Wednesday, May 18, 2016

বোহেমিয়ান ডায়েরী -পর্বঃ(২)

বার্লিন বৃত্তান্ত 

রদিন ভোরে উঠে সাড়ে ছটায় ব্রেকফাস্ট, স্নান সেরেই বাসে উঠে পড়া ফ্র্যাঙ্কফার্ট থেকে বার্লিনের উদ্দেশ্যে। শহর ছেড়ে বাস ছুটে চলল আমাদের হাইওয়ে সমতুল চওড়া রাস্তা অটোবান (autobahn)  দিয়ে। দুপাশে সবুজ অরণ্য আর মাঝেমাঝে ক্যানারী হলুদ রঙের ক্যানোলা চাষের আদিগন্ত  ক্ষেত। প্রথমে ভুল করি সর্ষে ক্ষেত ভেবে। কিন্তু জন জানালো ক্যানোলা এখানে বায়ো ফুয়েল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হলুদ রংয়ে চোখ আটকেই থাকে, এত সুন্দর সেই রং। 
আর সারে সারে  উইন্ড মিল ঘুরছে এবং ঘুরছে হাওয়ার আনুকুল্যে। এই উইন্ড মিল ইউরোপের একটি বৈশিষ্ট্য। এখনো বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত উত্পাদন হয় এখানে।   এবার এল চেকপয়েন্ট। ইষ্ট ও ওয়েষ্ট জার্মাণীর মাঝ বরাবর আমরা। সকালের প্রথম পিটস্টপ। ইউরো খরচ করে টয়লেট আর সাথে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের লুকোচুরির সঙ্গে কনকনে শীতের ধারালো  ঠান্ডা হাওয়ার সাথে মোকাবিলা। 



এবার পলের মুখে সেই যুদ্ধের গল্প শোনার পালা। ছোটবেলায় রাহুল দাদাইয়ের গলা জড়িয়ে বলত, তারপর হিটলার কি করল দাদাই? হিটলার কি খুব দুষ্টু লোক ছিল? বাবা বলতেন, এই ব‌ইখানা বড় হয়ে পড়বে তুমি। ব‌ইয়ের নাম "দ্যা হিষ্ট্রি অফ দ্যা থার্ড রাইক"  । দাদাইয়ের কাছ থেকে গল্পশোনার পালা যখন শেষ হল সেই ব‌ইখানা সে বার পাঁচেক পড়ে ফেলেছে আর তার নিজের বাবা আর আমার বাবার সঙ্গে রীতিমত বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায় সরব হয়েছে। মূলতঃ রাহুলের উদ্যোগেই একদা বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসময় প্রেক্ষাপটে এবারের ভ্রমণ।  
একদা কেলটিক উপজাতির অধ্যূষিত ইউরোপের এই বার্লিন শহরে আমাদের প্রবেশ হল বিকেলে। পেরুলাম এলব নদী। এলব হল মধ্য ইউরোপের অন্যতম বৃহত নদী।   

