Saturday, November 19, 2016

বিচিত্র রূপসী বাংলা

কসময়ের  মশলা আর মসলিনের বাংলা এখন পাহাড়, অরণ্য, মন্দির, নদী, সমুদ্রে পরিবেষ্টিত  বৈচিত্র্যময় পর্যটনের রূপসী বাংলা । তারই মায়ায় ছুটে চলি আমি। শুধু তারিয়ে তারিয়ে সেই রূপ দেখব বলে আর ফিরে এসে তাকে নিয়ে লিখব বলে। 
বেড়াতে যাবার আগেই প্রতিবার ভাবই রাজ্যেই কোথাও একটা যাব কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় রাজ্যের বাইরে।    আমাদের রাজ্যে D আছে কিন্তু C নেই। D মানে ডেষ্টিনেশন, D মানে ডাইভার্সিটি। কিন্তু C এর অভাব। এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে আমার রাজ্য এ একটা C জ্বলজ্বল করছে সেটা হল cheap কিন্তু এর সাথে বাকী C গুলো absent. we can compromise on COST but in lieu of that expect convinience and comfort । কিন্তু ট্র্যাভেলিংয়ের সবকটি প্যারামিটার কি পাই আমরা? অথচ উত্তরে হিমালয়, ডুয়ার্স থেকে দক্ষিণে সাগরদ্বীপ,  সুন্দরবন,  পশ্চিমে পুরুলিয়ার অযোধ্যাপাহাড়, গড়পঞ্চকোট থেকে পূর্বে  মেদিনীপুরের কুরুম্ভেরা ফোর্ট কিম্বা গনগনির মাঠ? কত কত সুন্দর জায়গা এ রাজ্যে, শুধু ট্যুরিজমের ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার নেই।  

লাটাগুড়ির কুয়াশামাখা অরণ্য

তবুও গ্রীষ্মে যাই উত্তরবাংলায় তো শীতে ঝাঁপ দি সাগরের বুকে। 
হিমালয়ের কোলে অপূর্ব পাহাড়ি গ্রামে যাই, দুটিপাতা-একটি কুঁড়ির স্বর্গরাজ্যে। রোদের কণা লুটোপুটি খায়  চা-পাতায়।  দিগন্তের নীল আর  সবুজের মাখামাখি  দেখে  মনে পড়ে রবিঠাকুরকে... আলোর নাচন পাতায় পাতায়, এই তো ভালো লেগেছিল । 
গরুমারায় জিপ সাফারি। ভোর হতে না হতেই ময়ূরের ঘুম ভাঙানিয়া কর্কশ ডাক শহুরেদের কানে মিষ্টি লাগে ।  জিপের ধারালো হাওয়ায় আবার শীতকে নতুন করে পাওয়া ।  জঙ্গলমহল থেকে বেরিয়ে আসা  বাইসন, হরিণ অথবা  মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সবুজ পায়রা,  ঠোঁটসর্বস্ব ধনেশ পাখি!  ডিজিটাল ক্যামেরায় ক্লিক, ক্লিক! ভীতু বনমোরগের পেছনে ছুটতে ছুটতে দেখি গন্ডার! কি রাজকীয়! আমার রূপসী বাংলার ঐশ্বর্য্য এরা। 

