Sunday, March 18, 2012

Chandidas

নানুর চন্ডীদাসের পিতামহের বাস্তুভিটে । অভাবের তাড়নায় কিছুকাল বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে বাস করেন তিনি । স্ত্রী পদ্মজা তাঁকে ছেড়ে নানুরের অদূরে কীর্ণাহার গ্রামে পিত্রালয়ে চলে যান । চন্ডীদাসও তখন গৃহত্যাগ করে  পদ লিখে কথকতা করে বেড়ান । মাধুকরী হয় তাঁর উপজীবিকা । দিনের শেষে স্বপাকে ফুটিয়ে নেন ভিক্ষার অন্ন । এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন রাজ দরবারে নিজের ভুর্জ্যপত্রের পুঁথিখানি খুলে বিনা প্রস্তুতিতে ঝুমর গান শুনিয়ে রাজাকে তৃপ্ত করেন । আর তখনি রাজা নানুরের বাসলী দেবীর মন্দিরে পৌরোহিত্য করার ভার দেন তাঁকে । মন প্রাণ এক করে চন্ডীদাস তখন শ্রীকৃষ্ণকথার পর পর পর্বগুলির পদ আওড়ান  মনেমনে আর সাথে সাথে লিখে ফেলতে থাকেন । আশ্রয় পান মন্দির সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘরে । এ যাবতকাল পদরচনায় যে ভাটা পড়েছিল রাজার অনুগ্রহে আশ্রয় এবং অন্নের চিন্তা করতে না হওয়ার কারণে তাঁর কাব্যচর্চার পরিস্ফূরণ হতে লাগল । একদিন ঘোর অমাবস্যাতিথির করাল অন্ধকারে স্বপ্নাদেশ পেলেন বাসলীদেবীর কাছ থেকে । তারপর তুলে নিলেন বহুদিনের অব্যবহৃত কর্ণিকাখানি । একটুকরো ভুর্জ্যপত্র প্রদীপের আলোয় ধরে পদ লিখতে শুরু করলেন । সেইথেকে আবার শুরু হয়ে যায় কাব্যচর্চা ।এখন বাসলীদেবীর মুখ মনে পড়লেই তাঁর মনে পড়ে যায় সেই রজকিনী রামীর মুখ । যেন অবিকল এক মুখশ্রী! রজকিনী রামী বাশলী মন্দিরের দেবদাসী । অপূর্ব মুখাবয়ব, বিদ্যুতলতার মত তনুশ্রী তার ।  কুয়ো থেকে প্রতিদিন সকালে জল তুলে মন্দির ঝাঁট দেয় সে । ঠাকুরের বাসনকোসন ঝকঝকে করে মাজে । মন্দিরের ভোগ নিতে এসেছিল একবেলায় ।  তখন‌ই চন্ডীদাসের সাথে আলাপ হয় তার । নানুরের অদূরে তেহাই গ্রামে সেই রজকতনয়ার বাস । পিতৃমাতৃহীনা এই রামিণির প্রতি সেই থেকেই ভালোলাগা এবং তার পরিণতি সার্থক প্রেমে।    আশ মেটেনা রামীকে দেখে । এত রূপ এত যৌবন তার কিন্তু  করেম কখনো অনীহা নেই । হাসিমুখে কাজ করে মেয়েটা । ভোরের পুবের আলোতে রামীর রূপ একরকম । চাঁদের জ্যোত্স্নায় তাকে দেখলে সর্বাঙ্গ অবশ করা এক অনুভূতি হয় ।  অমাবস্যার অন্ধকারে সেই নারীমূর্তি যেন আচ্ছন্ন করে রাখে চন্ডীদাসকে  । রামিনির যেন কৃষ্ণকলি । কালোমেয়ের এতরূপ! কাজলকালো আঁখি, নিটোল গড়নপেটন । আর চেহারায় যেন কি একটা যাদু আছে ।  চন্ডীদাস দিনে দিনে ক্রমশঃ উপলব্ধি করেন রামিনির এই রূপ রহস্য । এই মেয়েকে দেবীমূর্তির মত মনে হয় তাঁর ।  
