Monday, May 30, 2016

বোহেমিয়ান ডাযেরী ( পর্ব- ৪ )


OMG ! ও মা গো! এই বাহুবলী হোঁদল কুত্কুত পল' কে ঠেলে রোজ আমাকে বাসে উঠতে হবে? কিন্তু মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে বাসে উঠে পড়তেই তার কেতাদুরস্ত ট্যুর গাইড সুলভ অ্যাকসেন্ট আর স্মার্টনেস ক্ষণিকেই কলকাতাইয়ার মনে আঁচড় কাটল।
Guten Morgen meine Damen und Herren !
রোজ এইভাষাতেই শুনতে হবে নকি? না, না । জার্মাণীতে পলের জন্ম। আর আমাদের ট্যুর শুরু হল সেখানেই মানে ফ্র্যাঙ্কফুর্টে । তাই আপাততঃ পলের পাঞ্চজন্য ঘোষিত হল " গুড, মর্ণিং লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান" বলে। পরক্ষণেই বলল, " ক্যান ইউ হিয়ার মি?” বাসে যারা দূরে বসেছে তাদের জন্য। সবাই চুপচাপ ছিল এতক্ষণ। এবার সাতচল্লিশজনের সম্মিলিত চীত্কারে বাস যেন ভেঙে পড়ল...ইয়ে.....স্..স্..স্...স্"
পল নিজের কথা বলল। সে ৫০% জার্মাণ ও ৫০% সাউথ আফ্রিকান। হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়ে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। আর তার বিশালকার ভুঁড়িটির সৌজন্যে ইউরোপিয়ান বিয়ার ব্রুয়ারী। সেই অজস্র ঋণও স্বীকার করে ফেলল অনায়াসে, একমূহুর্তে । বাসের সাতচল্লিশজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া থেকে ট্যুরের রোজনামচায় রিয়েল সোশ্যালনেটের অ্যাডমিন হয়ে র‌ইল এই জার্মাণ যুবকটি।
বাসের সিটে বাই রোটেশান রোজ বসতে হবে আমাদের। যাতে আমাদের সকলের সাথে সকলের বন্ধন আরো মজবুত হয়। আর কে সামনে, কে পেছনে এই নিয়ে মারামারিও হবেনা। আমেরিকার এক বরিষ্ঠ নাগরিক এসেছেন। অশীতিপর বৃদ্ধ দম্পতি। হলুদ দাঁত বেশ ক্ষয়ে গেছে। মহিলাটির দুচোখের ছানি বেশ পেকে গেছে। গিয়েই বুঝি তুলে ফেলতে হবে। তাঁরা সফিষ্টিকেটেড সূত্রধর। আমি এঁদের নাম দিলাম মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস ছুতোর। এঁরা বেশ নির্বিবাদী। আমি যতটা মাংস একা না খেতে পারি ওঁরা অবলীলায় খেয়ে নেন রোজ রোজ। আমার বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা হয় কিন্ত ওঁরা তাঁদের নিরলস পা-গাড়ী টানতে বেশ সক্ষম। দুজনে বেশ হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আমাদের মত মোটেও নয়। এবার আসি একজোড়া মা-মেয়ের কথায়। মা'টি আমেরিকান ষাটোর্দ্ধ সুন্দরী। এককালে ছিলেন হেডটার্নার বা সেক্সবম্ব যাই বল। এখনো ছিপছিপে অর্থাত স্লিম এন্ড ট্রিম। তার মেয়েটি কুড়ি বাইশের কিন্তু ফার্ষ্টফুডের আধিক্যে তার সারা দেহে স্নেহপদার্থের আধিক্যের দরুণ তর মায়ের চেয়ে তাকে বয়স্ক বলে মনে হয়। মায়ের চুল ছাঁটা আর মেয়ের চুল শনের মত স্ট্রেইট, ঘাড় ছাড়িয়ে কাঁধের ওপরে। মা সোজা হাঁটে, মেয়ে কোলকুঁজো। মায়ের শর্টস পরা পা দুটি যেন ঈষত ক্ষীণকায় কদলী বৃক্ষের মত আর মেয়ের দুটি ট্রান্সফ্যাটের সৌজন্যে বেশ বলিষ্ঠ এবং দুটিতে ঘর্ষণের কারণে তফাতে চলে। মা হাসে উচ্চৈঃস্বরে, মেয়ে শান্ত, গম্ভীর। হাসিঠাট্টায় তার বড়োএকটা হেলদোল নেই। মা বেশ ঝগড়ুটে, মেয়ে আপোষে মেনে নেয় সবকিছু। মেয়ের চোখমুখ দেখে নাম দিলাম হ্যারিপটারের মোর্নিং মাটল। মনে মনে বলি মেয়ের কি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে? তাই কি তার মা তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে? সাধারণতঃ এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বেড়াতে বেরিয়ে হেসে খলখল, গেয়ে কলকল করে। পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ করে। আমার পুত্রটিতো তেমনি।
