বাই বাই বার্লিন !
আবার ভোরের আলো, ঠান্ডা হাওয়া আর এক আধপশলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসে ওঠা। বার্লিনে আজ আমাদের সারাটা দিন, সারাটা রাত কাটানোর পালা। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় ব্রান্ডেনবার্গ গেটের ভাল ছবি নেওয়া হয়নি বলে একটু খুঁতখুতুনি ছিল। অগত্যা সেখানেই প্রথম যাওয়া। ইষ্ট বার্লিনের রাস্তায় হরেক কিসিমের ট্রাম দেখলাম বাপু। যেমন ঝাঁ চকচকে ট্রামের সাজুগুজু তেমনি নেটওয়ার্ক। ক্রিশক্রশ ভাবে সারা শহর যেন ট্রামময়। কেবলি মনে হচ্ছিল বাস থেকে নেমে ট্রামে উঠে পড়ি। আর আমাদের কলকাতার ট্রামগুলোর কথা ভাবলেই লজ্জা হচ্ছিল।
আমরা কিনা কতগুলো রাস্তার ট্রাম তুলেই দিলাম! সারেসারে লিন্ডন গাছের কচি সবুজ পাতায় তখন সোনা গলানো ভোরের রোদ। টাউন হলের মাথায় পতপত করে ওদেশের পতাকা উড়ছে। তারপর একে একে জন চেনাতে লাগল বার্লিন ডোম, কাগজের পাতায় পড়া সেই এডলন হোটেল । এই এডলন হোটেলের উঁচু, খোলা জানলা দিয়ে মাইকেল জ্যাকসন তার সন্তানকে ঝুলিয়ে মজা দেখাতে গিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিল।
এবার নদীর ধারে যাওয়া। ঠান্ডা হাওয়ায় আরো তীক্ষ্ণ ধার অনুভূত হল। নদীর নাম স্প্রে( Spree) । নদী বেশ ছোটই কারণ আমাদের চোখ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দেখে অভ্যস্ত। তবে সুনিপুণভাবেই লঞ্চ চলছে নদীর বুকে। ওপরে ব্রিজ। বেশ ফোটো নেবার আদর্শ ভারতীয়ের ক্যামেরায়। নদীর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই জন বলল, "look at the Berlin Wall ! "এই সেই ইতিহাস খ্যাত বার্লিনের প্রাচীর? মন ভারি হবার আগেই জন বলল, এদিকটা হল "the most funny part of the wall" বললাম, এতে আবার মজা কোথায় দেখল সে? রাহুল বলল, ঐ দ্যাখো মা দেওয়ালের গায়ে কি অদ্ভূত পেন্টিং এখনো রয়েছে। বার্লিন ওয়াল যখন ভেঙে ফেলা হল তখন প্রায় ১০০ জন চিত্রশিল্পী প্রতিবাদে সরব হয়ে বলেছিল, রাখা হোক দেওয়ালটা। আমরা না হয় সুন্দর করে এঁকে সাজিয়ে রাখব আমাদের শিল্পকর্ম। ঐটুকুনি দেওয়াল সবচেয়ে লম্বা যা এখনো বেঁচেবর্তে আছে। নদীর জলে হালকা ঢেউ তুলে নৌকো যাচ্ছে। নদীর ধারে পিয়ানো একর্ডিয়ানে হালকা সুর বাজাচ্ছে কেউ।
এতজন চিত্রশিল্পীর দেওয়াল চিত্র সম্বলিত এই স্থানকে বলা হয় ইষ্টসাইড গ্যালারী। এরপর গেলাম বার্লিন প্রাচীরের আরেকটা দিক দেখতে।
বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ছাড়াও জার্মাণী ও বার্লিনের একটি দ্বিতীয় অস্তিত্ত্ব আছে। তা হল আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থাত ক্যাপিটালিজম ও কমিউনিজম এবং পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের slavic এর রণভূমি হয়ে ওঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রতে সারাবিশ্ব ভরে উঠেছিল তখন এই দুই রাষ্ট্রের কূটনৈতিকেরা এক নতুন পন্থা অবলম্বন করল যার নাম কোল্ড ওয়ার। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে গুপ্তচর এবং দেশদ্রোহীর সাহায্যে একে অপরের ক্ষতিসাধন করার দুষ্টু অভিসন্ধির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল এই বার্লিন।মিত্রপক্ষের তিন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যৌথভাবে পশ্চিম জার্মাণী দখল করেছিল এলব নদী অবধি ও রাশিয়া পূর্ব জার্মাণী দখল করল। বার্লিন যদিও পূর্ব জার্মাণীতে তবুও সেই শহরও দ্বিধাবিভক্ত, ইষ্ট ও ওয়েষ্ট বার্লিন। পূর্ব বার্লিন রাশিয়া অধিকৃত কমিউনিষ্ট ও ডিক্টেটরশিপের পীঠস্থান আর পশ্চিম জার্মাণী ছিল গণতান্ত্রিক, লিবরাল। সাধারণ জার্মাণরা পূর্বজার্মাণী থেকে পশ্চিমে পালাতে শুরু করল। গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য। এটিকে বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই ১৯৬১ সালে তৈরী হল শহরের বুক চিরে, পশ্চিম বার্লিনকে ঘিরে ঐতিহাসিক এই বার্লিন ওয়াল। সেই পাঁচিল টপকাতে গিয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হল।
