Sunday, April 28, 2013

খাজুরাহো ---কে বলে শুধুই erotica ???



আমরা বারাণসী থেকে একটি গাড়ী ভাড়া করে সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম দীঘি নিনোরা-তাল দিয়ে ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম খাজুরাহের দিকে । বিন্ধপর্বতের কোলে এই গ্রামে ছিল অনেক খেঁজুর গাছ । সোনার মত গুচ্ছ গুচ্ছ খেঁজুর ঝুলে থাকত সেখানে । তাই নাম খাজুরাহো ।
রেওয়া হয়ে যেতে হবে আমাদের । মাঝখানে বেলার কাছে গোবিন্দগড় মোড়ে দুপুরের খাওয়া । তারপর সাতনার দিকে । পথে পড়ল পান্না টাইগার রিজার্ভ । ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল। রেওয়া পর্যন্ত রাস্তা খুব খারাপ । পান্নার পথ ন্যাশানল হাইওয়ে ৭৫ । খুব তাড়াতাড়ি চলেছিলাম । এই পথ সোজা যায় কাশী থেকে কন্যাকুমারী । একে বলে "দক্ষিণপথ" । বিন্ধ্যপর্বতের গা ঘেঁষে চলা । হাতী আছে নাকি এই জঙ্গলে । জানলার কাঁচ সরাতেই বুঝলাম আমরা ঘাটি উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলেছি । বনফুলের সোঁদা গন্ধে ম ম চারিদিক । বড় নদী মান্ডলা পেরোলাম ।

সন্ধ্যের ঝুলে হোটেলে পৌঁছে মালপত্র রেখেই বেরিয়ে পড়া ঝাঁ চকচকে ছোট্ট শহর খাজুরাহে । শুনলাম "সন-এট-লুমেয়াঁ" অর্থাত "লাইট এন্ড সাউন্ড” শো সন্ধ্যে সাড়েছ'টায় । মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম আয়োজিত হিন্দী ও ইংরেজীতে ধারাভাষ্যে একঘন্টা ধরে সেই প্রদর্শনী ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপ অফ টেম্পলসের প্রকান্ড মাঠে । এত ছোট্ট শহরে হাতের মুঠোয় সবকিছু । দীপাবলীর পর বেশ ঠান্ডা । দোকানপাট রমরমিয়ে চলছে। হোটেল, পলিনেশিয়ান রেস্তোঁরা আর ফরেন ট্যুরিষ্টের ভীড় বেশী । টিকিট কেটে চেয়ারে বসলাম । ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যা ছিল গতকাল অবধি । আকাশে প্রতিপক্ষের একসূতো চাঁদের ফালি আর কয়েকটা ফুটফুটে তারা । ভাষ্যপাঠের শুরু । দূরে-কাছের মন্দিরের সীমারেখা জ্বলে উঠল । illumination ! রঙীন ও কৃত্রিম আলোয় কালো আকাশের পর্দায় ভেসে উঠল মন্দিরের স্কেচ। কি অপূর্ব । স্বর্গের অপ্সরা, ঊর্বশী রম্ভা, কিন্নর-কিন্নরী সব আছেন মন্দিরগাত্রে । প্রতিদিন আলোকের ঝর্ণাধারায় ধুয়ে যায় এদের কালিমা ।
ঘন্টাধ্বনির শুরু একযোগে । দেবদাসীর নূপুরের সিঞ্জিনী। ঘুঙুরের শব্দ, আবার ভাষ্যপাঠ । চন্দ্রবর্মণের জন্ম ও মন্দির তৈরীর কারণ শুরু থেকে শেষ একনাগাড়ে । একটুও একঘেয়েমি নেই । মনে হয় রাতটা এখানে থাকলেই ভালো হত ।
ইতিহাসের পাতায় তখন চান্ডেলারাজ তার জীবনদর্শন এঁকে চলেছেন । চান্ডেলারাজ চন্দ্রবর্মণ রচিত ইতিহাসের সাক্ষী আমরা । কালাঞ্জর, কাশী এবং খাজুরাহোর শাসক দেশের নামকরা ভাস্করদের আহ্বান জানান । তার ইচ্ছেয় চন্দ্রবংশীয় রাজচিহ্ন স্বরূপ এক যুবকের দ্বারা ধরাশায়ী সিংহের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করল ভাস্কর । আর তারপর রাজার আদেশে তৈরী হল একের পর এক অপূর্ব মন্দির । নগররীতিতে তৈরী মন্দিরে অভূতপূর্ব স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধন । শুধুই ছেনি-হাতুড়ি নয়, পাথর কুঁদে এমন শিল্পকর্মে লাগে ধৈর্য্য ও কল্পনা । অগণিত ভাস্করের শৈল্পিক কর্মে ফুটে উঠল কাইমুর স্যান্ডস্টোনে তৈরী অভিনব মন্দিরময় খাজুরাহো । গ্রানাইট পাথর এল পূর্বদিকের কেন নদীর ধারে পান্না পাথর খনি থেকে। চৌষট্টি যোগিনী মন্দির নির্মাণ হল । তারপর একে একে তৈরী হল কান্ডারিয়া মহাদেব, জগদম্বা, পার্শনাথ , লক্ষণ, দুলাদেও , বিশ্বনাথ , আদিনাথ, মার্তন্ডেয় মন্দির । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ বহন করছে এই মন্দিরগুলি । কেবলমাত্র মার্তন্ডেয় মন্দিরে বিশাল শিবলিঙ্গে পূজা হয় ।

