মাঘের
মিঠে রোদ পিঠে চড়িয়ে বেরিয়ে
পড়লাম রাঁচী থেকে একটা গাড়ি
নিয়ে রাজরপ্পার দিকে । রামগড়
থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে
আর রাঁচি থেকে ৮০ কিলোমিটার
দূরে রামগড় ও চিতোরপুর রোডের
ওপরেই রাজরপ্পা । হাজারিবাগ
রোড ধরে খেলগাঁও দিয়ে চলতে
লাগলাম । ন্যাশানাল হাইওয়ে
৩৩ এর ওপরে ঝকঝকে সাজানো আর্মি
ক্যান্টনমেন্ট "দীপাটলি"
এল । ছোটনাগপুর
মালভূমির সবুজ পাহাড়ের গা
ঘেঁষে আমাদের চলা । বেশ মনোরম
জলবায়ু আর সবুজ প্রকৃতি ।
কিছুপরেই এল রামগড় ঘাঁটি ।
একটু চড়াই আবার সামান্য উতরাই
পথ দিয়ে চলতে চলতে পালামৌ,
বিভূতিভূষণ মনে
পড়ছিল । গাড়ির কাঁচ খুলে নাম
না জানা, অচেনা
ফুলের বুনো গন্ধ নিতে নিতে
ভাবছিলাম অধুনা ঝাড়খন্ডের
এই অংশটির কথা । বৈচিত্র্যময়
ঝাড়খন্ডের এই ভূখন্ডটির সম্পদ
হল পাহাড়-মাটীর
স্তূপের মধ্য দিয়ে অগুন্তি
ছোট-বড় নদী আর
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে
ঝরে পড়া ঝোরার কলকলানি । সেবার
গেছিলাম রাঁচি থেকে মাত্র ৪০
কিলোমিটার দূরে দশম ফলস । মনে
পড়ছিল সেই কথা । কি অপূর্ব সেই
রূপ ! সুবর্ণরেখা
নদীর এক শাখা নদী কাঁচীর দশটি
সাবলীল ধারা অবলীলায় ৪৪মিটার
ওপর থেকে ঝরে পড়েছে একসাথে
নীচে । এছাড়াও হুন্ড্রু,
জোনহা, হিরণি,
পাঁচ গাঘ ফলস,
সীতা ফলস, কাঁকে
ড্যাম, রাঁচি লেক
ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশটি
ঘিরে যেন এক ন্যাচারাল নবরত্নের
মালা গেঁথে সাজিয়ে রেখেছে
নিঁখুত ভাবে । আর সাঁওতাল
মানুষের জীবনযাপন, ধামসা-মাদল,
অনবরত ঝরে পড়ে থাকা
বিশাল বিশাল ভুর্জ্যপত্রের
ওপর লিখে রেখে যায় কত সময়ের
দলিল। বছরের পর বছর ধরে যা
পুরোণো হয়না । মহুয়ার ঝিম ধরা
নেশার মত সেই গল্প উঠে আসে
বারবার কত লেখকের কলমে,
বীরসা মুন্ডার জীবন
যুদ্ধে ।
এখানকার
সবচেয়ে বড় নদী দামোদর । রাঁচি
ও হাজারিবাগ মালভূমির মধ্য
দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খনিজ সম্পদে
সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের আরেক নদী
ভৈরবী বা ভেরার সাথে মিলিত
হয়েছে দামোদর আর সেই সঙ্গমেই
রাজরপ্পা জলপ্রপাত । প্রায়
৯ মিটার উঁচু থেকে ভেরা নদীর
অবিরত ধারা ঝরেছে দামোদরের
বুকে । রাজরপ্পা শুধুমাত্র
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের
জন্যই নয় ছিন্নমস্তা বা
ছিন্নমস্তিকার মন্দিরের
জন্যও যথেষ্ট বিখ্যাত । সতীর
দেহ ত্যাগের পর মহাদেবের
তান্ডব নৃত্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন
সতীর মস্তকটি না কি এখানে
পড়েছিল তাই দশমহাবিদ্যার
অন্যতম ছিন্নমস্তা মায়ের
মন্দিরটি একান্ন সতীপিঠের
একটি বলে অনেকেই দাবী করেন ।
সতীপিঠ হোক বা না হোক গাড়ি
