Thursday, June 21, 2012

Lingaraja Temple

ফাল্গুনের একটা মিষ্টি রোদের দুপুরে খড়গপুর থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে আমরা ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । ক'দিন আগেই বৃষ্টি হয়ে ঝকঝক করছে সবুজ প্রকৃতি । পাঁচঘন্টা পর ভুবনেশ্বর । পথে পেরোলাম সুবর্ণরেখা, মহানদীর ব্রিজ । এক একজায়গায় শীতের রুক্ষতায় চড়াও পড়েছে নদীর বুকে । হোটেলে গিয়ে উঠলাম । সেখানে থেকে পরদিন ভোরে একটা অটোরিক্সো ভাড়া করে লিঙ্গরাজা মন্দির । মন্দিরময় ভুবনেশ্বরে এটি একটি অন্যতম বৃহত মন্দির ।  কলিঙ্গ স্থাপত্যে একে পঞ্চরথের আদল বলা হয় ।  ১১ th century তে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন  সোমবংশীয় রাজা জজাতি কেশরী ।  ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে বড় মন্দির এটি । ল্যাটেরাইট পাথরের  প্রাচীর বেষ্টিত এই বিশাল মন্দিরের চত্বরটি দেখলে মনে হয় বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এত উঁচু এবং প্রশস্ত প্রাচীর দিয়ে একে ঘিরে রাখা হয়েছিল । প্রবেশদ্বারটিও বেশ রাজকীয় । পিতলের কারুকার্যময় দরজা । তবে ক্যামেরা, জুতো এবং সেলফোন নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ । এ যুগেও এত  রক্ষণশীলতার কারণ বুঝে উঠতে পারলামনা ।  কিন্তু এত সত্ত্বেও লিঙ্গরাজাকে দর্শন করতে গিয়ে দেখি আসল মহালিঙ্গটিই কালের স্রোতে বিদ্বেষে, রোষে আক্রমণে রক্ষা করতে পারেনি তারা ।  ঐ স্বয়ংভূ বা মাটি থেকে আপনিই উঠে আসা রাজলিঙ্গকে হরি-হর জ্ঞানে পূজা করা হয় । একদিকে যা বৈষ্ণব এবং শৈব ধর্মের মেলবন্ধন ঘটায় ।  শিব এখানে পূজিত হন ত্রিভুবনেশ্বর বা  স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতালের প্রভু রূপে । ভুবনেশ্বরী দেবী হলেন এই শিবের প্রকৃতি । তাঁর মন্দির ও রয়েছে পাশে ।  মূল মন্দিরটি ৫৫মিটার উঁচু এবং ঐ বিশাল মন্দিরের চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরো  আরো ১৫০টি ছোট বড় অমন মন্দির । ঘুরে ঘুরে দেখলাম বেশ কয়েকটি । প্রবেশদ্বারে ঢুকেই বাঁদিকে গণেশ মন্দির । তারপর মূলমন্দিরে পুজো দিলাম দুধ, বেলপাতা ধুতুরা ফুল দিয়ে । বাইরে এসে দীপ জ্বালালাম মহাদেবকে স্মরণ করে । ঊড়িষ্যার কোনো মন্দিরে দর্শনার্থীরা লিঙ্গের মাথায় জল, ফুল বা দুধ চড়াতে পারেনা ।একদল পান্ডাদের স্বেচ্ছাচারিতা,  অহমিকা আর ট্যুরিষ্ট বিদ্বেষ জায়গাটির স্থান মাহাত্ম্যকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে । যারাই আসছেন দূর দূর থেকে সকলের মুখেই সেই এককথা ।   লিঙ্গরাজ যেন ঐ প্রদেশের পূজারী এবং সেবায়েতদেরই সম্পত্তি । উত্তর বা পূর্ব ভারতের আর কোথাও এমনটি খুঁজে পাইনি ।      ভূবনেশ্বরী, কালী, সাবিত্রী, যমরাজ ইত্যাদি কয়েকটি মন্দিরে প্রবেশ করলাম ।  
 ল্যাটেরাইট পাথরের খোদাই করা স্থাপত্য সত্যি সত্যি অভিনব । নিখুঁত হস্তশৈলী ।   ১১০০ বছরের পুরোণো এই মন্দির গাত্রের কাজ পার করে দিয়েছে কত ধর্মবৈষম্যের  ঝড়ঝাপটা , কত বর্ণ বিদ্বেষের কোলাহল তবুও আজ স্বমহিমায় টিকে রয়ে গেছেন লিঙ্গরাজা । কিছুদূরেই রয়েছে বিন্দুসাগর এবং তার লাগোয়া  ১৫  th century তে গজপতি রাজাদের তৈরী   ব্রহ্মরাজ মন্দির । বৈশাখী পূর্ণিমায় লিঙ্গরাজ এখানে আসেন হাওয়া বদল করতে ঠিক যেমন পুরীর জগন্নাথ রথযাত্রায় মাসীর বাড়ি যান ।   আরো খানিক গেলেই পড়বে 9th century তে নির্মিত   রামেশ্বর মন্দির । কলিঙ্গ স্থাপত্যের ছোঁয়া এখানেও । কিছুটা লিঙ্গরাজ মন্দিরের আদলে তৈরী । রামচন্দ্র নাকি লঙ্কা বিজয়ের পর বিজয়রথ নিয়ে   সীতার সাথে   এখানে আসেন এবং এই শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন । বাসন্তীপূজার সময় অশোক-অষ্টমী তিথিতে,    রামনবমীর আগের দিন লিঙ্গরাজ  বিশাল "রুকুনা" রথে আরোহণ করে এই রামেশ্বর মন্দিরে আসেন চারদিনের জন্য ।  আর কিম্বদন্তী বলে এই চৈত্রমাসের বাসন্তীপূজার সময়ই তো রামচন্দ্র অকালবোধন করেছিলেন ।  ঐ চারদিন ধরেই তো বাসন্তী পুজো হয়ে আসছে দুর্গাপুজোর আদলে । 

