আমরা
বারাণসী থেকে একটি গাড়ী ভাড়া
করে সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম
দীঘি নিনোরা-তাল
দিয়ে ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট
এক গ্রাম খাজুরাহের দিকে ।
বিন্ধপর্বতের কোলে এই গ্রামে
ছিল অনেক খেঁজুর গাছ । সোনার
মত গুচ্ছ গুচ্ছ খেঁজুর ঝুলে
থাকত সেখানে । তাই নাম খাজুরাহো
।
রেওয়া
হয়ে যেতে হবে আমাদের । মাঝখানে
বেলার কাছে গোবিন্দগড় মোড়ে
দুপুরের খাওয়া । তারপর সাতনার
দিকে । পথে পড়ল পান্না টাইগার
রিজার্ভ । ঘন অরণ্যের মধ্যে
দিয়ে গাড়ী চলল। রেওয়া পর্যন্ত
রাস্তা খুব খারাপ । পান্নার
পথ ন্যাশানল হাইওয়ে ৭৫ । খুব
তাড়াতাড়ি চলেছিলাম । এই পথ
সোজা যায় কাশী থেকে কন্যাকুমারী
। একে বলে "দক্ষিণপথ"
। বিন্ধ্যপর্বতের
গা ঘেঁষে চলা । হাতী আছে নাকি
এই জঙ্গলে । জানলার কাঁচ সরাতেই
বুঝলাম আমরা ঘাটি উপত্যকার
মধ্যে দিয়ে চলেছি । বনফুলের
সোঁদা গন্ধে ম ম চারিদিক । বড়
নদী মান্ডলা পেরোলাম ।
সন্ধ্যের
ঝুলে হোটেলে পৌঁছে মালপত্র
রেখেই বেরিয়ে পড়া ঝাঁ চকচকে
ছোট্ট শহর খাজুরাহে । শুনলাম
"সন-এট-লুমেয়াঁ"
অর্থাত "লাইট
এন্ড সাউন্ড” শো সন্ধ্যে
সাড়েছ'টায় ।
মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম আয়োজিত
হিন্দী ও ইংরেজীতে ধারাভাষ্যে
একঘন্টা ধরে সেই প্রদর্শনী
ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপ অফ টেম্পলসের
প্রকান্ড মাঠে । এত ছোট্ট
শহরে হাতের মুঠোয় সবকিছু ।
দীপাবলীর পর বেশ ঠান্ডা ।
দোকানপাট রমরমিয়ে চলছে। হোটেল,
পলিনেশিয়ান রেস্তোঁরা
আর ফরেন ট্যুরিষ্টের ভীড় বেশী
। টিকিট কেটে চেয়ারে বসলাম ।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যা
ছিল গতকাল অবধি । আকাশে
প্রতিপক্ষের একসূতো চাঁদের
ফালি আর কয়েকটা ফুটফুটে তারা
। ভাষ্যপাঠের শুরু । দূরে-কাছের
মন্দিরের সীমারেখা জ্বলে
উঠল । illumination ! রঙীন
ও কৃত্রিম আলোয় কালো আকাশের
পর্দায় ভেসে উঠল মন্দিরের
স্কেচ। কি অপূর্ব । স্বর্গের
অপ্সরা, ঊর্বশী
রম্ভা, কিন্নর-কিন্নরী
সব আছেন মন্দিরগাত্রে । প্রতিদিন
আলোকের ঝর্ণাধারায় ধুয়ে যায়
এদের কালিমা ।
ঘন্টাধ্বনির
শুরু একযোগে । দেবদাসীর নূপুরের
সিঞ্জিনী। ঘুঙুরের শব্দ,
আবার ভাষ্যপাঠ ।
চন্দ্রবর্মণের জন্ম ও মন্দির
তৈরীর কারণ শুরু থেকে শেষ
একনাগাড়ে । একটুও একঘেয়েমি
নেই । মনে হয় রাতটা এখানে থাকলেই
ভালো হত ।
ইতিহাসের
পাতায় তখন চান্ডেলারাজ তার
জীবনদর্শন এঁকে চলেছেন ।
চান্ডেলারাজ চন্দ্রবর্মণ
রচিত ইতিহাসের সাক্ষী আমরা
। কালাঞ্জর, কাশী
এবং খাজুরাহোর শাসক দেশের
নামকরা ভাস্করদের আহ্বান
জানান । তার ইচ্ছেয় চন্দ্রবংশীয়
রাজচিহ্ন স্বরূপ এক যুবকের
দ্বারা ধরাশায়ী সিংহের
প্রতিমূর্তি নির্মাণ করল
ভাস্কর । আর তারপর রাজার আদেশে
তৈরী হল একের পর এক অপূর্ব
মন্দির । নগররীতিতে তৈরী
মন্দিরে অভূতপূর্ব স্থাপত্য
ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধন । শুধুই
ছেনি-হাতুড়ি নয়,
পাথর কুঁদে এমন
শিল্পকর্মে লাগে ধৈর্য্য ও
কল্পনা । অগণিত ভাস্করের
শৈল্পিক কর্মে ফুটে উঠল কাইমুর
স্যান্ডস্টোনে তৈরী অভিনব
মন্দিরময় খাজুরাহো । গ্রানাইট
পাথর এল পূর্বদিকের কেন নদীর
ধারে পান্না পাথর খনি থেকে।
চৌষট্টি যোগিনী মন্দির নির্মাণ
হল । তারপর একে একে তৈরী হল
কান্ডারিয়া মহাদেব, জগদম্বা,