মা'টি অহোরাত্র মেয়ের ওপরে ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত। এই বুঝি তার মেয়ে আমাদের পলের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল, তার চোখ ঘুরছে সর্বদা। মেয়ের চুলের লকস চোখের ওপরে পড়লেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে লকস জোড়াকে কানের পাশ দিয়ে ঠেলে দিচ্ছেন। কেন তুমি আজ হাঁটুর ওপরে শর্টসের সাথে এই জুতোজোড়া পরেছ অথবা ডিনারে পঙক্তি ভোজে বসেই কেন ব্রেডা টুকরোতে কামড় বসাচ্ছো...ঠিক যেন সেই রাজকুমারী সিনেমার মায়ের মত।
আরেক জোড়া অষ্ট্রেলিয়ান মা-মেয়েও রয়েছে। আশি ছুঁই ছুঁই বেরিল আর তার মেয়ে জেনিস। এই মা'ও তার মেয়ের তুলনায় খটখটে। মা স্লিম, মেয়ে বেশ নধর। বেরিল এর রোজ দুবেলা দু মাগ বিয়ার চাই-ই। বিয়ারেই তাঁর মোক্ষলাভ...তিনি একথা বিশ্বাস করেন। পাব এ গিয়ে বেরিল বুড়ির যা নাচ দেখেছি তা ভুলবনা। জেনিস নাচেনা কিন্তু দারুণ গায়। বলিরেখার আধিক্যে বেরিলের সর্বাঙ্গ কুঞ্চিত কিন্তু বেরিল মোটেও দমবার পাত্রী নন। আমি এই মা-মেয়ের নাম দিলাম বেড়ালমাসী ও ছানা। এক আমেরিকান ভদ্রলোক এসেছিলেন একা। তাঁর নাম উইলিয়াম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। আমার ছেলের সাথে বেশ দোস্তি হল তাঁর। তাঁর শ্বশ্রুগুম্ফসম্বলিত চোখমুখের হাবভাব দেখে মনে হযেছিল ক্রিমিনাল সাগার হিরো বুঝি কিন্তু আলাপে বেশ ভাল লাগল। নির্বিবাদী এই জেন্টলম্যান সার পৃথিবী চষে বেড়ান তবে ইনি সধবা না বিধবা না হতবান্ধবা তা বুঝতে পারিনি। বাই দ্যা ওয়ে আমার প্রত্যেকটি সালোয়ার স্যুট এনার খুব মন কেড়েছে। ইন্ডিয়ান ড্রেসের রংগুলি বেশ লেগেছে তাঁর।
আরো এক মা-মেয়ে ছিল। তবে সারাটা ট্রিপ তারা মুখ খোলেনি। এমনকি পাশে বসে খাবার সময়েও নয়। কি জানি আমরা বুঝি গাঁইয়া ভূত তাই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি তার। মা'টি রূপের দেমাকে মটমটান। আর মেয়েটি নিজেকে প্রিন্সেস ডায়না মনে করে। মায়ের শনের মত ব্লন্ড হেয়ার চোখের সামনে যেভাবে পড়ে থাকে তাতে অর্ধ নিমীলিত চোখ দুটিকে আলো আঁধারিতে ডাইনি বলে ভ্রম হবে। আমি এদের নাম দিলাম ডাইনি ও ডায়না। এরা বুঝি সবচেয়ে বেশী পোষাক এনেছিল। আর কমপক্ষে দশজোড়া করে ম্যাচিং জুতো এনেছিল সঙ্গে। বিশ্বাস করো, আমি গুনেছি।
লাসভেগাস থেকে এসেছিল এক চাইনিজ যুবতী। সে "একল চলোরে" পন্থায় বিশ্বাসী। একগন্ডা ভাইবোনের মধ্যে মানুষ হয়ে নিজেই ঘুরে বেড়ায় এখন। এর নাম সত্যি ডায়না। এর আমার কাঁথাস্টীচের স্কার্ফগুলো খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে বলল, তুমি শাড়ি পরবেনা? শুনে ভালোই লাগল। ছিলেন এক coptic ক্রিশ্চান দম্পতি। তারা ইজিপ্টের লোক। থাকেন শিকাগোতে।প্রথমদিন বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, আর ইউ হিন্দু? আমি বললাম ইয়েস এন্ড প্রাউড টু বি হিন্দু। তার উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের অনেক হিন্দু বন্ধুবান্ধব আছে। হিন্দুদের আমি খুব পছন্দ করি। আমি বললাম, তোমার কি দেখে মনে হল আমি হিন্দু? তিনি বললেন তোমার চোখ। শুনে ভালো লাগল। বলেই বললেন, আই লাভ হিন্দু কালচার, হিন্দু এটিকেট এন্ড দ্যা ওয়ে অফ লিভিং। আমি বললাম, একটা বিন্দু দিয়ে গ্রাফ টেনোনা জেন্টলম্যান।
এই ভদ্রলোকের সত্তরোর্ধ্ব স্ত্রী এসেছেন। বেশ সুন্দরী আর সাজপোষাক বেশ পাল্টে পাল্টে করেন। এনার হাতে একটি প্যাচ দেখে জিগেস করায় বললেন উনি ব্রেষ্ট ক্যানসার এ আক্রান্ত। রেডিয়েশান চলছে ঐ প্যাচের মাধ্যমে। তার জুয়েলারী, জুতো আর পোষাক বদল দেখে মনে হল "ক্যানসার? তো কি? আই ডোন্ট কেয়ার।" যেন ডায়রিয়া হয়েছে কিম্বা জ্বর। বেড়াতে গিয়ে তা হলেও আমরা ভয় পেয়ে যাই। ২৪x৭ রেডিয়েশান নিয়েও ওনার বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। ফেসবুকে ছবি আপডেট করছেন, হোয়াটস্যাপে নাতিনাতনীর সঙ্গে কথা বলছেন, জুয়েলারী কিনে চলেছেন এখনো। এনাকে অহোরাত্র মনেমনে কুর্ণিশ জানিয়েছি আমি। মনে মনে বলেছি, এমনি থেকো মিসেস গুরগুইশ। টেক কেয়ার। ভালো থেকো!

No comments:

Post a Comment