বিলাসপুর থেকে ভাড়ার গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু মধ্যপ্রদেশের অনুপপুর জেলার অমরকন্টকের উদ্দেশ্যে । মন্দিরময় পুরোণো শহর অমরকন্টক যার আরেক নাম তীর্থরাজ । যেখানে ভারতের দুই উল্লেখযোগ্য পর্বত বিন্ধ্য এবং সাতপুরা মিলিত হয়েছে মৈকাল পর্বতের সাথে । আর সেই অমরকন্টক হল নর্মদা এবং শোন নদীর উত্পত্তি স্থল ।
কপিলধারা
এই সেই নর্মদা নদী যে নাকি মৈকাল পর্বতের কন্যা । ভরা বর্ষায় তার জল থৈ থৈ রূপলাবণ্য নিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে গাল্ফ অফ খাম্বাতে গিয়ে তার আত্ম সমর্পণ । তার এই যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছে কত কত উপনদী, মিলিত হয়েছে তার সাথে হিরণ, তিন্ডোনি, কোলার, হাথনী, গোয়ী, তাওয়া, এবং গাঞ্জাল.. বন্ধুনদী হয়ে তার কোলে এসে পড়েছে । স্থান দিয়েছে তার তীরে কত কত কোল-ভীল-কিরাট-ব্যাধ উপজাতিদের । যাদের লালনে শিবমহিমা ব্যাপ্ত হয়েছে নর্মদার তীরে তীরে । মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই অমরকন্টককে ঘিরে । নর্মদা যার উত্পত্তিস্থল । মহাকবি কালিদাসের রচনায় অমরকন্টককে "অমরকূট" বা যে পাহাড়ের শৃঙ্গের বিনাশ হয়না কিম্বা "আম্রকূট" বা যে পাহাড়ের চূড়া আমগাছের প্রাচুর্য্যে সমৃদ্ধ বলে আমরা জানি । নর্মদার একরাশ পাহাড়ী ঝোরায় মাঝেমাঝেই লুকিয়ে পড়া আর হঠাত হঠাত তার কলকল শব্দে গহিন জঙ্গলে বয়ে চলা দেখে মনে হল পাহাড় আর নদীর এই লুকোচুরি, নর্মদার তিরতির করে ঝরে পড়া কিম্বা দুধ-সাদা ফেনিল জলরাশির মধ্যে যে আনন্দ তা কিশোরী বালিকা বা যুবতীর হাসির মতই স্বতস্ফূর্ত এবং সাবলীল । অমরকন্টকের প্রাচীন মন্দিরগুলি পুরোণো ভারতীয় মন্দিরের ঐতিহ্য বহন করছে । অসাধারণ সুন্দর তার স্থাপত্য । কলচুরি মহারাজ কর্ণের আমলে তৈরী এই মন্দিরগুলি । সপ্তরথের আকৃতি বিশিষ্ট একটি শিব মন্দির রয়েছে যার তিনটি গর্ভগৃহ । একে বলে কর্ণ মন্দির । অমসৃণ লাল পাথরের তৈরী । কর্ণমন্দিরের উত্তরে ১৬টি স্তম্ভ বিশিষ্ট মাছেন্দ্র নাথ মন্দির । এছাড়া রয়েছে পঞ্চরথের আকৃতি বিশিষ্ট পাতালেশ্বর মহাদেও মন্দির । কেশব নারায়ণ মন্দির । ঠিক পাশেই রয়েছে সূর্যকুন্ড । কথিত আছে, একসময় নর্মদা এই স্থান থেকে উত্সারিত হত এবং তাই মহারাজ কর্ণদেব মহাভারতের ৩০০০বছর পর এই সূর্যকুন্ডটি এবং সংলগ্ন পাতালেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কুমারী নর্মদাকে আশ্রয় দেবার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরী করা হয় যার নাম রঙমহল ।
পুরোণো মন্দির দেখে এবার গন্তব্য নর্মদা উত্সস্থল বা নর্মদা-উদ্গম এবং যাকে ঘিরে রয়েছে একটি বিশাল কুন্ড ও তার আশেপাশে একরাশ নতুন মন্দির । রাজকীয় প্রবেশদ্বার এই মন্দিরের। এখন নর্মদার উত্সমুখ জলের ১২ফুট নীচে যেখানে নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ রয়েছেন । মহাদেবের স্বেদগ্রন্থি থেকে সৃষ্ট এই নর্মদা । বছরে দু-একবার কুন্ডের পিছনে দরজা খুলে জল ছেঁচে ফেলে দিয়ে আবার কুন্ড ভর্তি করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় । সেই সময় নর্মদেশ্বর এবং তার মন্দিরে প্রবেশ করা যায় ।