বিকেলের আলতাগোলা আকাশে ফাগের রং চুঁইয়ে পড়ছে খাজুরাহোর স্থাপত্যে।
নারীমূর্তির কোমল পেলব প্রতিকৃতি মূর্ত হয়ে উঠছে সেই রংয়ে । পুরুষমূর্তিগুলিও প্রাণ পেল সেই প্রদোষে ।

মানুষের জীবন, দৈনন্দীন চাহিদা, নারী-পুরুষের সৃষ্টি রহস্যের মূলে মৈথুন, জাগতিক সবকিছু । যুদ্ধ, বিবাহ থেকে শুরু করে জীবনযাপনের অনুষঙ্গ সব নিয়ে ভাস্কররা তৈরী করেছিল মন্দিরের দেওয়াল, মন্ডপ, পোর্টিকো, তোরণ । মন্দিরের মধ্যে মন্দির । সেখানে মহাদেব, নন্দী, বিষ্ণুর বরাহ অবতার । ভাঙতে এসেছিল কুতুবুদ্দিন আইবক । তাকে রুখে দেওয়া হয়েছিল কালাঞ্জরে । কি অপূর্ব কারুকার্য ! বাত্স্যায়ণের কামসূত্র থেকে অপ্সরার রূপসজ্জা। কখনো নারী ত্রিভঙ্গ আবার কখনো বহুভঙ্গ রূপ । চোখে কাজল পরছে কিম্বা সিঁথিতে সিঁদুর । দর্পণে মুখ দেখছে কিম্বা এখনকার ফ্যাশন প্যারেডের মত দলে দলে তাদের শরীরি বিভঙ্গ বা নৃত্যরতা নর্তকীর ঘুঙুর বাঁধার দৃশ্য । রম্ভারূপসী পায়ের পাতা আঁকা বা ঊর্বশীর পায়ের নীচে কাঁটা বের করা । কোথাও দেখি ধ্যানমগ্ন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ বা মৃত্যুর দেবতা যমরাজ। কোথাও আবার সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নির্মিত চিত্রগুপ্ত মন্দির । চেয়ে দেখি কামদেব এর দুই পাশে রতি ও প্রীতি !


ভাস্করের হাতে যেন ছিল পরশপাথর । ছেনি-হাতুড়ির সমণ্বয়ে ফুটিয়েছিল মন্দিরগাত্রের কি অপূর্ব বৈচিত্রময়তা ! একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ! কিছু কিছু ভেঙে গেছে কালের স্রোতে । ভূমিকম্প-ঝঞ্ঝা ফাটল ধরাতে পারেনি এখনো বেঁচে থাকা পঁচাশিটি মন্দিরকে । অক্ষয় সেই স্থাপত্য, অব্যয় সেই ভাস্কর্য ।
শৃঙ্গাররত নরনারীর কামোদ্দীপক ভাস্কর্য । কিন্তু কে বলে শুধুই erotic sculpture আছে খাজুরাহে? প্রতি পঞ্চাশটির মধ্যে একটি হয়ত মৈথুন রত দম্পতির সুখ যাপনের চিত্র বাকী সব রিয়েল লাইফের টানা ও পোড়েন । হয়ত রাজার আদেশে অণুপ্রাণিত হয়েছিল ভাস্কর । স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফুটিয়ে তুলেছিল রমণ ক্রিয়া । কিন্তু সে তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুধু তো তাই নয় । সংসার, পুজোপার্বণ, রাজার যুদ্ধযাত্রা হিন্দু দেবদেবী সবকিছুই তো বাস্তব জীবনের অংশ ।
এমন হাজারে হাজারে স্থাপত্য । দেখে শেষ করা যায়না । কূল কিনারা পাইনা ভেবে সেই ভাস্করের হাতের শৈলীকে । কত বছর ধরে না জানি ছেনি-হাতুড়ি-বাটালির শব্দের তুফানে অনুরণিত হয়েছিল খাজুরাহের আকাশ বাতাস । ভাস্করের মনমন্দিরের কল্পনাপ্রসূত হয়ে জন্ম নিয়েছিল এই অভিনব শিল্পকর্ম ।





কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে বারাণসী ও সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে বারাণসী যাওয়া সবচেয়ে ভালো ।
কখন যাবেনঃ প্রখর গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল অবধি খাজুরাহো যাবার আদর্শ সময় ।
কোথায় থাকবেনঃ খাজুরাহোতে প্রচুর ভালো ভালো হোটেল আছে । তবে একটু ভালো হোটেল পেতে গেলে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই ভালো কারণ বিদেশী পর্যটকে উপছে পড়ছে ।

Thursday, April 4, 2013

তমলুকের শক্তিপিঠ দেবী বর্গভীমায়




আমরা সেদিন হঠাত বেরিয়ে পড়েছিলাম পাঁচজনে । গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্‌ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর অগতির গতি স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স । এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে । সেদিন ছিল শ্রাবণের আধো আলো আধো ছায়ায় মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের একটা ছুটির দিন ।

কোলকাতা মুম্বাই রোড ধরে ন্যাশানাল হাইওয়ে সিক্সের ওপর দিয়ে কোলাঘাট । কোলাঘাট থেকে হলদিয়া হাইওয়ে ধরে দীঘার রাস্তা ধরালাম । রোদবৃষ্টির খেলা চলল সাথে । সবুজ ক্ষেত, শ্রাবণী বনানীতে এবার বর্ষা অধরা । বৃষ্টিতে এদের সজীবতা আরো প্রকট হয় । কিন্তু এবার এদের শ্যামলতা কিছুটা নিষ্প্রভ । ধান নেই মাঠে । তবুও হাওয়ায় মৌসুমী গন্ধ । ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি নিয়ে তমলুক এল। বাঁদিকে বেঁকে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে কেলোমাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে লেভেলক্রসিং টপকে যাচ্ছি তখন । দীঘার ট্রেন এই রেলপথে যায় বুঝি । স্টেশনের নাম শহীদ মাতঙ্গিনী । এবার তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে । 
 

দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি) তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম । 
 
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী । মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে । মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে । 

 
মন্দিরে পুজো চড়িয়ে প্রসাদ খেয়ে এবার মহাপ্রভু নিরামিষ ভোজনালয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহারপর্ব । সেখান থেকে যাওয়া হল তমলুক রাজবাড়ি দেখতে । বিশাল চত্বরে রাজবাড়ির অবশেষ । তাক লাগানো বারমহল, অন্দরমহল, বিশাল দালান, সংলগ্ন মন্দির ঘুরে দেখলে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয় । মহাভারত্, ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ময়ূরধ্বজ রাজবংশের এই বাসস্থানের কিছুই পড়ে নেই । আছে শুধু বট-অশত্থ্ব-পিপলের শিকড়ে জীর্ণ রাজবাড়ির দেওয়াল । থাম, অলিন্দ ইত্যাদির পাশাপাশি আবডালের চিক-মহল লক্ষ্য করলাম যেখান থেকে হয়ত রক্ষণশীল মহিলারা উঁকি দিতেন বারমহলে । নূপুরের ছন্দে আর এস্রাজের অণুরণনে হয়ত বা ভেসে যেত রাজবাড়ির আনাচকানাচ । মাথার ওপর দিয়ে চামচিকে উড়ে গেল । কিন্তু তবুও লাল ইটের স্থাপত্য কীর্তি আজো জ্বলজ্বল করে ঝলমলে রোদে । মনে হল "কালের ধ্বনি শুনিতে কি পাও?" পাশেই বিশাল পুকুরের জলে হাত পা মুখ ধুয়ে ঠান্ডা হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায় জিরেন নিয়ে আবার ঘরে ফেরার পালা । কোলকাতা থেকে দীঘা, শঙ্করপুরের রাস্তায় ফেরার পথে ঘুরে আসা যেতেই পারে এই দুটি স্থান । 
 সকালবেলা ৪ এপ্রিল ২০১৩