পার্শনাথ , লক্ষণ,
দুলাদেও , বিশ্বনাথ
, আদিনাথ,
মার্তন্ডেয় মন্দির
। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ
ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে
ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ
বহন করছে এই মন্দিরগুলি ।
কেবলমাত্র মার্তন্ডেয় মন্দিরে
বিশাল শিবলিঙ্গে পূজা হয় ।
বিকেলের
আলতাগোলা আকাশে ফাগের রং
চুঁইয়ে পড়ছে খাজুরাহোর
স্থাপত্যে।
নারীমূর্তির
কোমল পেলব প্রতিকৃতি মূর্ত
হয়ে উঠছে সেই রংয়ে । পুরুষমূর্তিগুলিও
প্রাণ পেল সেই প্রদোষে ।
মানুষের
জীবন, দৈনন্দীন
চাহিদা, নারী-পুরুষের
সৃষ্টি রহস্যের মূলে মৈথুন,
জাগতিক সবকিছু ।
যুদ্ধ, বিবাহ থেকে
শুরু করে জীবনযাপনের অনুষঙ্গ
সব নিয়ে ভাস্কররা তৈরী করেছিল
মন্দিরের দেওয়াল, মন্ডপ,
পোর্টিকো, তোরণ
। মন্দিরের মধ্যে মন্দির ।
সেখানে মহাদেব, নন্দী,
বিষ্ণুর বরাহ অবতার
। ভাঙতে এসেছিল কুতুবুদ্দিন
আইবক । তাকে রুখে দেওয়া হয়েছিল
কালাঞ্জরে । কি অপূর্ব কারুকার্য
! বাত্স্যায়ণের
কামসূত্র থেকে অপ্সরার রূপসজ্জা।
কখনো নারী ত্রিভঙ্গ আবার কখনো
বহুভঙ্গ রূপ । চোখে কাজল পরছে
কিম্বা সিঁথিতে সিঁদুর ।
দর্পণে মুখ দেখছে কিম্বা
এখনকার ফ্যাশন প্যারেডের মত
দলে দলে তাদের শরীরি বিভঙ্গ
বা নৃত্যরতা নর্তকীর ঘুঙুর
বাঁধার দৃশ্য । রম্ভারূপসী
পায়ের পাতা আঁকা বা ঊর্বশীর
পায়ের নীচে কাঁটা বের করা ।
কোথাও দেখি ধ্যানমগ্ন তীর্থঙ্কর
পার্শ্বনাথ বা মৃত্যুর দেবতা
যমরাজ। কোথাও আবার সূর্যদেবের
উদ্দেশ্যে নির্মিত চিত্রগুপ্ত
মন্দির । চেয়ে দেখি কামদেব
এর দুই পাশে রতি ও প্রীতি !
ভাস্করের
হাতে যেন ছিল পরশপাথর ।
ছেনি-হাতুড়ির
সমণ্বয়ে ফুটিয়েছিল মন্দিরগাত্রের
কি অপূর্ব বৈচিত্রময়তা !
একমেবাদ্বিতীয়ম্
! কিছু কিছু ভেঙে
গেছে কালের স্রোতে । ভূমিকম্প-ঝঞ্ঝা
ফাটল ধরাতে পারেনি এখনো বেঁচে
থাকা পঁচাশিটি মন্দিরকে ।
অক্ষয় সেই স্থাপত্য, অব্যয়
সেই ভাস্কর্য ।
শৃঙ্গাররত
নরনারীর কামোদ্দীপক ভাস্কর্য
। কিন্তু কে বলে শুধুই erotic
sculpture আছে খাজুরাহে?
প্রতি পঞ্চাশটির
মধ্যে একটি হয়ত মৈথুন রত দম্পতির
সুখ যাপনের চিত্র বাকী সব
রিয়েল লাইফের টানা ও পোড়েন ।
হয়ত রাজার আদেশে অণুপ্রাণিত
হয়েছিল ভাস্কর । স্বতঃপ্রণোদিত
হয়ে ফুটিয়ে তুলেছিল রমণ ক্রিয়া
। কিন্তু সে তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ। শুধু তো তাই নয় । সংসার,
পুজোপার্বণ, রাজার
যুদ্ধযাত্রা হিন্দু দেবদেবী
সবকিছুই তো বাস্তব জীবনের
অংশ ।
এমন
হাজারে হাজারে স্থাপত্য ।
দেখে শেষ করা যায়না । কূল কিনারা
পাইনা ভেবে সেই ভাস্করের হাতের
শৈলীকে । কত বছর ধরে না জানি
ছেনি-হাতুড়ি-বাটালির
শব্দের তুফানে অনুরণিত হয়েছিল
খাজুরাহের আকাশ বাতাস । ভাস্করের
মনমন্দিরের কল্পনাপ্রসূত
হয়ে জন্ম নিয়েছিল এই অভিনব
শিল্পকর্ম ।
কিভাবে
যাবেন : হাওড়া
থেকে ট্রেনে বারাণসী ও সেখান
থেকে গাড়ি ভাড়া করে বারাণসী
যাওয়া সবচেয়ে ভালো ।
কখন
যাবেনঃ প্রখর গ্রীষ্ম বাদ
দিয়ে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল
অবধি খাজুরাহো যাবার আদর্শ
সময় ।
কোথায়
থাকবেনঃ খাজুরাহোতে প্রচুর
ভালো ভালো হোটেল আছে । তবে
একটু ভালো হোটেল পেতে গেলে
আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভালো
কারণ বিদেশী পর্যটকে উপছে
পড়ছে ।