কলকাতার ভোরে তখন ভৈরবীর মূর্ছণা । পুবের আলো ফুটিফুটি করে সবেমাত্র আলস্য
কাটিয়ে উঠছে কুয়াশার চাদর সরিয়ে । বিজয়ার মানখারাপ সেই উঠিউঠি আলোয় সরে গেল
। প্লেনের জানলার ধার, ওপর থেকে একচিলতে চেনা নীলনদীর দেহবল্লরী,আর মেঘের
পরতে হারিয়ে যাওয়া ঘুমন্ত মহানগরের ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে
মেঘসমুদ্রে ভাসমান হল আমাদের প্লেন । অতিবেগনী রাশ্মিমালার সূতো
ছিঁড়েখুঁড়ে মেঘের পালকে ভেসে ভেসে ঘন্টাদুয়েকেই দিল্লী । সেখান থেকে একে
একে চোখের আড়ালে চলে গেল নতুন দিল্লী, পুরোণো দিল্লীর স্কাইলাইন ,
হুমাযুনের টুম্ব আর কত স্মৃতিসৌধেরা । যমুনানদীর চোখে তখন শুকনো বালির চর ।
একে একে পুরোণো শহর গাজিয়াবাদ, মীরাট, মুজজাফরনগর পেরিয়ে উত্তরাখন্ডে
প্রবেশ করলাম আমরা । রুরকি এল । শুধু আখের ক্ষেত আর তাকে ঘিরে পপলার গাছ ।
গঙ্গা চোখের নজরে এল । বুঝলাম হরিদ্বার কাছাকাছি । বর্ষার পরে গঙ্গায় আরো
থৈ থৈ জল আশা করেছিলাম কিন্তু লকগেট এবং তেহরী ড্যামের জন্য জল বেশ কম লাগল
। মোদীনগর এবং রুরকীতে ট্র্যাফিক জ্যাম থাকায় দিল্লী থেকে হরিদ্বার
পৌঁছতে সাত ঘন্টা লেগে গেল । হোটেলে পৌঁছেই মালপত্র রেখে আবার এলাম গঙ্গার
ধারে হর কি পৌরিতে । গঙ্গা বয়ে চলেছে আপন মনে । স্রোতও আছে ঠিক যেমন
দেখেছিলাম আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে । বেড়েছে জনস্রোত, দোকানপাট আর ট্যুরিষ্ট
। কিন্তু গঙ্গার জলে পা ডুবিয়েই মনে হল হরিদ্বার অমলিন । এখানে সেই
ট্র্যাডিশান সমানে চলছে । কত জল বয়ে গেছে সুদূর হিমালয়ের বরফ গলে গঙ্গার
ওপর দিয়ে কিন্তু গঙ্গা পড়ে আছে গঙ্গাতেই । আজন্মকাল ধরে মানুষের পাপ ধুতে
ধুতে এখনো ক্লান্ত হয়নি সে ।
হরিদ্বারে গঙ্গা আরতি
হর কি পৌড়ির অর্থ হল শিবের সিঁড়ি। সমুদ্রমন্থনের পর গড়ুর পাখী যখন কলসে
করে অমৃত নিয়ে উড়ে চলেছিলেন আকাশে তখন হরিদ্বারের গঙ্গার মধ্যে সেই অমৃতের
ফোঁটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং এই স্থানকে তাই ব্রক্ষকুন্ড বলা হয় । বৈদিকযুগে
নাকি ভগাবান বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই ব্রহ্মকুন্ড দর্শন করতে এসেছিলেন ।
এইস্থানে কুম্ভমেলা হয় । সারাবছর ধরে প্রতিদিন বহু পুণ্যার্থী এই হর কি
পৌরী আসেন তীর্থ করতে , স্নান করতে এবং অভিনব গঙ্গারতি দেখতে ।
প্রতিদিন সূর্যাস্তে এবং সূর্যোদয়ের পূর্ব মূহুর্ত্তে গঙ্গার পাড়ে
দাঁড়িয়ে পুরোহিত বিশালাকার প্রদীপ নিয়ে এক অপূর্ব আরতি করেন । প্রচুর
ভক্তের সমাগম হয় নদীর ধারে; মন্ত্রোচ্চারণে , বিশাল ঘন্টাধ্বনিতে, শঙ্খে
শঙ্খে অণুরনিত হয় গঙ্গার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । গঙ্গার জলে সেই ফুলের
দীপের ভেলার প্রতিচ্ছবি আজো চোখে লেগে রয়ে গেল । গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মনে
হয় এ কোন্ এক ধর্মভীরুতা ভর করল আমাকে ? তাই কি শিকাগো লেকচারে স্বামী
বিবেকানন্দ বলেছিলেন সারা পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থের নীচে রয়েছে ভারতের
ভগবত্গীতা । যার অর্থ হল সব ধর্মকে ধারণ করে রেখেছে ভারতের ধর্ম । আর আমি
সেই দেশে জন্মেছি ? আমি কত ভাগ্যবতী!
সূর্যাস্তের হর কি পৌরী একটুর জন্যে মিস হয়ে গেল । আর সেই সাথে গঙ্গার
আরতিও । তবে পৌঁছেই পুজো কিনে পাতার ভেলায় ফুল আর কর্পূর দীপের আরতি
করলাম মা গঙ্গাকে আর ভাসিয়ে দিলাম গঙ্গার বুকে সেই পাতার একটুকরো নৌকো ।
দুলে দুলে চলতে লাগলো ফুল-আলোর সেই ভেলা । আমার এবছরের দীপাবলীর সূচনা হল
। তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে এক পাল আলোর ভেলা স্রোতের আনুকুল্যে চলতে
লাগল সেই মোহানার দিকে । কে জানে কখন নিবে যাবে তারা ! এক সরলরেখায় চলেছে
সকলে মিলে । হরিদ্বারের গঙ্গার হাওয়া, দেবভূমির বাতাস বড়ই মনোরম ।
হেমন্তের বাতাসে একটু ঠান্ডার ছোঁয়া । সব মিলিয়ে কৃষ্ণা একাদশীর রাত ফুরিয়ে
গেল সেই হাওয়া মেখে । পতিতোদ্ধারিনি গঙ্গার আরতিতে মানুষের সকল পাপ নাকি
ধুয়ে যায় । সেই আশায় মানুষ আসে সেখানে । রাতের ঘন আঁধার তখন ঘিরে ধরেছে
হিমালয়কে । দূর থেকে পাহাড়ের মাথায় ঝিকমিক আলো দেখে জানলাম মনসাদেবীর
মন্দিরের কথা । ওটি মনসা পাহাড় । মনসা পাহাড়ে মনসাদেবীর মন্দিরে গিয়েছিলাম
খুব ছোটবেলায় । কত যে সাধুসন্তরা পর্ণকুটিরে বাস করে পাহাড়ের ওপরে উঠলে তা
দেখা যায় । কিছু দূর গেলে কঙ্খল । সাধুসন্তদের জায়গা । আগের দিন সন্ধ্যের
গঙ্গারতি না দেখার দুঃখ ভুলালাম পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই হর কি পৌরিতে
আবার পৌঁছে। সূর্য তখনো ওঠেনি । আকাশে একফালি শুক্লপক্ষের চাঁদ রয়েছে ।
বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে গঙ্গার ধারে । কিন্তু আলোর রোশনাই গঙ্গার জলে ।
আরতির তোড়জোড় চলছে । কতকত মানুষ ঘুম ভুলে, আলস্য ছেড়ে জমায়েত হয়েছে সেই
আরতি দেখার জন্য । ঠিক ছ'টা বেজে পাঁচ মিনিটে আরতি শুরু হল । পুরোহিতের
হাতে মনে হল একশো আট প্রদীপদান । সাথে গঙ্গার স্তবস্তুতি আর জয়ধ্বনি ।
ঊষার আকাশ বাতাস অণুরনিত হতে লাগল । আমার গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মনে হল মানুষ
ঈশ্বরের কি বিচিত্র সৃষ্টি ! তারা গঙ্গার আকর্ষণে কেমন আবিষ্ট হয়ে আসে
এখানে । জগতে কত কিছু পরিবর্তন হয় কিন্তু মানুষের ধর্মচেতনা অক্ষয় অব্যয় ।
কি অপূর্ব এই আরতির দৃশ্য । কি সম্মোহনী শক্তি মা গঙ্গার ! যাইহোক ভোরের
সেই গঙ্গারতি লেগে রয়ে গেল দুচোখে । হোটেলে ফিরে এসে সম্পূর্ণ নিরামিশ
প্রাতঃরাশ । কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরপুর । একধারে ইডলি-দোসা-সম্বর্-চাটনী
অন্যদিকে পরটা-টক দই-আচার । সাথে কুচোনো ফল, দুধ-কর্ণফ্লেক্স তো আছেই ।
এবার হৃষিকেশ যাবার তোড়জোড় ।
গত ২২শে অক্টোবর কলকাতা ছেড়ে বেরিয়েছিলাম উত্তরাখন্ডের পথে । দিল্লী থেকে হরিদ্বার । সন্ধ্যে আর ঊষার গঙারতি দেখে মন ভরে গেল । এই নিয়ে তিনবার হোল আমার হরিদ্বার ভ্রমণ । সেখানে একরাত ; পরদিন, ২৩শে অক্টোবর হরিদ্বার থেকে দেরাদুন জেলার অন্যতম তীর্থক্ষেত্র হৃষিকেশের পথ পড়ল ।
দেরাদুন জেলার অন্তর্গত হৃষিকেশ কে বলা হয় "place of sages" অর্থাত ঋষিদের
বাসস্থান । কেউ বলেন জটাজুটধারী হিমালয় যেন ঋষির কেশের মত বেষ্টন করে
রেখেছে এই স্থানকে । আবার কারো মতে হৃষীকেশের অর্থ 'হর্ষ বা আনন্দ, কেশ বা
মস্তকে যাঁর অর্থাত ভগবান বিষ্ণু' । এক হৃষিকেশ প্রবহমান গঙ্গার সমতলে
অবস্থিত শান্ত এক শহর । ৫ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মণ ঝুলা । গঙ্গার ওপরে
হ্যাঙ্গিং ব্রিজ । আদিতে যা ছিল একটি পাটের দড়ি নির্মিত; রামচন্দ্র নাকি
রাবণ বধ করার জন্য গঙ্গার তীরে তপস্যা শুরু করেছিলেন এবং তখন লক্ষ্মণ
নাকি পায়ে হেঁটে সেই সেতু অতিক্রম করেছিলেন । ১৮৮৯ সালে লোহার রজ্জু এবং
কংক্রীটের পিলারে নির্মিত হয় এই ব্রিজ । ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে গঙ্গার জলে
বিশালাকার মহসীর মাছ দেখা যায় । পুণ্যার্থীরা মুড়ি, পয়সা, মাছের খাবার
ফেলে ব্রিজের ওপর থেকে । কপাল ভালো হলে মাছটিকে দেখাও যায় । বলে নাকি এই
মহসীর মাছই হল বিষ্ণুর মত্স্য অবতারের আসল রূপ । তবে কাছেই তেহরীর ড্যামের
জন্য গঙ্গার প্রবহমানতা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত এবং মাছেদের আগমনও অতটা
সুনিশ্চিত নয় । কাছেই আছে মুনি কি রেটি, রামঝুলা এবং নীলকন্ঠ মহাদেব
মন্দির ।
হরিদ্বার পেরোতে লাগল একে একে হৃষিকেশ, রামঝুলা, লক্ষমণঝুলার পথ ফেলে রেখে ।
হনুমান আমাদের চলার পথে একমাত্র দৃশ্যমান সজীব । গঙ্গা আমাদের নীচে চলে
গেল । আমরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে ব্যাসি, তিনপাণি পেরোলাম । শিবালিক বর্ডার রোড
অর্গানাইজেশন না থাকলে এই পাহাড়ি পথ যে কি হত তা ভাবলে ভয় করে । বর্ষায় কত
ল্যান্ডস্লাইড এর অবশিষ্ট পড়ে রয়েছে তার ইয়ত্ত্বা নেই । রিভার রাফটিং হয়
নদীতে । দেবপ্রয়াগ এল কিছুক্ষণেই । দেবপ্রয়াগ হল পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম ।
এটি ভাগিরথী এবং অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল ।এটি বর্তমানে তেহরী গাড়োয়াল
জেলার অন্তর্গত ।
এখানে ১০০০০ বছরের প্রাচীন রঘুনাথজীর মন্দির আছে । ২২ কিমি দূরে
চন্দ্রবাদানী পাহাড়ের ওপর সতীমায়ের মন্দির আছে । দক্ষযজ্ঞের পর সতীর ধড়
পড়েছিল এখানে । এই পাহাড়ের ওপর থেকে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ এবং সিরকান্ডার
অপূর্ব মোহময় তুষারশৃঙ্গ দর্শন করা যায় । দেবপ্রয়াগের অতি নিকটেই ৩০৪৮
মিটার উঁচু হিমালয়ের আরেক পর্বত শৃঙ্গ নাগটিব্বা । ট্রেকিং করতে বহু মানুষ
এখানে যান । নামলাম গাড়ি থেকে আর ছবি নিলাম প্রয়াগের । দুটো নদীর জলের
রঙের সুন্দর তফাত করা যায় । ভাগিরথীর রং ঘোলাটে । অতটা পথ ওপর থেকে নেমে
এসে কিছুটা বয়সের ভারে ন্যুব্জ । অন্যদিকে অলকানন্দা মরকত মণির মত চিরনবীন ,
চিরসবুজ । দেবপ্রয়াগে দুজনে মিলিত হয়ে গঙ্গার সৃষ্টি করেছে । ভাগিরথী
এবং অলকানন্দার ওপর নির্মিত ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে ঘুরে
এলে নদী এবং পাহাড়ের একাত্ম হয়ে যাওয়া রূপ দেখে যেন মন ভরেনা । বাতাসে
হালকা হিমেল ছোঁওয়া । শীত পড়ছে ধীরে ধীরে । কার্তিক মাসের শুরুতে ভোররাতে
বেশ শীত করে । তবে রোদমাখা দিন বেশ আরামের ।
এবার রুদ্রপ্রয়াগের দিকে । যেখানে সেই বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দা এসেছে আর
কেদারনাথ থেকে নেমে মন্দাকিনী এসে মিশেছে অলকানন্দায় । রুদ্রপ্রয়াগ আগে
ছিল কিছুটা চামোলী জেলায় ও কিছুটা তেহরীতে । এখন রুদ্রপ্রয়াগ নামে একটি
নতুন জেলা হয়েছে । ২৩২৮ বর্গকিমি স্থান জুড়ে, সমুদ্র থেকে ৬১০ মিটার
ওপরে হিমালয় আর এই দুই নদীর মোহময়তায় আবিষ্ট এই সঙ্গম তীর্থ । পুরাণে
কথিত আছে মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য নারদ মুনি রুদ্রপ্রয়াগে তপস্যা
করেছিলেন । মহাদেব তাঁর রুদ্ররূপ ধরে নারদের সামনে এসে তাঁকে আশীর্বাদ করেন
একটি বীণা উপহার দেন । নারদ এই স্থানে শিবের মহিমায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে
ব্যুত্পত্তি লাভ করেন । দক্ষযজ্ঞের পর সতী এইস্থানে নাকি পুনর্জন্ম লাভ
করেন । যক্ষের অলকাপুরী থেকে নেমেছে অলকানন্দা আর কেদারনাথ থেকে অবতরণ
করেছে মন্দাকিনী । মন্দাকিনীর জল যেন জল নয় । পান্নার কুচি বয়ে নিয়ে চলেছে
। তার অবিরল কুলকুচি সেই পান্নাপাথরের । কথিত আছে রুদ্রপ্রয়াগের
অন্তর্গত মানা গ্রামে ব্যসগুহায় বসে গণেশ বেদ লিখেছিলেন । এই মানা গ্রামটি
তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, তুষারশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত এবং স্থানমাহাত্ম্যের
জন্য আজো অমলিন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ।ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে তীর্থ
যাত্রীদের আপ্যায়ন করার জন্য । সঙ্গমের সন্নিকটে রয়েছে ছোট্ট জগদম্বা
মন্দির । পথে থামলাম । সরু পাহাড়ি পথ ধরে নীচে নামলাম । নদীর নীলচে সবুজ
জলের প্রকৃত রং দেখা বলে । হ্যাঙগিং ব্রিজ দিয়ে পেরোলাম পথ । তারপর চোখে
পড়ল সেই সঙ্গম ।একটি দেবলোকের নদী অন্যটি ব্রহ্মলোকের । রুদ্রপ্রয়াগে
রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে । একটি রাস্তা কর্ণপ্রয়াগ হয়ে অলকানন্দার তীর ঘেঁষে
সোজা বদরীনাথের দিকে চলে গেছে আর অন্যটি কেদারনাথের মন্দিরের দিকে উঠে গেছে
মন্দাকিনীর ধার দিয়ে দিয়ে । মন্দাকিনী নিজের সবটুকু দিয়েছে অলকানন্দাকে
উজাড় করে । আর অলকানন্দা নিয়েছে দুহাত ভরে । তারপর সারাটা রুদ্রপ্রয়াগ
জুড়েই মন্দাকিনীর রূপ । রুদ্রপ্রয়াগের প্রাচীন শিব মন্দির রুদ্রনাথ বা
রুদ্রেশ্বর পাহাড়ের ওপর ২২৮৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত । এটি পঞ্চকেদারের একটি
। আরো ওপরে উঠলে পড়বে নারদশীলা যেখানে নারদ তপস্যা করেছিলেন ।
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৩ কিমি দূরে অলকানন্দা নদীর ধার ধরে গেলে পড়বে
কোটেশ্বরের গুহা মন্দির । এখানে প্রকৃতির ইচ্ছায় অবিরত সৃষ্টি হচ্ছে
শিবলিঙ্গ এবং যার ওপর পড়ছে অবিরাম জলের ফোঁটার ধারাবর্ষণ। রুদ্রপ্রয়াগের
স্থানমাহাত্ম্য এই জেলাকে ভিত্তি করে পঞ্চকেদারের ব্যাপ্তি জুড়ে ।
মহাদেবের এই পাঁচটি বিশেষ স্থান হল কেদারনাথ (৩৫৮৪মি), মদমহেশ্বর (৩২৮৯
মি), তুঙ্গনাথ (৩৮১০ মি), রুদ্রনাথ (২২৮৬মি) এবং কল্পনাথ বা কল্পেশ্বর
(২১৩৪ মি) । মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পান্ডবদের মনে বড়ই
আত্মীয়হত্যার পাপবোধ হতে লাগল । তখন শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যান্য মুনি ঋষিদের
পরামর্শে পান্ডবেরা সেই ব্রহ্মহত্যার দায় থেকে মুক্তি পাবার আশায় শিবের
ক্ষমাপ্রার্থী হলেন । মহাদেব নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন নন্দী নামক ষাঁড়টির
ছদ্মবেশ ধরে । এবং সেই স্থানে যার নাম গুপ্তকাশী ।
কিন্তু পান্ডবরা নন্দীর রূপ বুঝতে পেরে গেলেন এবং ভীম নন্দীর লেজ এবং
পিছনের পাদুটি ধরতে গেলেন । অতঃপর নন্দীরূপী মহাদেব পালিয়ে মাটির নীচে
গুহার মধ্য দিয়ে আত্মগোপন করলেন । শিবের এই আত্মগোপনের বহিঃপ্রকাশ রূপে
ভবিষ্যতে তীর্থক্ষেত্র রূপে আজো দাঁড়িয়ে রয়েছে কেদারনাথ যেখানে নদীর পিঠের
কুঁজ ছিল । মুখটি ছিল রুদ্রপ্রয়াগে । হাতদুটি ছিল তুঙ্গনাথে । নাভি এবং পেট
ছিল মদমহেশ্বরে আর কেশরাজি কল্পেশ্বরে । এই পাঁচটি স্থানই হল শিব মহিমা
সম্পন্ন পঞ্চকেদার ।
কেদারনাথ যেতে হয় গৌরীকুন্ড হয়ে । এখানে একটি পার্বতী মন্দির ও একটি গরম
জলের কুন্ড আছে । এখানে পার্বতী মহাদেবের তপস্যা করেছিলেন । গৌরীকুন্ড
থেকে ১৪ কিমি ভয়ানক দুর্গম পথে কেদার যাত্রা হয় । পায়ে হেঁটে গেলে সাতঘন্টা
সময় লাগে । ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া যায় । কেদারনাথ শিবমন্দির হল ভারতের দ্বাদশ
জ্যোতির্লিঙ্গের একটি । কেদারনাথ থেকে ৩কিমি দূরে চোরবারি গ্লেসিয়ার থেকে
উত্পন্ন হয়েছে মন্দাকিনী নদী । কেদারনাথ শিবলিঙ্গের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে
মন্দাকিনীর ধারা । মন্দিরে উঠতে কষ্ট হয় কিন্তু একবার উঠতে পারলে মনে হয় "
আহা কি দেখিলাম ! " মন্দির চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তুষারপাত ।
প্রতিপ্রহরে শিবপূজা হয় আর সাথে হয় এলোমেলো , খাপছাড়া তুষার বৃষ্টি । ১৯৯৭
সালে মে মাসে কেদারনাথ এসেছিলাম । এখনো দুচোখ বুঁজলে দেখতে পাই প্রকান্ড
হিমালয়কে সাক্ষী রেখে ঘোড়ায় করে চলেছি সেই দুর্গম পথ । একপাশে পাহাড়ের
দেওয়াল আর অন্যপাশে গভীর খাদ । আর আমার সাথে সাথে সেই ১৪ কিমি এলোমেলো,
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে চলেছে অসীম, অনন্ত হিমালয় তার শাখা প্রশাখা মেলে,
গায়ে তার ঝরে পড়েছে বিনুনীর মত গ্লেসিয়ার। পাহাড়ের চূড়া থেকে এঁকেবেঁকে
নেমে নীচে এসে হারিয়ে গেছে কোন অজানা নদীর বুকে । কোথাও তার চোরাস্রোত
পাহাড়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে গেছে । রুদ্ধ হয়েছে তার গতি । কখনো ঝরণার গান, কখনো
চুঁইয়ে পড়া ঝোরার কলকাকলি । আর মনে পড়ে ঠান্ডার কথা । যত রোদ বাড়ে তত
ঠান্ডা বাড়ে । যেতে যেতে কর্পূর শুঁকছি, চকোলেট আর খেজুর খাচ্ছি যাতে
ঠান্ডা না লেগে যায় । মুখ ছাড়া আপাদমস্তক ঢাকা আমার তবুও যেন পথের
দুর্গমতার ভয়ে হিম হয়ে আসে রক্ত । আর আমার সাথে আরেকটি ঘোড়ায় আমার ছ'বছরের
ছেলেকে দেখে বার বার মনে হচ্ছিল একে কেন মায়ের কাছে রেখে এলাম না । ছেলের
বাবা তখন লাঠি নিয়ে হাঁটছেন আমাদের পিছনে ।
এবার আরো নীচে নেমে এলাম । যাবার পথে ল্যান্ডস্লাইড পড়ল । এবার গুপ্তকাশীর
পথে । চলতে লাগল মন্দাকিনীর ধারা । তবে ঊষার শুকতারা নেই । তার বদলে
গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে তখন সূর্য অস্তাচলে । রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ১৮ কিমি
দূরে পড়ল অগস্ত্যমুনি । এখানে ঋষি অগস্ত্য তপস্যা করেছিলেন । মন্দাকিনীর
সাথে লুকোচুরী খেলা শেষ। জায়গাটা বেশ সমতলী । চাষ-আবাদও বেশ হয়েছে ।
স্কুলের ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে তখন । কখনো সখনো তন্বী, শিখরা,
গৌরী, গাড়োয়ালী যুবতী, পিঠে বিশাল ঝুড়ি । গুপ্তকাশী পৌঁছনো হল সেই বিকেলে ।
হোটেল সাদামাটা কিন্তু পরিচ্ছন্ন । আর প্রোফেসর মালিকের দুই অর্ডারলি
আমাদের সঙ্গী হল সর্বক্ষণের । কমল নামে একটি ছোট্ট ছেলে আর দীপক নামে এক
বুড়ো । আসামাত্রই ধূমায়িত আদা-চা । রাতে গরম গরম রুটি , সবজী আর ডাল ।
গুপ্তকাশীতে একটা বহুপুরোণো শিবমন্দির দেখলাম । সেখানে নাকি
মহাভারতের যুদ্ধের পর পান্ডবদের কৃত সকল পাপামুক্তি হয়েছিল । শিব এবং
পার্বতীর একত্র অর্ধনারীশ্বরের মূর্তি এই জাগ্রত মন্দিরে । আর গঙ্গোত্রীর
থেকে গঙ্গা আর যমুনোত্রী থেকে যমুনা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে
দুটি মুখ দিয়ে পড়ছে একটা কুন্ডে । দুই জলের স্বাদও সম্পূর্ণ আলাদা ।
জ্ঞাতি হত্যার বিবেকদংশন সহ্য না করতে পেরে পান্ডবরা প্রথমে কাশী বা
বারাণসীতে গিয়েছিলেন কাশীমহেশ্বরের কাছে সেই পাপস্খলনের উদ্দেশ্যে ।
কিন্তু তাদের পাপের বোঝা এতই বেশি যে মহাদেব তা দেখে সেই পাপ তো স্খালন
দূরের কথা তিনি নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন । পান্ডবরা খবর পেলেন যে শিব
উত্তরকাশীতে লুকিয়ে রয়েছেন । পান্ডবরা ধাওয়া করে সেখানে এলেন কিন্তু
সেখানেও শিব তাদের পাপের বোঝা নিতে অক্ষম হয়ে এবার গুপ্তকাশীতে এসে আশ্রয়
নিলেন আত্মগোপন করে । পান্ডবরা আবার পৌঁছে গেলেন গুপ্তকাশী কিন্তু মহাদেব
ভাবলেন যে তিনি একলা এই পরিমাণ পাপের বোঝা নিতে পারবেন না তাই পার্বতীকে
বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেই পাপ তার সাথে ভাগ করে নিতে বললেন এবং দুজনে একত্রিত হয়ে
অর্ধনারীশ্বর রূপে পান্ডবদের সামনে উপস্থিত হলেন ...
গুপ্তকাশীর ছিল বড় সুন্দর । ঘর থেকে গাড়োয়াল হিমালয় দেখলাম দুচোখ ভরে । ভোর হল চা হাতে কমলের মুখ দেখে । কিছুপরেই এল গরমাগরম আলুপরোটা
আর সাথে আচার । অভাবনীয় প্রাতঃরাশ সেই মুহূর্তে বেড়ানোর আনন্দকে আরো বাড়িয়ে
দিল ।
পাহাড়ের কোলে ছোট্ট পুরোণো শহর গুপ্তকাশী । ব্রেকফাস্ট, স্নান সব সেরে
নিয়ে সকাল সাতটায় আমাদের যাত্রা শুরু হল চামোলি জেলার চোপতার পথে । গাড়ি
যেই চলতে শুরু করল পাহাড়ের মাথায় বরফ দেখে আমরা যারপরনাই উত্তেজিত । রোদ
উঠে গেছে ততক্ষণে আর পাহাড়ের বরফচূড়া সেই আলোয় রূপোর মত চকচক করছে । এবার তুঙ্গনাথ অভিযান । মন্দাকিনীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে বরফচূড়ায় চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে যেতে লাগলাম ।
গুপ্তকাশী থেকে চোপতার পথ ৪৫ কিলোমিটার । আরো চড়াই পথ পড়ল । যত এগিয়ে এল
চোপতা ততই পথ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হ’ল । সরু রাস্তা । গাড়ির পথটুকুও
ভয়ানক দুর্গম । না জানি পায়েহাঁটা তুঙ্গনাথের পথ আরো কত দুর্গম হবে সেই ভয়ে
সিঁটিয়ে গেলাম । অবশেষে চোপতা এল সময় মতন । গাড়ি নীচে রেখে সকাল দশটায়
চোপতা থেকে আমাদের হাঁটা শুরু করলাম তুঙ্গনাথের পথে ।
চোপতা থেকে পায়ে হেঁটে তুঙ্গনাথ যেতে সময় লাগে আড়াইঘন্টা। বাঁধভাঙা
আনন্দের উচ্ছ্বাস আর মনের জোর নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম । তুঙ্গনাথের পথ শুরু
থেকেই চড়াই ফলে কিছুদূর গিয়েই মনে হয় আর পারবনা পৌঁছতে, দম ফুরিয়ে যায় ।
পাথরের বাঁধানো ধাপকাটা পথ কিন্তু শুরু থেকেই চড়াই । কেদারনাথে পথ খুব বিপদ
সঙ্কুল যার একপাশে খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়ের গা। কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি
অতটা চড়াই নয় । তুঙ্গনাথের পথ শুরু থেকেই চড়াই ফলে কিছুদূর গিয়েই মনে হয়
আর পারবনা পৌঁছতে, দম ফুরিয়ে যায় । অক্সিজেন কম পড়ছে বোধ হয় । ফুসফুস আর
টানতে পারছেনা । যেমন করেই হোক আমাকে পৌঁছতে হবেই । পৃথ্বীশ আমার কষ্ট
দেখলেই বলছে বসে নাও, জিরিয়ে নাও । তাড়ার তো কিছু নেই । ছোট ছোট স্টেপ ফেল
। মরুতীর্থ হিংলাজ সিনেমার সেই দৃশ্য ভাসছে চোখের সামনে "পথের ক্লান্তি
ভুলে..."
বল গো ঠাকুর কবে তোমার দেখা পাব ?
অক্সিজেন কম পড়ছে বোধ হয় । ফুসফুস আর টানতে পারছেনা । কিছুটা চলি তো আবার
বসে বিশ্রাম করি পাহাড়ের গায়ে । নির্জনতা আমাদের সঙ্গী আর অদম্য মনের জোর
আমাদের পাথেয় । শব্দ বলতে দাঁড়কাকের আওয়াজ আর দু একজন ঘোড়ারোহীর কৃপায়
ঘোড়ার গলার টুংটাং, আর রডোডেনড্রণের শুকনো পাতা টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ ।
মিষ্টি লাগে শব্দটা কিন্তু পথের ক্লান্তিতে সেটাও উপোভোগ করতে কষ্ট হ’ল ।
হিমালয়ের এলপাইন অঞ্চলে তুঙ্গনাথ । তাই সবুজ গাছপালা অতি বিরল ।
চোপতা
থেকে ৩৫০০ ফুট উঠতে হবে এমন চড়াই পথ বেয়ে ! একবার ভেবেছিলাম ঘোড়া নেব
কিন্তু কেদারনাথ ঘোড়ায় গিয়ে দেখেছিলাম ঘোড়ায় বসে কেবলি মনে হয় এই বুঝি সে
পড়ে যাবে এই বুঝি আমি খাদে পড়ে যাব কিন্তু নিজে হাঁটলে প্রকৃতির রূপ রস
গন্ধ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাবে সেই ভেবে পায়েহাঁটার চেষ্টা….
একটু জল খাচ্ছি আবার
হাঁটছি । দূর থেকে তুঙ্গনাথের মন্দিরের বিশাল ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে ।
বুঝলাম কাছাকাছি এসে পড়েছি । মনের জোরে শেষমেশ পৌঁছলাম তুঙ্গনাথ ১২৫০০ ফুট
উচ্চতায় । বেশ হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ওপরে । মেঘলা আকাশ। রোদের প্রখরতা
এক্কেবারে নেই । দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরল গায়ে । তবে ওপরে পৌঁছে
মন্দিরের বিশাল হলুদ ধ্বজা দেখতে পেয়ে মনে বড় আনন্দ হল । at last the goal
is achieved! মন্দিরচত্বরে যত্রতত্র তুষারপাত হয়েছে । দর্শন দিলেন
তুঙ্গনাথ স্বয়ং । গৌরীকুন্ড থেকে কেদার ১৪ কিলোমিটার ; কেদারনাথের উচ্চতা ১১৭৫০ ফুট আর
তুঙ্গনাথের উচ্চতা ১২০৭০ফুট । তুঙ্গনাথ পৃথীবীর মধ্যে সর্বোচ্চ শিব মন্দির
।
তুঙ্গনাথ থেকে নীচে নেমে এসে চোপতায় এসে দুপুরের খাবার সারলাম আগুণ গরম
টোম্যাটো স্যুপ আর ভেজ-ম্যাগি দিয়ে । সেই মূহূর্তে গরম খাবারের খুব প্রয়োজন
ছিল । অনেকটা ক্লান্তি লাঘব হল । গাড়িতে ফিরে এসে আবার পথ চলা । এবারের
গন্তব্যস্থল উখীমঠ । উখীমঠ রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মাত্র ৪১ কিমি দূরে ।
পাহাড়ের ওপর ১৩১১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ছোট্ট শহর । উখীমঠের
সংস্কৃত নাম ঊষামঠ । পুরাকালে বানাসুরের রাজধানী ছিল এটি ।
দীপাবলীর পর
যখন কেদারনাথ মন্দির বন্ধ হয়ে যায় তখন বিগ্রহ নিয়ে স্বয়ং পুরোহিত মশাই বা
রাওয়াল উখীমঠে এসে আশ্রয় নেন ছ'মাসের জন্য । দেখলাম সেই মন্দির আর
পুরোহিতের থাকবার আশ্রম । পাহাড়ের ওপর থেকে একফালি নীলচে রংয়ের মন্দাকিনী
চোখে পড়ে যার একপাশে গুপ্তকাশী আর অন্যপাশে উখীমঠ । খুব শান্ত নিসর্গ ।
সূর্যাস্তের কাছাকাছি আমরা তখন । তুঙ্গনাথের পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে এখানে
এসে বসে একটু জিরেন হল। কাছেই আছে দেওরিয়া তাল বা লেকটি ।
এবার হোটেলে ফিরে এসে মুখ হাত-পা ধুয়ে গরম চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে লিখতে
বসে গেলাম আমার রোজনামচা । মনে একটু খচখচানি এই যে হরিদ্বারের পর আর নেট
কানেকশান পাওয়া গেলনা বলে । যাইহোক রাতের খাওয়া সেরে নিলাম যথারীতি গরম
রুটি, ডাল আর সবজি দিয়ে ।
পরদিন ভোরে চা-জলখাবার, স্নান সেরে নিয়ে আবার
বেরিয়ে পড়া উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে । এইটি হোল সবচেয়ে দীর্ঘতম জার্ণি ।
সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু হল গুপ্তকাশী থেকে। একে একে পেরোলো ভিরী, তিলওয়াড়া ।
তেহরী বাইপাস করে ঘনশালী । পথে পড়ল লাস্তার নদী । সূর্যপ্রয়াগে লাস্তার
নদী মিলিত হয়েছে মন্দাকিনীর সাথে । এখানে সকলে সূর্যের তর্পণ করতে আসে ।
কবীরের দোঁহায় বলে "পাথর পূজে হর মিলে ম্যায় পূজে পাহাড় তাতে ওয়াচাকে বলি ইস খায় সংসার "
ঘনশালী
বাজার এল বেলা বারোটা নাগাদ । ধনতেরস আর দীপাবলীর বাজার রমরমিয়ে চলছে ।
সেদিন ছিল ভূতচতুর্দশী । রংচং দিয়ে নানারকম মিষ্টি, শুকনো ফল আর
আতসবাজির মহা পসরা । ভীলগঙ্গার ওপর ছোট্ট সেতু পেরোলাম । তারপর বালগঙ্গা ।
চানিয়ালি, প্রেমনগর সিলওয়াড়া হয়ে তেহরী । কেমুন্ডা খাল পেরোলাম । সেখান
থেকে উত্তরকাশী আরো ৬৩ কিলোমিটার । বিকেল তিনটেয় পৌঁছলাম উত্তরকাশী ।
ভাগিরথীর তীরে বারাণসীর মত পুরোণো, ঘিঞ্জি শহর কিন্তু নদীর এতই কাছে যে
হোটেলে ঢুকে নদীর নীল জল দেখতে পেয়ে মনে হল, আপাততঃ অলিগলি, ঘিঞ্জি,
কোলাহল, বাজার এই কয়েকটা শব্দ না হয় বাদ থাক আমার অভিধান থেকে । এতগুলো
শহরের মধ্যে উত্তরকাশীতে এসে আবার কোন এক ভালোলাগায় আবিষ্ট হলাম । সাদামাটা
হোটেল কিন্তু খাটে শুয়ে হিমালয় আর তার কোল জুড়ে ভাগিরথীর নীল জল আর সাদা
ফেনিল জলরাশির কুলকুচি ।
নীল ভাগিরথী সাদা ঘাগরার কুঁচি লুটিয়ে নেচে নেচে চলেছে উত্তরকাশীর এমাথা
থেকে ওমাথা । নদীর ধার দিয়ে দিয়ে কত পুরোণো মন্দির আর সাধুবাবাদের আশ্রম ।
ঠিক যেন পুরোণো কাশীবিশ্বনাথের বেনারস । সেখানেও গঙ্গার ধার দিয়ে অসংখ্য
মন্দির আর আশ্রম । উত্তরকাশীতে একবার তেত্রিশকোটি দেবদেবীদের ভেট হয়েছিল
বিশ্বনাথ মন্দিরে । তার কারণ হল দেবতা আর অসুরদের যুদ্ধ যখন শেষ হচ্ছিলনা
তখন মাদুর্গা এখানে একটি বিশালাকায় ত্রিশূল প্রোথিত করে এই দেবভূমির ঘাঁটি
আগলে ছিলেন । এই হল উত্তরকাশী । সেই শক্তিমাতার ত্রিশূল এখনো অক্ষত । তাকে
কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দিয়ে হেলানো যায় কিন্তু হাতে করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে
বিন্দুমাত্র নাড়ানো যায়না । মহাদেব নাকি এই বিশাল অষ্টধাতুর ত্রিশূল দিয়ে
বকাসুর বধ করেছিলেন ।
মহাদেব মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে পরশুরাম, লর্ড একাদশ রুদ্র এবং কালীর
মন্দির । ভাগিরথীর তীরে রয়েছে অগণিত আশ্রম ও ঘাট । ভাগিরথীর জলের তখন পড়েছে
সূর্যাস্তের রং । ভূত চতুর্দশী তিথি সেদিন । কিছু পরেই নিশ্ছিদ্র আঁধারে
ঢেকে যাবে নদীর তীর । সাধুবাবারা গঞ্জিকা সেবনের তোড়জোড় করছেন তখন ।
মন্দিরে বাজছে সন্ধ্যারতির ঘন্টা । আমি যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম
নদীর দিকে । নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলেছে ভাগিরথী আপনমনে
। এই জায়গাটিতে গেলাম । নদীর ধারে বড়ই মনোরম স্থান । আর মন্দিরের পাশ
দিয়ে পায়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে পড়বে এক একটি ঘাট । আমরা কেদারঘাটে
গেলাম ও জলে পা ডোবালাম । এটি একটি শ্মশান ও বটে । প্রাকৃতিক দৃশ্য , নদীর
শব্দ মিলে মিশে একাকার এখানে । ঘাট থেকে আমাদের কালীঘাটের মন্দিরের মত
সরুগলি দিয়ে দিয়ে বাজারে এলাম । ধনতেরসে ধাতুজ দ্রব্য কেনে আধুনিক
ভারতবর্ষের সকল মানুষ । বাঙালীদের মধ্যেও অবাঙালি এই প্রথা চালু হয়ে গেছে ।
তাই আমিও ব্যাতিক্রমী হলাম না । দেবভূমির এই পবিত্র স্থানে পুণ্যতোয়া
ভাগিরথীর তীরে এক বাসনের দোকান থেকে কিনে ফেললাম পছন্দের তামার দ্রব্যাদি ।
রকমারী ঘটি আর কমন্ডলু । আমার ধনতেরসের লক্ষ্মী আগমনী হোল । কৃষ্ণা
চতুর্দশীর ছমছমে অন্ধকার তখন । আমার মাথায় ঝিমঝিম করছে হিমালয়ের নেশা । আর
হিমালয়ের মাথার নীচে জোনাকীর মত আলোর বসতি ফুটফুট করে জ্বলছে । থিকথিকে
সেই আলোর বাসা । উত্তরকাশীর অলিগলি, উত্তরকাশীর ব্যস্ত শহরতলী । মোম কিনে
এনে হোটেলের ঘরে এসে চৌদ্দপ্রদীপের নেমকম্ম সমাধা করলাম । কি সুন্দর একটা
শহর । কাশী বেনারসের গন্ধ রয়েছে যেন । অথচ আরেকটু যেন ছিমছাম ।
জটাজুটসমাযুক্তাং নগাধিরাজ হিমালয় আর তার থেকে নেমে এসেছে অগণিত
স্রোতস্বিনী । দেবাদিদেব মহাদেবের আনন্দধারা গড়িয়ে পড়েছে সেই স্রোতস্বিনীর
কমন্ডলু থেকে । হরের দুয়ারে কিম্বা হরির দ্বারে । যেখানেই হোক আমার চোখ
সার্থক করেছে দেবভূমির আকাশের নীলরং, কিন্তু তবু ভরিল না চিত্ত ! বাতাসে
বরফগলা পুণ্যতোয়া নদীদের কলকলানি এখনো লেগে রয়ে গেল দুকানে । কিসের জন্য
এই কৃচ্ছসাধন? কেন রসাতল সমতলী জীবনযাপন, দীপাবলীর ভোগবিলাস ? শুধুই কি
আত্মতৃপ্তি না কি দেবলোকে দার্শনিক হবার লোভ সংবরণ করতে না পারা ? অফুরান
জীবনের পথের ধারে রেখে এলাম সেই নুড়িপাথরগুলোকে । হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম
ভালোলাগার রেশটুকুনি । পাহাড়চূড়োর কত না জানা কথাকাহিনীরা তখন ভীড় করেছে
আমার মাথায় ।
কাছেই দেখি মহানগরের সেই ভীড় রাজপথ ।
গুপ্তকাশীতে মহাদেব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর মন্দির
এ দৃশ্য কখনো পুরোণো হয়না । স্থানকালপাত্র ভেদে অবর্ণনীয় । অমোঘ এই আকর্ষণ । ভাষাতীত এই সৌন্দর্য্য ।
১৯৯৭ সালে গৌরীকুন্ড হয়ে কেদারনাথ এসেছিলাম ঘোড়ায় করে আর পায়ে হেঁটে ফিরেছিলাম ।
কেদারনাথ শিবমন্দির
। তুঙ্গনাথ পঞ্চকেদারের একটি ।
তুঙ্গনাথ শিবমন্দির
।
উখীমঠ
অতুলনীয় হিমালয়
আরো হিমালয়