 
শঙ্করপুরের সমুদ্র তটে

শীতের রোদের গনগনে আঁচে ছুটে যাই সাগরের দিকে । সুন্দরবনের নোনা জল ছুঁই আর আমার মনখারাপের সব ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে সেখানে। বাংলাকে আমি যেন নতুন করে পাই তখন। সুন্দরবন নামটিতে  যতটা সৌন্দর্য্য ঠিক ততটাই সুন্দর তার ভৌগোলিক চেহারা। সেখানে মানুষের প্রতিনিয়ত  ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমীর নিয়ে  বেঁচে থাকা । চরাচর জুড়ে নোনাজলের ঐশ্বর্য্য যার অনন্ত, অসীম জলরাশির মাঝে লুকিয়ে থাকে অগণিত সজীব আর সবুজ। গল্পকারের ভাষায় যা হয়ে ওঠে মূর্ত, ভ্রমণপিপাসুর কলমে যা হয়ে ওঠে আরো প্রাণবন্ত। কালের স্রোতে তার ভূগোল পুরোনো  হয়না এই বায়োডাইভার্সিটির অন্যতম নিদর্শনে ।
সুন্দরবনের জল-জঙ্গলের কাব্য
কাজের চাপে শীত ফুরায়।  ভাবতে ভাবতেই দোল ফুরোয় । অমৃত কমলার মিঠে রোদ, উলকাঁটার দুপুর গড়িয়ে সেদিন চৈত্রমাস।   চৈত্রের গনগনে আগুণ দুপুরবেলা । কখনো পাতাঝরার টুপটাপ আর পলাশ-শিমূলের শুকনো ডালে কোকিলের  ডাক ।   মনে পড়ে অক্ষয়কুমার বড়ালের মধ্যাহ্নের ছবি । নিথর চৈত্র ফাগুনে  তালদিঘীতে রাজহংসীর মাথা ডুবিয়ে দুপুরস্নানের ফাঁকে গেঁড়ি গুগলি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন। সিঁদুরে ল্যাটেরাইট মাটিতে পা দিয়েই গনগনির মাঠ। ওদিকেই শিলাবতী নদীর বিছানা পাতা । শীতে অনেকটাই শুষ্কতা শিলাইয়ের বুকে । আবার ভরাবর্ষায় রূপ দেখাবে সে । লালমাটির খেয়ালে কি বিচিত্র সৃষ্টি হয়েছে।  যেন পাহাড়ের গায়ে কে খোদাই করে রেখেছে গ্রামবংলার চালাঘর, মন্দির, বারান্দা, কুঠিবাড়ি, সাধুসন্ত , বারান্দা । যেন কালের স্রোতে ধুয়ে গিয়েও ক্ষয়ে যায়নি  । অথচ এটা কৃত্রিম নয় । এ হল বাংলার গ্র্যান্ডক্যানিয়ন।  

বাঙলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়, গনগনি 
কোনোবার বসন্তের ভোরে ছুটে গেছি লালমাটির দেশে।  সকালের মিষ্টিরোদ এসে পড়েছে  শালবনের মাথায়, বসন্তের কচি সবুজপাতায় । চেনাপথ যেন আরো নবীন সজীবতায়  । সজনে গাছ তার ভর-ভরন্ত রূপ নিয়ে, সজনেফুলের গন্ধ মেখে পলাশ তার লাল নিয়ে । পৌঁছে গেছি সত্যজিত রায়ের প্রিয় শুটিং স্পট মামাভাগনে পাহাড়ে। নীল এক আকাশের নীচে একসাথে কত জীবন্ত পাহাড়ের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান। কেউ যেন একটা বিশাল অঞ্চল জুড়ে, অগোছালো করে  রেখে দিয়ে গেছে কত কত পাথর, নানা আকৃতির কত কত নাম না জানা পাহাড় হয়ে উঠেছে সেগুলো । ছোট, বড়, মেজো, সেজো, ন', রাঙা,  ফুল, কুট্টি, আন্না  !
 সত্যজিত রায়ের প্রিয় শ্যুটিং স্পট, মামাভাগ্নে পাহাড়
ভোরের গোলাপী কুয়াশা দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই পাঞ্চেত পাহাড়ের গায়ে গড়পঞ্চকোটপাহাড়ে ট্রেকিং। নামের উত্সমূলে পঞ্চকোট পাহাড়। পুরাণের পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট শেখর পর্বত।   শাল-মহুয়া-পলাশ-আকাশমণির জঙ্গল পরিবেষ্টিত পাহাড়ের মাথায় নদীর ঝোরা আর অতি প্রাচীন রঘুনাথজীর  মন্দির ।  নীচে প্রবেশদ্বারেই দুয়ারবাঁধ তোরণ, পোড়াইঁটের পঞ্চরত্ন মন্দির,  রাসমন্দির, রাণিমহল সবকিছুই ছিল একসময়,  সব মিলিয়ে যার নাম গড়পঞ্চকোট । 
গড়-পঞ্চকোটের কালের দলিল
এই মন্দিরের প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে। প্রাচীন মন্দিরের ঐতিহ্যময়তা, গঠনশৈলী আর এদের ঘিরে পুরোণো কিংবদন্তী আমাকে টেনে নিয়ে চলে মেদিনীপুরের পাথরা গ্রামে কিম্বা কুরুম্ভেরা দুর্গে। মেদিনীপুর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এই পাথরা গ্রাম । যেখানে মন্দির যেন আজো কথা বলে ওঠে। মন্দিরময় পাথরা গ্রামে রয়েছে চৌত্রিশটি এমন পুরোণো মন্দির।  মেদিনীপুরের পথ, পাথরার রাস্তা খুব ভাল । ধান খেতের সবুজ চলল আমাদের হাত ধরে । পেরোলাম মাইলের পর মাইল আলুর খেত, গাঁয়ের বীথিপথ। শীতের শুকনো ঝরাপাতাদের পেছনে ফেলে রেখে চললাম কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে । ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি, কদম, সেগুন আর বাঁশ ঝাড়ের সারি ।
পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দির পেরিয়ে কাঁসাই নদী দেখা গেল আর বাঁদিকে এল সেই মন্দিরময় পাথরা গ্রাম ।
মন্দিরময় পাথরা

