Wednesday, May 30, 2012

কাশ্মীরে


-->
কাশ্মীরে
17th May 2012
প্রতিবার পাহাড় না সাগর এই বিতর্কে হেরে যাই আমি । গরমের ছুটির ফাঁদে পা দিলেই হিমালয় টেনে নিয়ে যায় তার কাছে । এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না । গ্রীষ্মের ভোরের অতিবেগুনী রশ্মির মশারী ছিঁড়েখুঁড়ে আমরা তখন মহানগরকে নীচে ফেলে হারিয়ে গেলাম বায়ুপথে । ততক্ষণে ভুলে গেছি প্রখর তপন তাপ । উধাও গ্রীষ্মের দাপুটে মেজাজ । আমরা তিনজনে দিল্লী থেকে আবার শ্রীনগরের উড়ানে । আমার চোখে কাশ্মীর কি কলির সিনেমেটিক রং ... দুচোখ জুড়ে শাম্মী কাপুর আর শর্মিলা ঠাকুর ভাসছে । ধীরে ধীরে হিমালয়ের টানে, বরফের গানে এগিয়ে চলেছি । আমার দেশের রূপলাবণ্য নিয়ে সর্বাগ্রে যে মুখশ্রীর কথা বলতে হয় সেই কাশ্মীর পৌঁছলাম শ্রীনগর থেকে একখানা গাড়িতে করে । এই সেই বিদ্ধস্ত terrain যাকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে এত দাঙ্গা হয়েছে ? দেশের এই মুখশ্রীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বর্ডারে কত কাঁটাতারের বেড়া , কত সৈনিকের লড়াই ! কত টানাপোড়েন ! এই ভূস্বর্গকে তুলনা করা হয় ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে । কয়েকদিনের জন্যে না হয় তোলা থাক সে তুলনা । সুইস আলপ্‌সের স্মৃতি তোলা থাক এলবামে । ওরে হিমালয় যে আলপ্‌সের চেয়ে কিছু কম নয় ...এই বলতে বলতে এগিয়ে চললাম ফোটোশপড নীল আকাশের দেশে । এমন নীল যে কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি চলল হৃদয়পুরা দিয়ে । ঝাউগাছ আর লতানে গোলাপের গুল্মের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বারবার মনে পড়ছিল ওপি নায়ারের কাশ্মীর কি কলির গানের সিকোয়েন্স । স্লোপিং রুফের বাড়িগুলো দেখে মনে পড়ে গেল খবরের কাগজের তুষারপাতের কথা । পথে চাপদাড়ি যুবক, বোরখা ঢাকা যুবতী আর মোড়ে মোড়ে সিআর পিএফ জওয়ানদের ভ্যান গাড়ি দেখে অনুভব করলাম কাশ্মীরের প্রতিকূলতা । পথে পড়ল রাজবাগ পার্ক । ঝিলামকে দেখলাম একঝলক । একে বলে বিতস্তা । ড্রাইভার মুক্তেয়ার বলল "দরিয়া ঝালেম" । যার পেছনে ঘন সবুজ পাহাড় স্তরে স্তরে সাজানো । ঝিলাম নেমেছে হিমালয়ের কোনো এক চোরা গ্লেসিয়ার থেকে । বেশ ঢল ঢল থৈ থৈ নিটোল রূপ তার । ঝিলাম সেতু পেরিয়ে ডাল ঝিলে এলাম আমরা । একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ । লেক যে এত বড় হয় আগে কখনো দেখিনি ।শিলং এ বড়াপানি লেক দেখেছিলাম, সুইজারল্যান্ডের লুগানো লেক দেখেছিলাম । কিন্তু তাই বলে এত হৈ হৈ হাউসবোটের পসরা আর কূলে কূলে এত শিকারা ?
