সে অনেক যুগ আগের কথা । মৌর্য সম্রাট অশোক বুদ্ধ বিগলিত অন্তরে কেঁদে বললেন, "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি" । প্রচুর প্রভাবপ্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে উড়িষ্যার ধৌলী পাহাড়ের গায়ে , দয়ানদীর তীরে হাজার হাজার মানুষের রক্তপাত ঘটতে দেখে সাম্রাজ্যবাদের উচ্চাশা ত্যাগ করে শেষমেশ তিনি বেছে নিলেন অহিংস রাজনীতির পথ । কলিঙ্গযুদ্ধের এই ভয়াবহ পরিণতি তাঁকে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত করল অন্য সত্তায়; সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের মধ্যে তিনি শুধুমাত্র বেছে নিলেন সত্ত্বগুণকে । শরণ নিলেন গৌতমবুদ্ধের্, আশ্রয় নিলেন ধর্মের । সম্রাট অশোকের "চন্ডাশোক" থেকে "ধর্মাশোকে" উত্তরণ ঘটল ।
অশোক যখন উজ্জয়িনীর ভাইসরয় ছিলেন তখন বিদিশার সওদাগরের কন্যা বেদিশা মহাদেবী বা দেবীকে বিবাহ করেন । কলিঙ্গ যুদ্ধের মৃত্যুমিছিলের শোকে ব্যাথিত, ক্লিষ্ট, অনুতপ্ত রাজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার এই স্ত্রী দেবী । তার দুখের ঘায়ে প্রলেপ দিয়ে মনের জালা জুড়িয়েছিলেন এই দেবী। বৌদ্ধধর্মের আদর্শে তাঁকে অণুপ্রাণিত করেছিলেন । বিদিশা মধ্যপ্রদেশের একটি শহর। যার দশ কিমি দূরে অশোক স্থাপন করলেন অধুনা বিশ্ব-হেরিটেজ মর্যাদা সম্পন্ন বৌদ্ধমন্দির যা সাঁচী স্তূপ নামে খ্যাত । সিন্ধুসভ্যতার সবচেয়ে সংরক্ষিত নিদর্শন এই সাঁচীস্তূপ । মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলায়, ভোপালের ৪৬ কিমি দূরে, বেতোয়া নদীর ধারে এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনুমেন্টটি এখনো রাজকীয়তায় পরিপূর্ণ । বৌদ্ধ স্থাপত্যের সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য অর্থাত স্তূপ, মন্দির, স্তম্ভ, বিহার এবং চৈত্য সবকিছুই নিঁখুত ভাবে রয়েছে এখানে ।
কয়েক একর জায়গা জুড়ে সাঁচী স্তূপ, মন্দির চৈত্য এবং স্তম্ভগুলি । সারাদিন লেগে যাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে । কিন্তু সবগুলি স্থাপত্য সম্রাট অশোকের আমলে তৈরী হয়নি । বহুবছর ধরে গড়ে উঠেছিল সাঁচী । অশোক সাঁচীর মৃত্তিকায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন শান্তির টুকরো টুকরো কণা। সাঁচীর বাতাসে অনুভব করেছিলেন অহিংসার গন্ধ । উপাসনার আদর্শ স্থান, আরাধনায় দিব্যদৃষ্টি হয়ত পেয়েছিলেন অশোক । কিম্বা নিছক শান্তির পরিমন্ডল তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল কলিঙ্গযুদ্ধের রক্তপাত ।
বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও পতনের সাথে সাথে সাঁচীস্তুপের অনেক সংযোজন, সংস্করণ এবং পরিবর্তন হয়েছে । অশোকের মৃত্যুর পর শুঙ্গবংশের রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রায্যের শত্রু পুষ্যমিত্র শুঙ্গের দ্বারা অনেক ক্ষতিসাধন হয়েছিল সাঁচীর আদি স্তুপের । পরে তার পুত্র অগ্নিমিত্রের আমলে এই সাঁচীস্তুপের বিবিধ উন্নতিসাধন হয় । অগ্নিমিত্র নিজে বৌদ্ধধর্মের অনুরক্ত ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছিল । তিনি যেমন একাধারে এই স্তুপের রক্ষণাবেক্ষণ করেন তেমনি ছোট বড় অনেক তোরণ এবং স্তূপ তৈরীও করেছিলেন । শুঙ্গবংশের পর সাতবাহনদের আমলে সাতবাহন রাজাদের চাঞ্চল্যকর স্থাপত্য কীর্তি সাঁচী স্তুপকে বিশেষ মাত্রা দেয় । স্তম্ভগুলিতে খোদাই করা ব্রাহ্মিলিপি থেকে অনেক কিছু জানা গেছে । সাঁচী শব্দটির উত্পত্তি সংস্কৃত এবং পালি শব্দ সাঁচ থেকে যার অর্থ হল to measure বা মাপা। হিন্দীতে সাঁচীর অর্থ হল Moulds of stones
প্রধান স্তূপটি যেটি অশোক তৈরী করেছিলেন সেটি বিশাল এবং রাজকীয় । অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই বিশাল সাঁচীস্তূপটির ওপরে একটি তিন প্রস্থ ছাতা যাকে বলে ছত্তাবলী রয়েছে যা এক চতুষ্কোণ রেলিংয়ের মধ্যে আবদ্ধ । কিছুদূর উঠে একটি বারান্দা বা মেধি যার বাইরে দিয়ে পাথরের বেষ্টনী । পাথর বিছানো মিছিল পথ বা প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে মাটীতে যাকে ঘিরে আবার পাথরের বেষ্টনী ।
প্রধান এই স্তূপের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে চারটি প্রবেশদ্বার বা তোরণ রয়েছে । প্রত্যেকটি তোরণ অসাধারণ সুন্দর পাথরের কারুকাজ করা । ওপরে জাতকের গল্প , গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী এবং স্থপতির নাম ব্রাহ্মি লিপিতে খোদাই করা । বুদ্ধের রেলিক্স বা দেহাবশেষ (অস্থিভস্ম)রাখা রয়েছে স্তূপের নীচে । দক্ষিণ তোরণের বাঁদিকে লক্ষ্য করা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি যা পড়ে জানা যায় যে বিদিশার হাতীরদাঁতের কারুশিল্পীর স্থপতিদের দ্বারা তৈরী হয়েছিল এই স্থাপত্য । উত্তরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে ধর্মচক্র যা আমাদের ভারতীয় জাতীয় পতাকার মধ্যে নীল রঙে আঁকা থাকে । সেখানে আরো দেখা যায় একটি বানরকে যে ধ্যানস্থ বুদ্ধকে মধু উত্সর্গ করছে । দেখা যায় বুদ্ধভক্ত সুজাতাকে যে পায়েস দান করছে । পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারে পাথরে খোদাই করা গাছ এবং পশুপাখি পরিবেষ্টিত সিংহাসনারূঢ় বুদ্ধকে । পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বারে কুশীনগরে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লক্ষ্য করা যায় । স্তম্ভের গায়ে পাথরের খোদাই যে কতটা নিপুণ এবং স্থপতির শিল্পীসত্তা যে কতটা উন্নতমানের তা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না । এইভাবে কোনোটিতে বুদ্ধের তাঁর শিষ্যদের বাণী প্রচারা, অরেকটিতে অশোকের বোধগয়া যাত্রা , আবার আরেকটিতে দোলাছত্রধারী জনতার মাঝে বুদ্ধের নিরঞ্জনা নদীতে গমন । আবার ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া বুদ্ধের জন্মের কাহিনী, কপিলাবস্তুতে রাজা শুদ্ধোদনের রাণীর স্বপ্নে শ্বেতহস্তী দর্শন আর সর্বপরি বুদ্ধের সিদ্ধিলাভের সময় ঐহিক সব প্রলোভনের কাহিনী সব ঐ পিলারগুলির গায়ে বিবৃত হতে দেখে মনে হল এতদিন ধরে যা আমরা পড়ে এসেছি এবং বিশ্বাস করে এসেছি কোনোটিই অসত্য নয় । দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বারে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক অশোক স্তম্ভ যা ভারতের জাতীয় প্রতীক । সেই পাথরে নিখুঁত খোদাই করা চারমুখে চারটি সিংহের মুখ । আমার ইতিহাস বইয়ের পাতা আজ জীবন্ত আমার চোখের সামনে । এই অশোক স্তম্ভ এবং অশোকচক্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন গর্বিত মনে হল নিজেকে । খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এই স্থাপত্যের চিহ্ন আমরা বহন করে চলেছি এখনো, অক্লেশে, ঐতিহ্যের সাথে, সম্মানের সঙ্গে ।
আমরা ভোপাল থেকে সাঁচী পৌঁছলাম ঘন্টা দুয়েক পরে । পথে পেরোলাম কর্কটক্রান্তি রেখা । আমাদের যাত্রাপথকে তেরছা ভাবে কেটেছে সেই পথে । কেমন অভাবনীয় ভাবে এসে পড়লাম ঐ রেখার ওপর । এতদিন যার অস্তিত্ব ছিল ভূগোল বইয়ের পাতায়, মানচিত্রে সেই ট্রপিক অফ ক্যানসারের ভারতীয় অংশ আমার পায়ের তলায় । ভারতের মাটি চিরে ঐ পথে রেখাটি চলে গেছে ।
পড়ন্ত রোদের আলোয় সাঁচীকে বড় উজ্জ্বল মনে হ'ল এবং প্রকৃতপক্ষে তা এখনো বৌদ্ধস্থাপত্যে ভাস্বর । সবুজ লন । একটা স্থানে ছোট ছোট জীব যেমন খরগোশ, হাঁস, পায়রা ছেড়ে রেখে দেওয়া হয়েছে ।তাদের পালন করা হচ্ছে । বৌদ্ধধর্মের অহিংসার একটি অন্যতম ধারা যা বহন করছে । সূর্যডোবার সেই মূহুর্তে সাঁচীস্তূপে দাঁড়িয়ে মনে হল সম্রাট অশোক সেই খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কত প্রতিকূলতার মধ্যে এই সাঁচী পাহাড়ে পৌঁছেছিলেন আর অমন দৃষ্টিনন্দন একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং স্তূপ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন যা এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের মনে শিহরণ জাগায় ।
ভারত বিচিত্রা এপ্রিলসংখ্যা ২০১৩
http://www.hcidhaka.org/bharat_bichitra.php
No comments:
Post a Comment