নীচে রেখে সামান্য চড়াই পাহাড়ী
পথ ধরে মন্দিরের দিকে এগুতে
লাগলাম আর কেমন যেন একটা এথান
মাহাত্ম্য অনুভূত হল । বহুদিন
আগে যখন এই রাস্তা হয়নি তখন
নদী পেরিয়ে মন্দিরে আসতে হোত
। এখন রাজরপ্পা বেশ অনেকটাই
আধুনিক এবং ভেতরে প্রবেশ করে
দেখি কঙ্ক্রিটের বাহুল্যে
কিছুটা হলেও কৃত্রিম । তবে
মা ছিন্নমস্তার মন্দির এবং
রাজরপ্পা জলপ্রপাতটি ভুলিয়ে
দেয় সবকিছু । ছিন্নমস্তার
মন্দির বড় একটা দেখা যায়না
তাই আমার এত আগ্রহ ছিল । অনেকটা
কামাখ্যা মন্দিরের ঢঙে নির্মিত
মূল মন্দিরটি । আর এই মন্দিরকে
ঘিরে কালীর দশ মহাবিদ্যা রূপের
অন্য গুলি অর্থাত তারা,
কমলা, বগলা,
ভৈরবী, ধূমাবতী,
ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী,
মাতঙ্গী প্রভৃতির
মন্দির গুলি নির্মিত হয় অনেক
পরে । মন্দির চত্বরে দর্শনার্থীদের
বিশাল লাইন দেখে ঘাবড়ে গেলাম
। কিন্তু কিছুপরেই অতি সুন্দর
নিয়ম মেনে লাইন এগুতে দেখলাম
আর একসাথে জনা কুড়ি মানুষকে
পুজো দিতে সম্মতি দেওয়া হয় ।
কোনো পান্ডার উপদ্রব নেই ।
আর অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে
পুজো দেওয়া যায় । তাই গাড়ীর
ড্রাইভারকে লাইন রাখতে বলে
পুজোর ডালা কিনে নিয়ে ঘুরতে
গেলাম নদীর ধারে । নৌকো করে
ওপারে যাচ্ছে মানুষ । আর দুই
নদীর সঙ্গমে রাজরপ্পা ঝোরার
কলকলানি বড়ই দৃষ্টিনন্দন ।
তখন
দুপুর একটা বাজে । সারি সারি
শালগাছের মাথায় দুপুরের সূর্য
সজাগ । আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
দু-এক ঘর সাঁওতাল
বসতি । লাইন দিয়ে মা ছিন্নমস্তার
মন্দিরে প্রবেশ করলাম এক গা
ছমছমে অনুভূতি নিয়ে ; সিঁদুর
লেপা পাথরের গায়ে খোদাই করা
হয়ত মায়ের মুখ । অন্ধকারে দেখা
গেলনা । তবে পুজো নিয়ে অহেতুক
আড়ম্বর নেই । পূজারীর দাদাগিরিও
নেই । সেটাই বেশ ভালো লাগল
।বহু দূর দুরান্ত থেকে মানুষ
এসেছেন মনস্কামনা পূরণ করতে
ছাগল সাথে করে । স্থানীয় সাঁওতাল
মানুষেরা ছিন্নমস্তাকে অসম্ভব
ভক্তি করে এবং তাদের মৃত মানুষের
অস্থিভস্ম এই দামোদর নদীতে
ফেলে । মন্দির থেকে নেমেই
যেতে হয় কালভৈরবের কাছে ।
নারকোল ভেঙে জল ঢেলে শিবের
প্রণাম হল । তারপর আবার দুই
নদীর সঙ্গমস্থল পেরিয়ে পেছনপথ
দিয়ে তীরে উঠে গাড়ির খোঁজ করা
।
কখন
যাবেন : বর্ষাকালে
গেলে ওয়াটার ফলস গুলির থৈ থৈ
রূপলাবণ্য দেখা যায় । এছাড়া
রজরপ্পা নভেম্বর থেকে মার্চ
অবধি যাওয়াই শ্রেয় । কারণ
গরমের সময় প্রচন্ড দাবদাহ
চলে এই অঞ্চলে ।
কিভাবে
যাবেন : হাওড়া
থেকে রাঁচি-হাতিয়া
এক্সপ্রেসে রাঁচি ও সেখান
থেকে গাড়ি ভাড়া করে রাজরপ্পা
যাওয়া যায় ।
কোথায়
থাকবেন : রাঁচি
শহরে নামী দামী অজস্র হোটেল
আছে । বিশেষ ছুটিতে গেলে আগে
থেকে বুক করে যাওয়াই ভাল ।
No comments:
Post a Comment