল্প উঠে আসে বারবার কত লেখকের কলমে, বীরসা মুন্ডার জীবন যুদ্ধে ।

এখানকার সবচেয়ে বড় নদী দামোদর । রাঁচি ও হাজারিবাগ মালভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের আরেক নদী ভৈরবী বা ভেরার সাথে মিলিত হয়েছে দামোদর আর সেই সঙ্গমেই রাজরপ্পা জলপ্রপাত । প্রায় ৯ মিটার উঁচু থেকে ভেরা নদীর অবিরত ধারা ঝরেছে দামোদরের বুকে । রাজরপ্পা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যই নয় ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমস্তিকার মন্দিরের জন্যও যথেষ্ট বিখ্যাত । সতীর দেহ ত্যাগের পর মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সতীর মস্তকটি না কি এখানে পড়েছিল তাই দশমহাবিদ্যার অন্যতম ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দিরটি একান্ন সতীপিঠের একটি বলে অনেকেই দাবী করেন । সতীপিঠ হোক বা না হোক গাড়ি নীচে রেখে সামান্য চড়াই পাহাড়ী পথ ধরে মন্দিরের দিকে এগুতে লাগলাম আর কেমন যেন একটা এথান মাহাত্ম্য অনুভূত হল । বহুদিন আগে যখন এই রাস্তা হয়নি তখন নদী পেরিয়ে মন্দিরে আসতে হোত । এখন রাজরপ্পা বেশ অনেকটাই আধুনিক এবং ভেতরে প্রবেশ করে দেখি কঙ্ক্রিটের বাহুল্যে কিছুটা হলেও কৃত্রিম । তবে মা ছিন্নমস্তার মন্দির এবং রাজরপ্পা জলপ্রপাতটি ভুলিয়ে দেয় সবকিছু । ছিন্নমস্তার মন্দির বড় একটা দেখা যায়না তাই আমার এত আগ্রহ ছিল । অনেকটা কামাখ্যা মন্দিরের ঢঙে নির্মিত মূল মন্দিরটি । আর এই মন্দিরকে ঘিরে কালীর দশ মহাবিদ্যা রূপের অন্য গুলি অর্থাত তারা, কমলা, বগলা, ভৈরবী, ধূমাবতী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, মাতঙ্গী প্রভৃতির মন্দির গুলি নির্মিত হয় অনেক পরে । মন্দির চত্বরে দর্শনার্থীদের বিশাল লাইন দেখে ঘাবড়ে গেলাম । কিন্তু কিছুপরেই অতি সুন্দর নিয়ম মেনে লাইন এগুতে দেখলাম আর একসাথে জনা কুড়ি মানুষকে পুজো দিতে সম্মতি দেওয়া হয় । কোনো পান্ডার উপদ্রব নেই । আর অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পুজো দেওয়া যায় । তাই গাড়ীর ড্রাইভারকে লাইন রাখতে বলে পুজোর ডালা কিনে নিয়ে ঘুরতে গেলাম নদীর ধারে । নৌকো করে ওপারে যাচ্ছে মানুষ । আর দুই নদীর সঙ্গমে রাজরপ্পা ঝোরার কলকলানি বড়ই দৃষ্টিনন্দন ।

তখন দুপুর একটা বাজে । সারি সারি শালগাছের মাথায় দুপুরের সূর্য সজাগ । আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-এক ঘর সাঁওতাল বসতি । লাইন দিয়ে মা ছিন্নমস্তার মন্দিরে প্রবেশ করলাম এক গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে ; সিঁদুর লেপা পাথরের গায়ে খোদাই করা হয়ত মায়ের মুখ । অন্ধকারে দেখা গেলনা । তবে পুজো নিয়ে অহেতুক আড়ম্বর নেই । পূজারীর দাদাগিরিও নেই । সেটাই বেশ ভালো লাগল ।বহু দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছেন মনস্কামনা পূরণ করতে ছাগল সাথে করে । স্থানীয় সাঁওতাল মানুষেরা ছিন্নমস্তাকে অসম্ভব ভক্তি করে এবং তাদের মৃত মানুষের অস্থিভস্ম এই দামোদর নদীতে ফেলে । মন্দির থেকে নেমেই যেতে হয় কালভৈরবের কাছে । নারকোল ভেঙে জল ঢেলে শিবের প্রণাম হল । তারপর আবার দুই নদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে পেছনপথ দিয়ে তীরে উঠে গাড়ির খোঁজ করা । 


কখন যাবেন : বর্ষাকালে গেলে ওয়াটার ফলস গুলির থৈ থৈ রূপলাবণ্য দেখা যায় । এছাড়া রজরপ্পা নভেম্বর থেকে মার্চ অবধি যাওয়াই শ্রেয় । কারণ গরমের সময় প্রচন্ড দাবদাহ চলে এই অঞ্চলে ।
কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেসে রাঁচি ও সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে রাজরপ্পা যাওয়া যায় ।
কোথায় থাকবেন : রাঁচি শহরে নামী দামী অজস্র হোটেল আছে । বিশেষ ছুটিতে গেলে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভাল ।