আমরা
সেদিন হঠাত বেরিয়ে পড়েছিলাম
পাঁচজনে । গাড়ি নিয়ে খড়গপুর
থেকে তমলুক । গুগ্ল ম্যাপে
মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে
পড়া আরকি । আর অগতির গতি
স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর
জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব
মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট
হেড কোয়ার্টার্স । এককালে
যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত ।
পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে
সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই
তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম
প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর
এর খুব কাছে । সেদিন ছিল
শ্রাবণের আধো আলো আধো ছায়ায়
মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের
একটা ছুটির দিন ।
কোলকাতা
মুম্বাই রোড ধরে ন্যাশানাল
হাইওয়ে সিক্সের ওপর দিয়ে
কোলাঘাট । কোলাঘাট থেকে হলদিয়া
হাইওয়ে ধরে দীঘার রাস্তা
ধরালাম । রোদবৃষ্টির খেলা
চলল সাথে । সবুজ ক্ষেত,
শ্রাবণী বনানীতে
এবার বর্ষা অধরা । বৃষ্টিতে
এদের সজীবতা আরো প্রকট হয় ।
কিন্তু এবার এদের শ্যামলতা
কিছুটা নিষ্প্রভ । ধান নেই
মাঠে । তবুও হাওয়ায় মৌসুমী
গন্ধ । ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি
নিয়ে তমলুক এল। বাঁদিকে বেঁকে
গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে কেলোমাল
গ্রামের মধ্যে দিয়ে লেভেলক্রসিং
টপকে যাচ্ছি তখন । দীঘার ট্রেন
এই রেলপথে যায় বুঝি । স্টেশনের
নাম শহীদ মাতঙ্গিনী । এবার
তমলুক-পাঁশকুড়া
বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার,
জেলখানা মোড়,
চক্রেশ্বর পেরিয়ে
বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি
মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান
থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে
।
দেবী
বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের
অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে
ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে ।
প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী
অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের
মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের
উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের
যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয়
রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে
এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ
করত । একদিন সে পথে আসার সময়
তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার
একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে
ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি
জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে
গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ
সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা
গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি
আসীন একটি বেদী দেখতে পান
সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা
শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা
নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের
আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী
বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা
করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয়
কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের
সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি)
তমলুকের এই অংশে
পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি
শক্তিপিঠের অন্যতম ।
কিংবদন্তীর
কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস
করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন
দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর
অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী
। মূল মন্দিরের গঠনরীতিও
চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার
সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের
মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে
নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে
দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন
করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও
রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির
। উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন
একটি কুন্ড আছে । মন্দিরের
বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর
২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র
আছে ।
মন্দিরে
পুজো চড়িয়ে প্রসাদ খেয়ে এবার
মহাপ্রভু নিরামিষ ভোজনালয়ে
দ্বিপ্রাহরিক আহারপর্ব ।
সেখান থেকে যাওয়া হল তমলুক
রাজবাড়ি দেখতে । বিশাল চত্বরে
রাজবাড়ির অবশেষ । তাক লাগানো
বারমহল, অন্দরমহল,
বিশাল দালান,
সংলগ্ন মন্দির ঘুরে
দেখলে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয়
। মহাভারত্, ভাগবত
ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত
প্রভাব প্রতিপত্তিশালী
ময়ূরধ্বজ রাজবংশের এই বাসস্থানের
কিছুই পড়ে নেই । আছে শুধু
বট-অশত্থ্ব-পিপলের
শিকড়ে জীর্ণ রাজবাড়ির দেওয়াল
। থাম, অলিন্দ
ইত্যাদির পাশাপাশি আবডালের
চিক-মহল লক্ষ্য
করলাম যেখান থেকে হয়ত রক্ষণশীল
মহিলারা উঁকি দিতেন বারমহলে
। নূপুরের ছন্দে আর এস্রাজের
অণুরণনে হয়ত বা ভেসে যেত
রাজবাড়ির আনাচকানাচ । মাথার
ওপর দিয়ে চামচিকে উড়ে গেল ।
কিন্তু তবুও লাল ইটের স্থাপত্য
কীর্তি আজো জ্বলজ্বল করে ঝলমলে
রোদে । মনে হল "কালের
ধ্বনি শুনিতে কি পাও?"
পাশেই বিশাল পুকুরের
জলে হাত পা মুখ ধুয়ে ঠান্ডা
হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায় জিরেন
নিয়ে আবার ঘরে ফেরার পালা ।
কোলকাতা থেকে দীঘা, শঙ্করপুরের
রাস্তায় ফেরার পথে ঘুরে আসা
যেতেই পারে এই দুটি স্থান ।
সকালবেলা ৪ এপ্রিল ২০১৩
No comments:
Post a Comment