কখনো এই নারীমূর্তিকে তাঁর মনে হয়  তাঁর বৈষ্ণব কাব্যের শ্রীরাধিকা আবার কখনো তাকে মনে হয় বাঁশুলি দেবীর প্রতিমূর্তি । একদিন রাতে স্বপ্ন দেখেন চন্ডীদাস । তীব্র কামপিপাসা জাগে শরীরে । স্ত্রী পদ্মজাকে কিছুই দিতে পারেননি তিনি । মনের দুঃখে চলে গেছে সে । বহুদিন নারীসঙ্গ বিবর্জিত একঘেয়ে জীবন তাঁর । অথচ পূর্ণ যৌবন তাকে এখনো ছেড়ে যায়নি । পদ্মজা রূপবতীও ছিলনা । তবুও তো সতীলক্ষ্মী ছিল । কিন্তু আজ তাঁর স্বপ্নে একবার আসেন রামী একবার অসেন দেবী বাঁশুলির মুখাবয়ব । কেন এমন হয়? হৃদয়ের একুল ওকুল সব উথালপাথাল । ভোর হতেই ঝাঁটা হাতে রামিণীকে দেখেই বোবার মত হতভম্ভ হয়ে যান কবি । রজকিনিকে বলেন কাছে আসতে । যেন রামির রাই-অঙ্গের ছটা লেগে শ্যাম আজ পুলকিত, বিস্মিত, শিহরিত !  দুহাত বাড়িয়ে রামীর আলগা বাহুকে ছুঁয়ে আলিঙ্গন করতে গেলেন । রজকিনী বলে উঠলেন " ও মা, ছি ছি, এ কি গোঁসাই?  একি করছেন আপনি? আজ থেকে এই মন্দিরের সব অধিকার তোমায় দিলাম ।  তুমি বাসলীদেবীর বেদীস্পর্শের, দেবীবিগ্রহকে ছোঁবার,  ভোগ নিবেদন করার সব অধিকার তোমার ।    কুন্ঠিত, লজ্জিত রামিণি মনে মনে ভাবলেন নীচুজাতের মেয়ে হয়ে আমার এ কি সৌভাগ্য হল ঠাকুর ? পাড়ার লোকে যদি একঘরে করে দেয় তার গোঁসাইকে ।  সে  পড়ল  দোটানায় । পুরুষের চোখে  যে কামের আগুন জ্বলতে দেখেছে  সে তাকে প্রকৃত ভালোবাসবে তো ? না কি কেবল তাঁর শরীরের আকর্ষণেই বারবার তার কাছে আসছে, প্রেমনিবেদন করতে ।
এই দোলাচলে সে বলেই ফেলল " না সে হয়না গোঁসাই । লোকলজ্জাকে আমি ভয় পাই । যেদিন তুমি আমাকে সত্যি সত্যি নিজের করে ভালোবাসবে সেই দিন এই শরীর আমি তোমায় দেব । আরো লেখ তুমি কবি । মনসংযোগ করো লেখায় । বয়স চলে গেলে এত সুন্দর পদ রচনায় ভাটা পড়বে । কাব্যের স্বতস্ফূরণ আর তখন হয়ত ঘটবেনা ।
 চন্ডীদাস মনে মনে বুঝলেন "এ বাসলীদেবীরই ছলাকলা ।  আরো ডাকতে হবে তাকে । আরো রচনা করতে হবে পদ । তবেই দেবী তার একান্ত আপনার হবে"  
এদিকে মনের সুখে চন্ডীদাস পদরচনা করে চলেছেন । অবসরে রামীর সাথে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটি, ভালোবাসার দীপাবলি জ্বলছে তখন রামীর মনে । চন্ডীদাসের কুঁড়ে সেই আলোয় সেজে উঠেছে ।  পুরুষপ্রকৃতি একজোটে সৃষ্টিসুখে রাধাকৃষ্ণ পদলীলায় মেতে উঠেছে ।