ইষ্ট  বার্লিনে পৌঁছলাম সন্ধ্যের ঝুলে। ইষ্ট বার্লিনে ট্রামের নেটওয়ার্ক খুব জোরালো। ওয়েষ্ট বার্লিনে ট্রাম নেই। রাস্তায় অগণিত ঝকঝকে ট্রাম এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে চলেছে যাত্রী নিয়ে।  আকাশে তখনো সূর্যের আলো জ্বলজ্বল করছে। তবে হাওয়ার দাপটে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হল। বাস গিয়ে থামল শহরের অন্যতম ব্যস্ত রেস্তোঁরায়। মালিকের নামে যার নাম "জিকো" বৃদ্ধ মালিক জিকো নিজে হাতে ওয়েলকাম শ্যাম্পেন  ধরিয়ে দিল হাসিমুখে। তারপর রেস্তোঁরা কাম পাবের অন্দরে আমাদের দঙ্গলের প্রবেশ। আসন গ্রহণের পর ঠান্ডা বিয়ার এল। এবার শুরু হল লাইভ মিউজিক। জিকো এভারগ্রিণ। তার কেরামতিতে খাদ্য ও খাদকের   এক অদ্ভূত মেলবন্ধন রচিত হয়। জিকোর পোশাক থেকে হাসিমাখানো মুখ আর কাটলারি-ক্রকারি নিয়ে জাগলারি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের বৃদ্ধদের কথা। এখানকার বুড়োরা কি সুন্দর করে বাঁচতে জানে! কত প্রাণবন্ত এরা!  আর রেস্তোঁরায় একপাল তরুণ তরুণী কাজ করে চলেছে কিন্তু জিকো এদের মধ্যমণি। খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। এখানে কেবল গ্রিলড প্রোটিন পাওয়া যায় অর্থাত ফিশ, চিকেন, পর্ক অথবা ল্যাম্ব গ্রিল করে প্লেট সাজিয়ে দেওয়া হয় সেদ্ধ সবজীর বিছানায়, একটু ধবধবে সাদা সরুচালের ভাতের চৌকাঠ পেরিয়ে মুচমুচে ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের বেড়া দেওয়া বাগানে। বেড়া  ডিঙিয়ে একটুকরো পাতিলেবুর ছোঁয়া।    
সঙ্গে ধূমায়িত মাশরুম স্যুপ আর মাখন-রুটি।  আসতে লাগল থরে থরে  ওয়াইন ও লিকার। গ্রেপস এবং গ্রেইন। উদ্দাম মিউজিক চলছে তখনো। পরিচিত গানে আমরাও গলা মেলাই।  আমাদের গ্রুপের বৃদ্ধ বৃদ্ধারাও নাচতে শুরু করেছেন। আবারো মনে পড়ে দেশের মানুষগুলোর কথা।   মনে মনে বলি আমার পাড়ার হরিবাবুকে কিম্বা রেখামাসীমাকে। এভাবেই বয়স ধরে রাখতে হয় নয়ত পিছিয়ে পড়তে হয় বুঝি। মেইনকোর্স ডিনার শেষে পৌঁছে গেল সেরাতের সুইট ডিশ । সুচারুভাবে পরিবেশিত প্যানকেকের মধ্যে আইসক্রিম  এবং ওপর থেকে হট চকোলেট সস ঢেলে দেওয়া হয়েছে অকৃপণ হাতে।   
সবশেষে ছোট্ট শটগ্লাসে একটুকু  jagermeister , এক ধরণের ডাইজেষ্টিভ লিকার । বেশ এনজাইম এনজাইম গন্ধ।  জিকোর জয়ধ্বনি দিয়ে পাব থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সেই রাতে হাজির হলাম ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের ধারে। বহু পুরণো ঐতিহাসিক জায়গা। এখানে রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল হত। বিশ্বযুদ্ধে সবকিছু ক্ষ্তিগ্রস্ত হলেও এই ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটটি বেঁচে গিয়েছিল। সেটিকে এখন আরো সুন্দর করে রাখা হয়েছে । তার চারপাশে ইষ্ট বার্লিনের এমব্যাসি । রাস্তার ধারে ধারে  লিন্ডন গাছ দিয়ে সাজানো বনবীথি। আমাদের চৌরঙ্গী স্কোয়ারের মত।  এই জায়গার নাম উন্টার ডি লিন্ডন বা আন্ডার দ্যা লিন্ডন ট্রি ।  
রাতের অন্ধকারে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেই হোটেলে চম্পট। সারাদিনের ক্লান্তি মেখে ঘুমে জড়িয়ে এল চোখ। পরদিন আবারো ব্রেকফাস্ট সেরে ইষ্ট বার্লিনের এই অঞ্চলকে ভালোভাবে দেখার পালা। টিভি টাওয়ারটি হল জার্মাণির সবচেয়ে উঁচু মনুমেন্ট। এটি আলেকজান্ডার Platz ( প্লাজা )র কাছেই অবস্থিত। আলেকজান্ডার প্লাজাটি হল এখানকার অন্যতম বৃহত শপিং সেন্টার।   
    

No comments:

Post a Comment