ছোট মন্দির, বড় মন্দির,  মন্দিরের ধ্বংস স্তূপ আর মন্দিরের সংলগ্ন গ্রাম, খেত খামার, ধানের গোলা, পুকুর কি নেই এখানে । নানান  ধরণের, নানান গড়নের । এক একটির ভাস্কর্য এক এক রকম ! তবে সবকটি মন্দিরই  বাংলার ট্র্যাডিশানাল চালাঘরের আদতে বানানো । মন্দিরময় পাথরা গ্রামটির মানুষজন যেন  যুগযুগ ধরে মন্দিরগুলিকে বুকে করে আগলে আসছে । মন্দিরের গায়ের লেখা থেকে জানা গেল  যে সেগুলি প্রায় ৫০০ বছরের পুরোণো।
খড়গপুর থেকে কেশিয়াড়ির পথ ধরে কিছুদূর গেলেই পড়বে বিশাল দুর্গময় কুরুম্ভেরা। বাইরে  বিশাল উঁচু প্রাচীর পরিবেষ্টিত দুর্গটি দশ ফুট উঁচু এবং বিশাল মাঠের মধ্যিখানে প্রায় ৩০ বিঘে স্থান জুড়ে এই দুর্গ ।
পাথর দিয়ে কেটে কেটে তৈরী । যেন চক মিলোনো রাজপ্রাসাদ ! একদিকে উঁচুতে নাটমন্দিরে তিনটি মন্দিরের গড়নে স্থাপত্য  রয়েছে ।
এর মধ্যে একটি শিব মন্দির আছে ।  ওড়িয়া লিপি থেকে জানা যায় ১৪৩৮-১৪৬৯ সালে তৈরী হয়েছিল এই ফোর্টটি । ছমছমে দুর্গপুরীর দুর্গের নাম "কুরুম্ভেরা"। গুগলম্যাপ দিশা দেখিয়ে দেয় অচেনা ও অজানা এই সব পথের। নিজের শহরের এত কাছে আর্কিওলজিক্যাল সোশাইটির দেখভালে এত সুন্দর মন্দির আর দুর্গ যে রয়েছে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। 
কুরুম্ভেরা দুর্গ
আর আমার রূপসী বাংলার উইকএন্ডগুলোর কথা? ডায়মন্ডহারবারের গঙ্গার ধারে ফলতা কিম্বা বাসন্তী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা ইছামতীর ধারে বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত টাকী? অথবা বসন্তের পাহাড়ে পলাশের আগুণ লাগা মুকুটমণিপুর কিম্বা মন্দারমণি বা শঙ্করপুরের  সমুদ্রসৈকতে ।  চব্বিশ ঘন্টার ফুরসত মিললে শঙ্করপুর বেশ উপভোগ্য। সাদাবালির চরে একলহমায় সমুদ্র তট দেখে পরখ করতে হয় নোনা জলের সাদাফেনায় ছুটে আসা জলের  রঙ,  ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের আনাগোনায় আছড়ে পড়া মুঠো মুঠো ঝিনুক, তারা মাছ, শঙ্কর মাছেরা, বালির চরে আসর বসায় ।  দলবেঁধে আসা বকের সারি উড়ে যায় ক্যাসুরিনার ফাঁক দিয়ে, খেয়ে যায় বাঁশপাতা মাছ সমুদ্রের তট থেকে, ঢেউ এসে নিয়ে যায় বিকেলের সূর্যাস্তের রং। সব মনখারাপের দুপুরগুলো আছড়ে পড়ে সেই ঢেউতে । ক্লান্ত  সূর্য তখন আপন মনে রঙ ছড়িয়ে চলে পূর্ব মেদিনীপুরের পশ্চিম আকাশের গায়ে। সন্ধ্যেবেলা ছমছমে সমুদ্রতটে শুধু ঢেউয়ের গর্জন । প্রতিদিন সূর্যের এই অবসর নেওয়ার মূহুর্তে ঝাউবনে  পাখ-পাখালির ঘরে ফেরার  কলরব আর বালির চরে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ,  নিঝুম নিসর্গকে নতুন করে পৌঁছে দেয় মনের আঙিনায় ।  সূর্যাস্তে শঙ্করপুর একরকম আর সূর্যোদয়ে অন্যরকম । 
প্রত্যূষে উত্তরদিকে তখনো জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা আর পশ্চিম আকাশে শুকতারা  । অন্ধকার ভোরে কত রকমের শাঁখ  ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে আসে আর আসে চিতি কাঁকড়ারা ছটফট করে ধেয়ে  । সমুদ্রের বুকে জন্ম নেয় নতুন ঢেউ আর তীরে এসে ভাঙে  । দেখতে দেখতে পুব আকাশের গায়ে রঙ ছেটাতে আসে ভোরের  বালক সূর্য । আকাশ চিরে চিরে লাল, নীল, গোলাপী রঙের দাগ আর লুকোচুরি খেলতে খেলতে সেই আবীর রঙা আকাশের কোল থেকে উঁকি মারে সে ।
রূপসীবাংলার গল্প এক বৈচিত্র্যময় রূপকথার মত। এ গল্প ফুরোয়না। কালেকালে আরো যেন রূপবতী হয় আমার বাংলা। থৈ থৈ তার রূপ লাবণ্য নিয়ে।
সুন্দরবনের কুমীর

 কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে যদিও তবুও প্রাণ কেঁদে ওঠে রূপসী, বৈচিত্র্যময়ী পর্যটনের বংলায় ভ্রমণের জন্য।

যেমন  
  • কলকাতা থেকে গাড়ি করে সাগরদ্বীপ যাওয়াটাও এখন সহজ হয়েছে। ডায়মন্ডহারবার রোড দিয়ে কাকদ্বীপ অবধি গিয়ে হার‌উড পয়েন্ট থেকে ফেরি নিতে হবে । সকল তীর্থযাত্রীরা সেই পয়েন্টে জমায়েত হন। এইস্থানকে লট-৮ এর ঘাটও বলে। জেটি পেরিয়ে স্টীমারে করে সাগরদ্বীপ পৌঁছতে সময় লাগে ৪৫মিনিটের মত। গাড়ি ওপারে গ্রাম পঞ্চায়েতের পার্কিং ফি দিয়ে রেখে চলে যাওয়া যায়। দুরাত্রি আমার মূল্যবান গাড়িটি থাকবে সেখানে অথচ সেই স্থানটি বেশ চিন্তার। সেই জায়গাটা আরেকটু সিকিওর্ড হলে ভাল হয়। কচুবেড়িয়া পৌঁছে এবার ভাড়ার গাড়ি করে গঙ্গাসাগর যেতে লাগে ঘন্টাখানেক।   
  •  ওয়েষ্ট সিকিমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ছায়াতাল খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু সেখানে পোঁছতে গিয়ে একটা দিন পুরো লস। অসম্ভব খারাপ পাহাড়ি রাস্তা। অথচ ছায়াতালে পৌঁছে মনে হল এমন একটি পাহাড়ে ঘেরা ফুলের স্বর্গ্যরাজ্য আছে জানতাম না।