 এদিকে কাব্যের পান্ডুলিপি জমা পড়ে গেছে অনেকদিন ছাতনার রাজা হামিরের কাছে । কিন্তু রাজার তরফ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই । আর চন্ডীদাসের কাছে না আছে সেই পান্ডুলিপির প্রতিলিপি না আছে কোনো যোগাযোগের মাধ্যম । স্বয়ং রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে রাজার কাছ থেকে জেনে আসতে মানে লাগে তাঁর । অথচ রাজা ফেরত পাঠিয়েও দেননি সেই কাব্য সম্ভার । অতঃপর নিজেই গেলেন লাজলজ্জা সম্বরণ করে । রাজা জানালেন কাব্যের বিনিময়ে তো বহুদিন পূর্বেই  তাঁকে ভূমি, জীবিকা এবং নানাবিধ উপহারে ভূষিত করেইছেন তিনি । কিন্তু চন্ডীদাস বললেন কিন্তু আমার পুঁথিটির কি হবে? তার স্বত্ত্ব কার থাকবে ? আর কেই বা সে পুঁথির প্রচার করবে ? মানুষ জানবেনা সেই অমূল্য পদ রচনার সুললিত কাব্যমালা ? রাজা বললেন   "আপনার কাব্য সত্যি খুব সুন্দর, মন আর প্রাণ এককরে রচিত। অপূর্ব ছন্দমাধুরী পদের । কিন্তু কৃষ্ণ যে আপনার হাতে কলঙ্কিত, লম্পট  এক ব্যক্তিত্ত্ব । মূল ইতিহাসকে যা বিকৃত করে, ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে ।  চন্ডীদাস আহত হয়ে বললেন তাঁর পদসম্ভার ফিরিয়ে দিতে । রাজা বললেন " এত বড় আস্পর্ধা? ঐ পুঁথির কথা ভুলে গিয়ে নতুন পদ রচনা করুন।  অসহায় চন্ডীদাস ফিরে এলেন রিক্ত হাতে ।

স্থানঃ নানুর, বীরভূম  
কালঃ বসন্ত
সময় কালঃ বর্তমান  
চন্ডীদাস ডাক দিলেন  "রামীণী,  এই অবেলায়, হাওয়াবদলের সময় নদীর ঘাটে বসে কাপড় কাচলে যে ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার ।  দিনের আলো নিবে এল যে....
" চলো প্রিয়তমা রামীণী, আর যে সয়না বিরহ আমার, মধুর হোক আজ যামিনী ।   
সুন্দরী রামীণি  আলুলায়িত চুলের লক্‌স ভিজে হাতে পুঁছে বললে,
যাই গো যাই !  কাপড় কেচে যেটুকুনি পাই, কোনোরকমে পেট চলে, তা কি তোমার জানা নাই ?
চন্ডীদাস বললেন, সে তো ভালো করেই জানি....
আমার মত অধম স্বামী, একটিও কাব্যমালা বেচতে পারিনা আমি ।  
রামীণির ভিজে আঁচল । কাপড় কেচে কেচে পায়ে হাজা । কাপড়কাচার পাটার ওপর থেকে উজালার কৌটো, কাপড়কাচার ব্রাশ আর ডাঁইকরা সদ্য কাচা ভিজে কাপড় দেখিয়ে চন্ডীদাসকে বললে, একটু নিঙড়ে দাও বাপু, হাতের কবজিতে আর জোর পাইনে।  চলো গিয়ে মেলে দি, ঐ জামাকাপড়,  ধোবিঘাটের ঐ লাইনে । 
চন্ডীদাস আড়চোখে দ্যাখেন রামীর ঢলঢল কাঁচা যৌবন । নিজেকে মনে হয় বড় পুণ্যবাণ ।  আগের বৌ ত্যাগ দিয়েছে অভাবের জ্বালায় । বাশুলীদেবীর থানে রামীকে নিজের পত্নী বলে মেনেছেন ।   এখন রামী তাঁর ধ্যান, রামী তাঁর বাগদেবী । প্রতিটি রাতের  অপেক্ষা । নতুন নতুন কামকলা।   আর রামীর অণুপ্রেরণায় চন্ডীদাসের রোজ নতুন নতুন পদ লেখা ।