নর্মদা উত্সস্থল বা নর্মদা-উদ্গম
নর্মদার উত্তরতীরে কপিলধারা জলপ্রপাত যেখানে মহামুনি কপিল তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন । কপিলধারা থেকে ১কিমি পশ্চিমে রয়েছে দুগধারা জলপ্রপাত । ঋষি দুর্বাসা এখানে তপস্যা করেছিলেন । এছাড়াও রযেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে শম্ভূধারা এবং দুর্গাধারা জলপ্রপাত । ঝরণার অবলীলায় ঝরে পড়া আর পাহাড়-মাটী-নদীর এত সুন্দর সখ্যতায় অমরকন্টক যেন হয়ে উঠেছে চির নবীন । নদীর উচ্ছলতায় পাহাড় যেন কথা বলে ওঠে এখানে ।
মাই-কি-বাগিয়া
ভার্জিন নর্মদা সুন্দরীর যৌবনপ্রাপ্তি এই অমরকন্টকে । কুমারী নর্মদা তখনো মা নর্মদা হয়ে ওঠেনি । প্রাচীন মন্দিরের কিছু দূরেই পড়ে যেখানে রয়েছে চর্ণোদক কুন্ড । ঘন অরণ্যের মধ্যে ফল ও ফুলগাছের ছায়া সুনিবিড় ইকোসিস্টেমে কুমারী নর্মদা সই পাতিয়েছিল গুল-ই-বকোয়ালি ফুলের সাথে । অসাধারণ সুন্দর দেখতে এই ক্যাকটাসের ফুল । নর্মদার জোলো হাওয়ায় গভীর অরণ্যে ফুটে থাকে এই ফুল যার বৈজ্ঞানিক নাম এপিফাইলাম অক্সিপেটালাম। হিন্দীতে বলে নিশিগন্ধী বা গুল-ই-বকোয়ালি । এটি একটি অত্যাশ্চর্য বনৌষধি । যাইহোক আমরা হলাম পরিদর্শক । কুমারী নর্মদা আর গুল-ই-বকোয়ালির সখ্যতায় গড়ে ওঠা মা-কি বাগিয়া দেখে নিলাম চটপট । হোম, যজ্ঞ, পূজোপাঠ চলছে মহা ধূমধাম করে । খুব নাকি জাগ্র্ত এই স্থান ।
কিন্তু শীতে ফুলবন্ধুটির দেখা পেলাম না । মার্চমাসে আবির্ভাব হয় তার ।
মা কি বাগিচার ১ কিমি দক্ষিণে যাওয়া হল শোনমুডা বা শোন নদীর উত্সমুখ দেখতে । এটিকে অমরকন্টকের স্বর্গ বলা হয় । ব্রহ্মার বরপুত্র শোন । রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গিয়ে দেখা গেল একটি হনুমান মন্দিরের গায়ে শোনমুডা বা শোন নদীর উত্পত্তিস্থল । এখান থেকে অতি শীর্ণকায় শোন পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা এগিয়ে তারপর প্রেসিপিসের ওপর দিয়ে পাহাড় থেকে লাফ মেরে নীচের উপত্যকায় জলপ্রপাত হয়ে ঝরে পড়ে বেরিয়ে চলে গেছে উত্তর দিকে সুদূর গঙ্গার সাথে মিলিত হবার জন্য । আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে দুটি বড় নদী এত নিকটবর্তী স্থান থেকে উত্সারিত হয়ে দুটি দুদিকে বয়ে চলে গেছে । নর্মদা আরব্যসাগরের দিকে আর শোন উত্তরদিকে গঙ্গার মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে । প্রকৃতির এই ভৌগোলিক খেয়ালকে পুরাণে এক বেদনাদায়ক কাহিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা আছে । সেখানে বলা হয় নর্মদার সাথে শোনের বিবাহ নাকি কোনো কারণে বাঞ্চাল হয়ে যায় । আজীবনকাল এইভাবে নর্মদা ও শোন একে অপরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে ।
ছোটবেলা থেকে যে মান্ধাতার কথা আমরা শুনে আসছি সেই পৌরাণিক সূর্যবংশীয় রাজা মান্ধাতা আনুমানিক ৬০০০ বছর পূর্বে অমরকন্টকের নিকটবর্তী ঋক পর্বতের গায়ে রাজত্ব করতেন । এও শোনা যায় যে মান্ধাতার পুত্র পুরুকুত্সার রাণী নদী নর্মদার নামকরণ করেছিলেন । তবে ইতিহাসে এর কোনো উল্লেখ নেই ।
আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার, ২৬শে মে ২০১২, ওয়ানস্টপ ভ্রমণ