ডাললেকের ধারে একটা হোটেলে আমাদের সেদিনের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা । মালপত্র রেখে একটু চা-স্ন্যাক্স খেয়েই আমরা পায়ে হেঁটে ডাল-ঝিল পরিক্রমায় বেরোলাম । দরদস্তুর করে শিকারার মাঝির আমন্ত্রণে চড়ে বসলাম শিকারায় । এমন কাশ্মীরি নৌকোর ছবি দেখেছি । চড়িনি আগে । পড়ন্ত রোদের আলোয় ডালঝিল রমরম করছে তখন । হাউসবোটের উঠোন ঘেঁষে শিকারা চলেছে মাঝির খেয়ালে । কখনো কাশ্মীরি পশমিনার দোকানের রোয়াকে কখনো আখরোট কাঠের ওয়ার্কশপে কখনো বা মীনাকারির গয়নার শিকারার বারান্দায় । সবাই মিলে বাসছি আমরা ডাললেকের জলে । শিকারার দাঁড় কাঠের পানের গড়নের । মাঝি কি অবলীলায় না সর্বক্ষণ সে দাঁড় বাইছে আপনমনে । আমাদের নৌকার সমান্তরালে এগিয়ে এল উলের পোষাক, পাথরের গয়নার মোবাইল দোকানি । এল শুকনোফল আর কেশর । এগিয়ে এল ফোটোগ্রাফারও রাজারাজড়ার পোশাক-গয়না হাতে । একটু অনুরোধ বৈ আর কিছুই নয় । এইভাবে সেই প্রদোষে ঘন্টা দেড়েক শিকারা ভ্রমণ। মাঝে দু একটা পিটস্টপ । নেহরুগার্ডেনে অবতরণ গোলাপের বাগানে । একটু ছবি তোলা । আবার শিকারা চড়ে ভাসমান শিকারায় । আশপাশে ভাসমান সবজী বাগানের মধ্যে দিয়ে লিলিপুলের মধ্যে দিয়ে ।, হাউসবোটের রোয়াক ঘেঁষে । কাশ্মীরি শাল আলোয়ানের দোকানের পাশ দিয়ে একটু আধটু ছোঁক ছোঁকানি , কি কিনি কি কিনি এই ভাব নিয়ে । ডাললেকের ধারে একটা ধাবায় রাতের খাওয়া সারা হল রুটি আর মুরগীর রোগানজোশ দিয়ে । বেশ সুস্বাদু রান্না । তেল কম , মশলা বেশি । বেশ অন্যরকম স্বাদ । রাতে হোটেলে ফিরে সুখনিদ্রায় ডুবসাগরে ।
১৮ই মে ২০১২
শ্রীনগরের ডাললেকের ধারে হোটেলের কামরা থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শব্দে ঘুম গেল ভেঙে । মেঘ না মৌসুমী ? কাঁচের জানলায় অন্ধকারের থাবা । ভূস্বর্গ বৃষ্টিস্বর্গে পৌঁছে গেল না কি ! মনখারাপের পার্টির শুরু । জানলার ভারী পর্দা সরিয়ে দেখি কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে । প্রথমে টুথব্রাশ তারপর চায়ের কাপ হাতে আমি চোখ রেখেছি পাহাড়ের মাথায় । কখনো মেঘ উড়ে গেলে তুষারশিখর মুখ বেরে করছে আবার মেঘের চাদর তার গায়ে । আমাদের মনের চাপা টেনশনে ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ততক্ষণে । রুম হিটার বন্ধ করলাম । হঠাত চানঘর থেকে এসে দেখি রোদ উঠেছে । পাহাড়ের চূড়ো হাসতে শুরু করেছে খিলখিল করে । সবজী পরোটা আর দৈ সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া হল পহেলগামের উদ্দেশ্যে । হালকা ঠান্ডা তখন চিনার বনের মধ্যে । ঝিলামের ধারে ধারে চিনারের এই অভিভাবকত্ব মুঘল আমল থেকে । চিনারকে কেউ কুড়ুল মারতে পারবেনা । এই ইকোফ্রেন্ডলি চিনারকে নিয়ে কাশ্মীরিদের খুব গর্ব । পাঁচ;'শো বছরের পুরোণো চিনারের গাম্ভীর্যে কাশ্মীরের রাস্তাগুলো যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে সবুজে সবুজে । চিনার পাতা সর্বস্ব বৃক্ষ । পরিবেশ দূষণ রুখতে এর জুড়ি নেই । আর আছে এর ভেষজ গুণ ।