  •  সেবার ভুটান ফেরত ডুয়ার্সের চিলাপাতার জঙ্গলে থাকব বলে বুকিং করে রেখেছিলাম। সেখানে পৌঁছে না ইলেকট্রিক, না জল। এবার প্যাকেজ ট্যুরের টাকাপয়সা দিয়ে রেখে এমন সার্ভিস অত্যন্ত  চিন্তার।
  •  লাভা লোলেগাঁওতে গিয়ে রিশপের আনন্দটাই মাটি। ২০০০ টাকার হোটেলগুলি আপ টু দ্যা মার্ক নয়। বেড শিট, towel, টয়লেট, এগুলোর সাথে কম্প্রোমাইস করা যায়না।
  •  লাটাগুড়ির নেওড়া ভ্যালি চা বাগানে গেলাম আরেকবার সেখানে সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু  ঘুরে বেড়ানোর গাড়ির ভাড়া নিয়ে বেশ দ্বিধা দ্বন্দে পড়েছিলাম। এয়ারপোর্টে নেমেও প্রতিবার মনে হয় ঠকে গেলাম না তো! কথাতেই বলে অতিথি দেব ভব! কিন্তু গন্তব্যে পা রেখেই এমন হলে খুব আপসেট হতে হয়।  অথচ এমন তো হবার কথা নয়।  
  •  বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত ইছামতি নদী দেখব বলে টাকী যাওয়ার প্ল্যান হল। কোনো বুকিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। অনলাইন কোনো ব্যাবস্থা নেই আর যে সাইটগুলি আছে সেগুলির ফোন নাম্বার অচল। অগত্যা নিজেরাই প্ল্যান করে আচমকা গিয়ে সেদিনই ফিরে এলাম।  অথচ কি মনোরম সেই নদীর ধার আর পরিবেশ সেখানে একরাত না থাকলেই নয়।  

  •  সত্যজিত রায়ের অত্যন্ত প্রিয় শুটিং স্পট মামাভাগনে পাহাড়? ক'জন গেছেন জানিনা কিন্তু শান্তিনিকেতনের খুব কাছেই। এত সুন্দর একটি জায়গায় অগণিত পাহাড়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আপনি অনলাইন খোঁজ চাইলে কেউ দিতে পারবেনা আপনাকে।

  •  তেমনি গড়বেতার কাছেই গনগনির মাঠ? পশ্চিমবাংলার ছোটখাটো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। অথবা মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ির পথ ধরে কুরুম্ভেরা দুর্গ? কিম্বা খড়গপুরের কাছেই মন্দিরময় পাথরা? এগুলো সব আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে  কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর না আছে রোড ম্যাপ না কেউ বলতে পারে হদিশ, কিম্বা যেতে কতক্ষণ লাগবে। আমাদের কর্মসূত্রে মেদিনীপুর থাকার সুবিধেয় উইকএন্ডে গুগলম্যাপ হাতে নিয়ে নাহয় পৌঁছাতে পেরেছি আর দিনে দিনে ফিরে এসেছি খড়গপুরে কিন্তু ট্যুরিষ্ট টানতে চাই প্রকৃত জনকারি। ইনফরমেশান । আর ট্যুরিস্ট না গেলে কি করে পরিচিত হবে এই প্রত্যন্ত স্থানগুলি। আমি ব্লগিং করি। আমার কাছে মেইল আসে। ফেসবুকে শেয়ার করি । সোশ্যালনেটের হাত ধরে কেউ কেউ  জানতে চান আর চলে যান কিন্তু ট্যুরিষ্ট ফ্রেন্ডলি না হলে, সাফিসিয়েন্ট ইনফরমেশান না থাকলে কি করে নতুন নতুন ট্যুরিস্ট যাবেন এখানে?