অবশেষে ১৯৯০ সালে জনরোষের মুখে পড়ে সেই বার্লিন ওয়াল ভেঙে দেওয়া হল। ও তার সাথে ভেঙে পড়ল পূর্ব জার্মাণীর কমিউনিষ্ট স্বৈরতন্ত্র। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মাণীর এই মিলনে জার্মাণী এখন উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। স্প্রি নদী পেরিয়ে একবার একূলে যাই তো আরেকবার ওকূলে গিয়ে দাঁড়াই। আক্ষরিক অর্থে এই নদীও যেন উভয় জার্মাণীর সীমারেখায় প্রবহমান। একদিকে ব্রিটিশ এমব্যাসি, মিউজিয়ামে ছয়লাপ । ঠিক দুপুর বারোটায় বেজে উঠল চার্চের ঘন্টা। দূরে চোখ রাখি আকাশছোঁয়া বার্লিন ডোমে ও জার্মাণ হিষ্ট্রি মিউজিয়ামে। ওয়ার মেমোরিয়ালে চোখ রাখলেই ভারি হয়ে ওঠে চোখের পাতা। তারপরেই আইনস্টাইন ও কার্লমার্ক্সের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামবোল্ট ইউনিভার্সিটি নজর কেড়ে নেয়। দুপুরে একটু বিশ্রাম নেওয়া রাস্তার ধারে কফিশপে। আবার একটু চাঙ্গা হয়ে দেখতে যাওয়া ঐতিহাসিক বুক-বার্নিং স্কোয়ার। ১৯৩০ সালে ঠিক এই জায়গায় ২০০০০ বই পুড়িয়েছিল । এক জার্মাণ লেখক এই ঘটনার ১০০ বছর আগে নাকি নাত্জী বাহিনীর এই নারকীয় কর্মকান্ডের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন যারা বই পোড়ায়, তারা একসময় মানুষ ও পোড়াবে। এই উক্তি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল যখন হিটলার তার বীভত্স কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে কাতারে কাতারে মানুষকে মারল।
আবার ভোরের আলো, ঠান্ডা হাওয়া আর এক আধপশলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসে ওঠা। বার্লিনে আজ আমাদের সারাটা দিন, সারাটা রাত কাটানোর পালা। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় ব্রান্ডেনবার্গ গেটের ভাল ছবি নেওয়া হয়নি বলে একটু খুঁতখুতুনি ছিল। অগত্যা সেখানেই প্রথম যাওয়া। ইষ্ট বার্লিনের রাস্তায় হরেক কিসিমের ট্রাম দেখলাম বাপু। যেমন ঝাঁ চকচকে ট্রামের সাজুগুজু তেমনি নেটওয়ার্ক। ক্রিশক্রশ ভাবে সারা শহর যেন ট্রামময়। কেবলি মনে হচ্ছিল বাস থেকে নেমে ট্রামে উঠে পড়ি। আর আমাদের কলকাতার ট্রামগুলোর কথা ভাবলেই লজ্জা হচ্ছিল।
আমরা কিনা কতগুলো রাস্তার ট্রাম তুলেই দিলাম! সারেসারে লিন্ডন গাছের কচি সবুজ পাতায় তখন সোনা গলানো ভোরের রোদ। টাউন হলের মাথায় পতপত করে ওদেশের পতাকা উড়ছে। তারপর একে একে জন চেনাতে লাগল বার্লিন ডোম, কাগজের পাতায় পড়া সেই এডলন হোটেল । এই এডলন হোটেলের উঁচু, খোলা জানলা দিয়ে মাইকেল জ্যাকসন তার সন্তানকে ঝুলিয়ে মজা দেখাতে গিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিল।
এবার নদীর ধারে যাওয়া। ঠান্ডা হাওয়ায় আরো তীক্ষ্ণ ধার অনুভূত হল। নদীর নাম স্প্রে( Spree) । নদী বেশ ছোটই কারণ আমাদের চোখ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দেখে অভ্যস্ত। তবে সুনিপুণভাবেই লঞ্চ চলছে নদীর বুকে। ওপরে ব্রিজ। বেশ ফোটো নেবার আদর্শ ভারতীয়ের ক্যামেরায়। নদীর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই জন বলল, "look at the Berlin Wall ! "এই সেই ইতিহাস খ্যাত বার্লিনের প্রাচীর? মন ভারি হবার আগেই জন বলল, এদিকটা হল "the most funny part of the wall" বললাম, এতে আবার মজা কোথায় দেখল সে? রাহুল বলল, ঐ দ্যাখো মা দেওয়ালের গায়ে কি অদ্ভূত পেন্টিং এখনো রয়েছে। বার্লিন ওয়াল যখন ভেঙে ফেলা হল তখন প্রায় ১০০ জন চিত্রশিল্পী প্রতিবাদে সরব হয়ে বলেছিল, রাখা হোক দেওয়ালটা। আমরা না হয় সুন্দর করে এঁকে সাজিয়ে রাখব আমাদের শিল্পকর্ম। ঐটুকুনি দেওয়াল সবচেয়ে লম্বা যা এখনো বেঁচেবর্তে আছে। নদীর জলে হালকা ঢেউ তুলে নৌকো যাচ্ছে। নদীর ধারে পিয়ানো একর্ডিয়ানে হালকা সুর বাজাচ্ছে কেউ।
এতজন চিত্রশিল্পীর দেওয়াল চিত্র সম্বলিত এই স্থানকে বলা হয় ইষ্টসাইড গ্যালারী। এরপর গেলাম বার্লিন প্রাচীরের আরেকটা দিক দেখতে।
বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ছাড়াও জার্মাণী ও বার্লিনের একটি দ্বিতীয় অস্তিত্ত্ব আছে। তা হল আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থাত ক্যাপিটালিজম ও কমিউনিজম এবং পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের slavic এর রণভূমি হয়ে ওঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রতে সারাবিশ্ব ভরে উঠেছিল তখন এই দুই রাষ্ট্রের কূটনৈতিকেরা এক নতুন পন্থা অবলম্বন করল যার নাম কোল্ড ওয়ার। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে গুপ্তচর এবং দেশদ্রোহীর সাহায্যে একে অপরের ক্ষতিসাধন করার দুষ্টু অভিসন্ধির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল এই বার্লিন।মিত্রপক্ষের তিন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যৌথভাবে পশ্চিম জার্মাণী দখল করেছিল এলব নদী অবধি ও রাশিয়া পূর্ব জার্মাণী দখল করল। বার্লিন যদিও পূর্ব জার্মাণীতে তবুও সেই শহরও দ্বিধাবিভক্ত, ইষ্ট ও ওয়েষ্ট বার্লিন। পূর্ব বার্লিন রাশিয়া অধিকৃত কমিউনিষ্ট ও ডিক্টেটরশিপের পীঠস্থান আর পশ্চিম জার্মাণী ছিল গণতান্ত্রিক, লিবরাল। সাধারণ জার্মাণরা পূর্বজার্মাণী থেকে পশ্চিমে পালাতে শুরু করল। গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য। এটিকে বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই ১৯৬১ সালে তৈরী হল শহরের বুক চিরে, পশ্চিম বার্লিনকে ঘিরে ঐতিহাসিক এই বার্লিন ওয়াল। সেই পাঁচিল টপকাতে গিয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হল।
অবশেষে ১৯৯০ সালে জনরোষের মুখে পড়ে সেই বার্লিন ওয়াল ভেঙে দেওয়া হল। ও তার সাথে ভেঙে পড়ল পূর্ব জার্মাণীর কমিউনিষ্ট স্বৈরতন্ত্র। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মাণীর এই মিলনে জার্মাণী এখন উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। স্প্রি নদী পেরিয়ে একবার একূলে যাই তো আরেকবার ওকূলে গিয়ে দাঁড়াই। আক্ষরিক অর্থে এই নদীও যেন উভয় জার্মাণীর সীমারেখায় প্রবহমান। একদিকে ব্রিটিশ এমব্যাসি, মিউজিয়ামে ছয়লাপ । ঠিক দুপুর বারোটায় বেজে উঠল চার্চের ঘন্টা। দূরে চোখ রাখি আকাশছোঁয়া বার্লিন ডোমে ও জার্মাণ হিষ্ট্রি মিউজিয়ামে। ওয়ার মেমোরিয়ালে চোখ রাখলেই ভারি হয়ে ওঠে চোখের পাতা। তারপরেই আইনস্টাইন ও কার্লমার্ক্সের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামবোল্ট ইউনিভার্সিটি নজর কেড়ে নেয়। দুপুরে একটু বিশ্রাম নেওয়া রাস্তার ধারে কফিশপে। আবার একটু চাঙ্গা হয়ে দেখতে যাওয়া ঐতিহাসিক বুক-বার্নিং স্কোয়ার। ১৯৩০ সালে ঠিক এই জায়গায় ২০০০০ বই পুড়িয়েছিল । এক জার্মাণ লেখক এই ঘটনার ১০০ বছর আগে নাকি নাত্জী বাহিনীর এই নারকীয় কর্মকান্ডের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন যারা বই পোড়ায়, তারা একসময় মানুষ ও পোড়াবে। এই উক্তি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল যখন হিটলার তার বীভত্স কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে কাতারে কাতারে মানুষকে মারল।
No comments:
Post a Comment