Monday, June 11, 2012

বিপন্ন বাঁশবেড়িয়ায়


কোলকাতা ছেড়ে আমরা তখন বিটি রোড ধরেছি । হুগলীর বাঁশবেড়িয়ায় আমার শ্বশুরমশাইয়ের পিতামহ শ্রী সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের তৈরী বসতভিটে পরিদর্শনে । একে একে পেরোলাম বালি, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, ভদ্রকালী, রিষঢ়া, শ্রীরামপুর পেরোতে পেরোতে জৈষ্ঠ্যের রোদ তখন প্রায় আলম্ব মাথার ওপর । তারমধ্যেই শহরতলীর বাজারে হৈ হৈ করে বিকোচ্ছে আম-কাঁঠাল-লিচু । রবিবারের সরগরম বাজারে ঠা ঠা রোদেও বিকিকিনির খামতি নেই ।
জিটি রোড ছেড়ে এবার পুরোণো দিল্লী রোড ধরে সোজা মগরা হয়ে বাঁশবেড়িয়া । হংসেশ্বরী রোড ধরে রঘুদেবপুরে থামা ।
দেড়শো বছরের পুরোণো মুখুজ্যে বাস্তুভিটে এখন জঙ্গলাকীর্ণ । লোকাল ক্লাব, লোকনাথ বাবার মন্দির গড়ে উঠেছে এই জমিতেই । 

দোতলাবাড়ি ভেঙে গেছে বহুদিন আগেই ।জানলা দরজা ভেঙে ভেঙে নিয়ে গেছে কেউ । কড়িবরগার ছাদের নীচে একতলায় বাস করছে তিনটি পরিবার । পাশে দুটো পুকুরে এখনো জল থৈ থৈ । সংলগ্ন বাড়ি উঠেছে আমাদের জমির ওপর দিয়েই । প্রকান্ড বাড়ির সামনে বারমহল এখনো কিছুটা ভগ্নাবস্থায় দাঁড়িয়ে । পাশে ছিল উঁচু করা খানিক জমি যেখানে প্রতিবছর জগাদ্ধাত্রী পুজো হত ।
এখন পরিত্যক্ত ভিটের কুলুঙ্গিতে চামচিকের আনাগোনা । ক্লান্ত দুপুরে এ ভিটে হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ কুবো-ঘুঘুদের ছায়াসাথী ।  পোড়া ইঁটের সুরকি নিয়ে রান্নাবাটি জমিয়ে দেয় পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা ।  বারমহলের লবি চু-কিত্কিত প্রেমীদের অবারিত দ্বার ।  


 এরপর যাওয়া হল হংসেশ্বরী মন্দির ।  


পুরোণো হুগলীজেলার শিল্পনগরী ব্যান্ডেল এবং ত্রিবেণীর মাঝামাঝি অবস্থিত হংসেশ্বরী মন্দির । রাজা নৃসিংহদেব রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীকালে ওনার বিধবা পত্নী রাণী শংকরী সেই কাজ সমাপ্ত করেন । হংসেশ্বরী মন্দিরের অদ্ভূত গড়ন । বাংলার অন্যান্য মন্দিরের থেকে ভিন্নরকমের । পঞ্চতল এই মন্দিরে তেরোটি উঁচু মিনার আছে যাকে বলে রত্ন । প্রতিটি মিনার যেন এক একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের আকৃতিতে তৈরী । হংসেশ্বরী মন্দিরের গঠনশৈলীকে বলা হয় তান্ত্রিক সাতচক্রভেদ ।


 পাশেই অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরটি ও নজর কাড়ে । সেটি বাংলার চালাঘরের আদতে পোড়ামাটির তৈরী । গায়ে টেরাকোটার অভিনব স্থাপত্য ।নিঁখুত কারুকার্য এই টেরাকোটার । কোনোটিতে রাধাকৃষ্ণ, কোনোটিতে দশাবতার, কোনোটিতে হনুমান । 


 এই দুই মন্দিরই এখন আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে ।কাছেই ত্রিবেণী হল তিন নদী গঙ্গা, সরস্বতী ও বিদ্যাধরীর সঙ্গমস্থল । কিন্তু সরস্বতী নদী মজে যাওয়ায় দুটি নদী এখন দৃশ্যমান ।
মন্দির এবং সংলগ্ন জমিদার বাড়ীর পুরো চৌহর্দির সীমানা বরাবর পরিখা খনন করে সুরক্ষিত করা রয়েছে এখনো ।