  • তেমনি শীত পড়লেই মনে হয় সুন্দরবনের কথা কিন্ত যাওয়া আসার পথ? কিছুটা হয়ত ভাল রাস্তা কিন্তু বেশ কিছুটা খারাপ থাকবেই বা কেন এখনো? এমন সুন্দর  জল-জঙ্গলের সহাবস্থান এর কথা মাথায় রেখে আমাদের ভাবা দরকার।  

  • গড়পঞ্চকোটের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না ।  অথচ থেকে যাব বললে থাকার উপায় নেই কারণ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লজে চেনা পরিচিতি না থাকলে থাকা যায়না। অগত্যা ফিরে আসতেই হয়েছে একদিনের মধ্যেই। রাস্তার ধারে হোটেলগুলির তেমনি দুরবস্থা। গেস্ট নিয়ে গেলে একদিকে গর্বে বুক ফুলে ওঠে অন্যদিকে লজ্জা করে সাধারণ ভাতের হোটেলে অতিথিকে আপ্যায়ন করতে। 

Monday, May 30, 2016

বোহেমিয়ান ডাযেরী ( পর্ব- ৪ )


OMG ! ও মা গো! এই বাহুবলী হোঁদল কুত্কুত পল' কে ঠেলে রোজ আমাকে বাসে উঠতে হবে? কিন্তু মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে বাসে উঠে পড়তেই তার কেতাদুরস্ত ট্যুর গাইড সুলভ অ্যাকসেন্ট আর স্মার্টনেস ক্ষণিকেই কলকাতাইয়ার মনে আঁচড় কাটল।
Guten Morgen meine Damen und Herren !
রোজ এইভাষাতেই শুনতে হবে নকি? না, না । জার্মাণীতে পলের জন্ম। আর আমাদের ট্যুর শুরু হল সেখানেই মানে ফ্র্যাঙ্কফুর্টে । তাই আপাততঃ পলের পাঞ্চজন্য ঘোষিত হল " গুড, মর্ণিং লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান" বলে। পরক্ষণেই বলল, " ক্যান ইউ হিয়ার মি?” বাসে যারা দূরে বসেছে তাদের জন্য। সবাই চুপচাপ ছিল এতক্ষণ। এবার সাতচল্লিশজনের সম্মিলিত চীত্কারে বাস যেন ভেঙে পড়ল...ইয়ে.....স্..স্..স্...স্"
পল নিজের কথা বলল। সে ৫০% জার্মাণ ও ৫০% সাউথ আফ্রিকান। হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়ে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। আর তার বিশালকার ভুঁড়িটির সৌজন্যে ইউরোপিয়ান বিয়ার ব্রুয়ারী। সেই অজস্র ঋণও স্বীকার করে ফেলল অনায়াসে, একমূহুর্তে । বাসের সাতচল্লিশজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া থেকে ট্যুরের রোজনামচায় রিয়েল সোশ্যালনেটের অ্যাডমিন হয়ে র‌ইল এই জার্মাণ যুবকটি।
বাসের সিটে বাই রোটেশান রোজ বসতে হবে আমাদের। যাতে আমাদের সকলের সাথে সকলের বন্ধন আরো মজবুত হয়। আর কে সামনে, কে পেছনে এই নিয়ে মারামারিও হবেনা। আমেরিকার এক বরিষ্ঠ নাগরিক এসেছেন। অশীতিপর বৃদ্ধ দম্পতি। হলুদ দাঁত বেশ ক্ষয়ে গেছে। মহিলাটির দুচোখের ছানি বেশ পেকে গেছে। গিয়েই বুঝি তুলে ফেলতে হবে। তাঁরা সফিষ্টিকেটেড সূত্রধর। আমি এঁদের নাম দিলাম মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস ছুতোর। এঁরা বেশ নির্বিবাদী। আমি যতটা মাংস একা না খেতে পারি ওঁরা অবলীলায় খেয়ে নেন রোজ রোজ। আমার বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা হয় কিন্ত ওঁরা তাঁদের নিরলস পা-গাড়ী টানতে বেশ সক্ষম। দুজনে বেশ হাত ধরাধরি করে হাঁটে। আমাদের মত মোটেও নয়। এবার আসি একজোড়া মা-মেয়ের কথায়। মা'টি আমেরিকান ষাটোর্দ্ধ সুন্দরী। এককালে ছিলেন হেডটার্নার বা সেক্সবম্ব যাই বল। এখনো ছিপছিপে অর্থাত স্লিম এন্ড ট্রিম। তার মেয়েটি কুড়ি বাইশের কিন্তু ফার্ষ্টফুডের আধিক্যে তার সারা দেহে স্নেহপদার্থের আধিক্যের দরুণ তর মায়ের চেয়ে তাকে বয়স্ক বলে মনে হয়। মায়ের চুল ছাঁটা আর মেয়ের চুল শনের মত স্ট্রেইট, ঘাড় ছাড়িয়ে কাঁধের ওপরে। মা সোজা হাঁটে, মেয়ে কোলকুঁজো। মায়ের শর্টস পরা পা দুটি যেন ঈষত ক্ষীণকায় কদলী বৃক্ষের মত আর মেয়ের দুটি ট্রান্সফ্যাটের সৌজন্যে বেশ বলিষ্ঠ এবং দুটিতে ঘর্ষণের কারণে তফাতে চলে। মা হাসে উচ্চৈঃস্বরে, মেয়ে শান্ত, গম্ভীর। হাসিঠাট্টায় তার বড়োএকটা হেলদোল নেই। মা বেশ ঝগড়ুটে, মেয়ে আপোষে মেনে নেয় সবকিছু। মেয়ের চোখমুখ দেখে নাম দিলাম হ্যারিপটারের মোর্নিং মাটল। মনে মনে বলি মেয়ের কি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে? তাই কি তার মা তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে? সাধারণতঃ এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বেড়াতে বেরিয়ে হেসে খলখল, গেয়ে কলকল করে। পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ করে। আমার পুত্রটিতো তেমনি।
মা'টি অহোরাত্র মেয়ের ওপরে ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত। এই বুঝি তার মেয়ে আমাদের পলের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল, তার চোখ ঘুরছে সর্বদা। মেয়ের চুলের লকস চোখের ওপরে পড়লেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে লকস জোড়াকে কানের পাশ দিয়ে ঠেলে দিচ্ছেন। কেন তুমি আজ হাঁটুর ওপরে শর্টসের সাথে এই জুতোজোড়া পরেছ অথবা ডিনারে পঙক্তি ভোজে বসেই কেন ব্রেডা টুকরোতে কামড় বসাচ্ছো...ঠিক যেন সেই রাজকুমারী সিনেমার মায়ের মত।
আরেক জোড়া অষ্ট্রেলিয়ান মা-মেয়েও রয়েছে। আশি ছুঁই ছুঁই বেরিল আর তার মেয়ে জেনিস। এই মা'ও তার মেয়ের তুলনায় খটখটে। মা স্লিম, মেয়ে বেশ নধর। বেরিল এর রোজ দুবেলা দু মাগ বিয়ার চাই-ই। বিয়ারেই তাঁর মোক্ষলাভ...