অমরকন্টক ঘুরে এসে খুব ক্লান্ত ছিলাম । পরদিন ভোরে উঠে এবার আমাদের যাওয়া লাইমস্টোনের দেশে । বিখ্যাত জবলপুর মার্বেল রকস্ দেখতে । অমরকন্টকের হোটেলে সুস্বাদু নিরামিষ প্রাতঃরাশে আহ্লাদে উদরপূর্তি হল সুজির উপমা, পরোটা-টক দৈ-আচার এবং আলুর টিকিয়া দিয়ে । সাথে ধূমায়িত চা এবং উত্তুরে হাওয়ার কনকনানি । প্রথমে যে জায়গাটিতে গেলাম তার নাম ভেরাঘাট । জবলপুরের ২২ কিমি দূরে নর্মদা নদী একটি গর্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এখানে । দুধসাদা পাথরের ওপর দিয়ে ঝরণার মত আছড়ে পড়ছে নর্মদার হাসি । ৩০ মিটার উঁচু থেকে নাচতে নাচতে পড়ছে তার জল । মাথার ওপর দুপুর সূর্য্যি নিয়ে তো দেখছি আমরা । কে যানে পূর্ণিমার রাতে এখানকার নিসর্গ কেমন হয় !
ধূঁয়াধার ফলস
নর্মদার সৃষ্ট এই গর্জটির দৈর্ঘ্য ৩ কিমি । মধ্যে মধ্যে যেন উঠে এসেছে লাইমস্টোন বা মার্বেলের পাহাড় । দুধসাদা শ্বেতপাথর অত্যন্ত নরম । আর তাই বুঝি সেই সফট ষ্টোনকে কেটে কুটে তা দিয়ে নানারকমের জিনিষ বানিয়ে পণ্য সাজিয়েছে আশপাশের স্থানীয় মানুষ । যেতে যেতে প্রচুর পাথরের পসরা দেখতে পেলাম ।
যেতে যেতে পথে পড়ল গৌরনদী । তারপর ছোট হল্ট বার্গী ড্যামে ।
বার্গী ড্যাম
দিগন্তরেখা জুড়ে বিশাল বিন্ধ্যরেঞ্জ আর তার কোলে নর্মদার কিছু অংশে এই ড্যাম । এবার সোজা ভেরাঘাট পৌঁছলাম । কেবলকারের টিকিট কেটে শূন্য থেকে নর্মদার তাথৈ নাচ দেখতে যাওয়া হল । আমরা কেবলকারের মধ্যে কাঁচের জানলা দিয়ে দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখছি । নর্মদা আমাদের নীচে আমরা লোহার রজ্জুতে গতিময় । এখানে নর্মদার নাম ধূঁয়াধার ফলস । সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে পুরো জায়গাটা ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে । সাদা ধুধের ফেনা হয়ে জল পড়ছে গর্জের মধ্যে আর পুরো জায়গাটি ধোঁয়াময় ।একঘন্টায় কেবলকারের রাইডে আসা এবং যাওয়া সম্পূর্ণ হল । এবার নেমে পায়ে হেঁটে নর্মদাকে ছুঁতে যাওয়া । তাকিয়ে দেখি শ্বেতপাথরের দেওয়ালে অবাককরা রামধনু ! আর আমার গায়ে নর্মদার জলের ছিটে অনবরত ধেয়ে এল ।এবার পঞ্চবটী ঘাটে এসে নর্মদায় নৌকাবিহার । মার্বেল রকস দেখতে যাচ্ছি এতক্ষণে ।
শিবানী নামে একখানা নৌকো পছন্দ করে টিকিট কেটে উঠে পড়া হল । দূরে ১০৮ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় পার্বতী মন্দির । এছাড়াও বিন্ধ্য পাহাড়ের গায়ে শঙ্কর মন্দির, পাঁচপটা মন্দির । নৌকোর মাঝি এমনটি বলল । বেশ মজার মাঝি সে । গানে গানে কবিতায় ছন্দে ভরিয়ে দিল একটা ঘন্টা । স্বরচিত কবিতা যা কিনা পুরো মার্বেল রকসকে গল্পের মোড়কে হাজির করে চোখের সামনে ।
সেই নৌকার কান্ডারীর ছন্দময়তায় আমাদের যাত্রাপথের আনন্দ বেড়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল একনিমেষে । হেলছে তরী, দুলছে তরী ভেসে চলেছে নর্মদায় ।ছুঁলাম হাত নীচু করে নর্মদাকে । পরেই দেখি পরের নৌকাটির গায়ে একখানা লম্বা জলঢোঁড়া সাপ জল থেকে ওঠার চেষ্টা করছে প্রাণপণে । মাঝি বললে "কিছুতেই উঠতে পারবেনা সে"; সত্যি সত্যি কিছুপরেই সে আবার জলের মধ্যে লাফিয়ে চলে গেল । লাইমষ্টোন্, মার্বেল, ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেটের পাহাড় চলল আমাদের দুপাশে । আমরা যেন ভেসে চলেছি একটা ক্যানালের মধ্যে দিয়ে । আমরা চলেছি বান্দরকুঁদনী ঘাটের দিকে যেখান থেকে লাইমষ্টোনের পাহাড়ের ওপর থেকে লাফে লাফে ঝাঁপ দিচ্ছে বাঁদর আর সেই সাথে রোজগারের আশায় দরিদ্র গ্রামের আদুড় গায়ে গ্রামের ছেলে । কোনো চাহিদা নেই তাদের তুমি যদি বল পয়সা দেবে তবেই সে জোরসে ডাইভ দেবে মাঝ নর্মদায় সেই ওপর থেকে । আর পয়সা হাতে নেয় না সে ছেলে মা নর্মদার কোল থেকে তুলে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে শুকিয়ে নিচ্ছে নোট । এই তার রুজি । মায়ের জন্য করে খাচ্ছে তাই মা'কে এত ভক্তি ! পুব থেকে পশ্চিমে বহতী নর্মদা । মাথার ওপরে কট কটে দূপুর সূর্য । একবার আকাশী মার্বল তো আবার সাদাকালো । কখনো আবার গোলাপী তো কখনো শ্লেট পাথর । ভুলভুলাইয়ার মত জলে র মধ্যে দিয়ে যেতে লাগলাম আর চারপাশের যে দৃশ্য তা ভাষায় বলতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রে র সাহায্য নিয়ে বলতে হয় " আহা! কি দেখিলাম ! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না " ! এবার সবচেয়ে গভীর জল, ৩৫০ ফুট গভীরে । ধারে দেখি মার্বেলপাহাড়ের গায়ে জড়াজড়ি করে পড়ে রয়েছে সাত-আটটা সাপ । এবার খানিক সংকীর্ণ জলপথ । কাছ থেকে পাহাড়কে দেখছি । পেছনে গভীর জঙ্গল । পাহাড়ের গায়ে কি বিচিত্র চিত্রকল্প। মাঝির কবিতায় তা আরো স্পষ্ট । ছোট ছেলেমেয়ে একজোড়া,গায়ে জামা-প্যান্ট পরা । আবার কোথাও খাজুরাহের পুতুল তো কোথাও কালভৈরবের কালো মূর্তি । কোথাও আবার পাহাড়ের গায়ে মহাদেবের নন্দীর মত একটা বিশাল ষাঁড় । এবার পাহাড়ের মধ্যে গুহা দেখা গেল । একটা আইল্যান্ড এল । ইন্দোরের মহারাণী স্থাপন করেছিলেন শিবলিঙ্গ । এবার আরো গভীর ৪৫০ফুট । গাঁয়ের ছেলে আদুড় গায়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত। অনেক হিন্দী ছায়াছবির শুটিং হয়েছে এখানে ।
রাজকাপুরের আওয়ারা থেকে রেখার খুন ভরি মাং, যিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় থেকে শাহরুখের অশোকা , রেখা-সুনীল দত্তের প্রাণ যায় পর বচন না যায় এদের মধ্যে অন্যতম । ভাবছি কোথায় সেই দ্বীপের ওপর নৃত্যরতা, স্বল্পবসনা রেখাকে কোথা থেকে একটা বিশাল মাছ ঘাই মেরে আমার কল্পনার সূতোগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিল । এতক্ষণে বুঝলাম জলের আঁশটে গন্ধের রহস্য । নৌকোর মাঝি থামেনা । সে অনবরত ছড়া কেটে চলেছে " চাঁদনী রাত মে, ক্যামেরা হাথ মে, ফ্যামিলি সাথ মে আউর কেয়া? আপ বলিয়ে জি! সে পরখ করছে আমরা মন দিয়ে তার কবিতা শুনছি কি না । আমার মা জোড় হাতে নর্মদাকে প্রণাম করে বলে উঠলেন
" নর্মদে শর্মদে নিত্যং পাপতাপবিনাশিনী, শংকর স্বেদসম্ভূতে সনাতনী নমোহস্তুতে "
এবার চেয়ে দেখি কতকত মৌচাক লাইমষ্টোনের ওপরে বাসা বেঁধেছে মনের সুখে ।
এইভাবে নর্মদা বয়ে চলেছে আবহমান কাল ধরে সাতপুরা আর বিন্ধ্যর মাঝখান দিয়ে । দূরে শঙ্করকুন্ড আর বাণকুন্ড যেখানে জল গিয়ে পড়ছে আর অবিরত সৃষ্টি করে চলেছে প্রাকৃতিক উপায়ে শিবলিঙ্গ । নদী যেখানে গভীর সেখানে তার জল তত শান্ত আর গভীরতা কমে যায় আর তার স্রোতস্বিনী নাম সার্থকতা পায় । দূর থেকে মাঝি দেখাল বগলামুখী আর ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির । আমরা কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেল কবিতার মাঝদরিয়া । একঘন্টা পেরিয়ে ঘাটে এসে নৌকা খানা ভিড়ল । চেয়ে দেখি শ্বেতপাথরের মূর্তি, গয়না আর থালাবাটির পসরা ।
আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিম দিনাজপুর, রবিবারের ক্রোড়পত্র ৬ই জানুয়ারি ২০১৩
No comments:
Post a Comment