চিনারের ছায়ায় টিবি রোগ সারে । প্রচুর পাতা থাকায় অক্সিজেন সাপ্লাই করে পরিবেশ দূষণ রুখতে এর জুড়ি মেলা ভার । স্থানীয় মানুষেরা পারলে চিনারকে পুজো করে । চলেছি চিনার বনের মধ্যে দিয়ে কেশর ক্ষেতে । জাফরাণী মাদকতা নিয়ে । দুষ্প্রাপ্য এই কেশরকে খুব যত্নে চাষ করা হয় । বছরের অল্প সময়ে অস্তিত্ত্ব । তার মধ্যেই ফুল ফুটিয়ে ফুল শুকিয়ে বাক্সবন্দী হয় এই সুগন্ধী ।
পথে পড়ল পান্থচক । পাথরের সব কারখানা । কারিগরেরা সেখানে খুদে খুদে বানাচ্ছে শিল নোড়া, খলনুড়ি, হামান দিস্তা । কিনে ফেললাম একটা খলনুড়ি । বেশ অন্যরকম দেখতে । এটাই কাশ্মীরের ট্র্যাডিশানাল মশলা পেষার কল ।
 এবার আখরোট গাছ । ড্রাইভারের প্রশ্রয়ে এক শুকনোফলের দোকানে থামলাম । জাফরাণী পাঁচন কাওয়া দিয়ে ওয়েলকাম পর্ব । পাঁচন যে এত সুখকর পানীয় হতে পারে তা প্রমাণ করল অনবদ্য এই কাওয়া ড্রিংক । পেস্তা, আমন্ড কুচি দিয়ে গার্ণিশ করা কেশর-এলাচের গন্ধে ম ম করছে আশপাশ । ওয়েলকাম  পর্ব সেরে শুভেচ্ছা বিনিময় তারপর চোখরাখা হল শুকনো ফলের পসরায় । আখরোট, মনাক্কা, আমন্ড, পেস্তা, কাজু, কিশমিশ , ফিগ ও পোস্ত । আখরোটই একমাত্র স্থানীয় ফল ।  কিছুটা খরিদারি হল । এবার পথচলা ।  
 এবার দেখি উইলোকাঠের সারি । ক্রিকেট ব্যাট তৈরী হয় এই কাঠ দিয়ে । প্রচুর ট্যুরিস্ট গাড়ি থামিয়ে বাক্সবন্দী করছে ক্রিকেট ব্যাট । এবার এল অবন্তীপুরম । কাশ্মীরের রাজা অবন্তী বর্মণের তৈরী ১১০০ বছরের পুরোণো এই মন্দির । দুধর্ষ সুন্দর । ৯০০ শতাব্দীতে নির্মিত । তারপর ৫০০ বছর পর ভূমিকম্পে ওলটপালট মন্দিরের স্থাপত্য  । ঝিলামের স্রোতে ভেসে গেছে খুঁটিনাটি । ঝিলামের ঢেউ আছড়ে পড়েছে  ভাঙা মন্দিরের কালো পাথরের উঠোনে । তলিয়ে গেছে ইতিহাস । সাক্ষী শুধু কাশ্মীরের পথ । চাপা পড়ে যাওয়া সময়ের দলিলে চোখ রাখলাম লোকাল গাইডের সাথে । ভূকম্পনে বিদ্ধস্ত এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ দয়ানন্দ সরস্বতী । ১৯২৩ সালে তখন ব্রিটিশ আমল । মন্দিরের চারপাশে পাথরের চারটি অভিনব সরস্বতী। এছাড়া রয়েছে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক । মধ্যিখানে উঁচু মঞ্চে রূপোর বিষ্ণু মন্দির ছিল । ব্রিটিশরা সেই রূপোর মূর্তি লন্ডনের মিউজিয়ামে নিয়ে চলে যায় । পাথরের অন্যান্য মূর্তিগুলি শ্রীনগরের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত । চিনারের ছায়ায় ঘুরে ঘুরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে পাথরের খোদাই কর্ম খুঁজে বের করে  দেখালেন গাইড বন্ধু । বিষ্ণুর অনন্ত শয্যা শেষ নাগের ওপর, নবগ্রহের মূর্তি, লক্ষ্মী নারায়ণ   আরো কত কিছু । 
-->