তিনি একথা বিশ্বাস করেন। পাব এ গিয়ে বেরিল বুড়ির যা নাচ দেখেছি তা ভুলবনা। জেনিস নাচেনা কিন্তু দারুণ গায়। বলিরেখার আধিক্যে বেরিলের সর্বাঙ্গ কুঞ্চিত কিন্তু বেরিল মোটেও দমবার পাত্রী নন। আমি এই মা-মেয়ের নাম দিলাম বেড়ালমাসী ও ছানা। এক আমেরিকান ভদ্রলোক এসেছিলেন একা। তাঁর নাম উইলিয়াম। তিনি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। আমার ছেলের সাথে বেশ দোস্তি হল তাঁর। তাঁর শ্বশ্রুগুম্ফসম্বলিত চোখমুখের হাবভাব দেখে মনে হযেছিল ক্রিমিনাল সাগার হিরো বুঝি কিন্তু আলাপে বেশ ভাল লাগল। নির্বিবাদী এই জেন্টলম্যান সার পৃথিবী চষে বেড়ান তবে ইনি সধবা না বিধবা না হতবান্ধবা তা বুঝতে পারিনি। বাই দ্যা ওয়ে আমার প্রত্যেকটি সালোয়ার স্যুট এনার খুব মন কেড়েছে। ইন্ডিয়ান ড্রেসের রংগুলি বেশ লেগেছে তাঁর।
আরো এক মা-মেয়ে ছিল। তবে সারাটা ট্রিপ তারা মুখ খোলেনি। এমনকি পাশে বসে খাবার সময়েও নয়। কি জানি আমরা বুঝি গাঁইয়া ভূত তাই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি তার। মা'টি রূপের দেমাকে মটমটান। আর মেয়েটি নিজেকে প্রিন্সেস ডায়না মনে করে। মায়ের শনের মত ব্লন্ড হেয়ার চোখের সামনে যেভাবে পড়ে থাকে তাতে অর্ধ নিমীলিত চোখ দুটিকে আলো আঁধারিতে ডাইনি বলে ভ্রম হবে। আমি এদের নাম দিলাম ডাইনি ও ডায়না। এরা বুঝি সবচেয়ে বেশী পোষাক এনেছিল। আর কমপক্ষে দশজোড়া করে ম্যাচিং জুতো এনেছিল সঙ্গে। বিশ্বাস করো, আমি গুনেছি।
লাসভেগাস থেকে এসেছিল এক চাইনিজ যুবতী। সে "একল চলোরে" পন্থায় বিশ্বাসী। একগন্ডা ভাইবোনের মধ্যে মানুষ হয়ে নিজেই ঘুরে বেড়ায় এখন। এর নাম সত্যি ডায়না। এর আমার কাঁথাস্টীচের স্কার্ফগুলো খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে বলল, তুমি শাড়ি পরবেনা? শুনে ভালোই লাগল। ছিলেন এক coptic ক্রিশ্চান দম্পতি। তারা ইজিপ্টের লোক। থাকেন শিকাগোতে।প্রথমদিন বুড়ো ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, আর ইউ হিন্দু? আমি বললাম ইয়েস এন্ড প্রাউড টু বি হিন্দু। তার উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের অনেক হিন্দু বন্ধুবান্ধব আছে। হিন্দুদের আমি খুব পছন্দ করি। আমি বললাম, তোমার কি দেখে মনে হল আমি হিন্দু? তিনি বললেন তোমার চোখ। শুনে ভালো লাগল। বলেই বললেন, আই লাভ হিন্দু কালচার, হিন্দু এটিকেট এন্ড দ্যা ওয়ে অফ লিভিং। আমি বললাম, একটা বিন্দু দিয়ে গ্রাফ টেনোনা জেন্টলম্যান।
এই ভদ্রলোকের সত্তরোর্ধ্ব স্ত্রী এসেছেন। বেশ সুন্দরী আর সাজপোষাক বেশ পাল্টে পাল্টে করেন। এনার হাতে একটি প্যাচ দেখে জিগেস করায় বললেন উনি ব্রেষ্ট ক্যানসার এ আক্রান্ত। রেডিয়েশান চলছে ঐ প্যাচের মাধ্যমে। তার জুয়েলারী, জুতো আর পোষাক বদল দেখে মনে হল "ক্যানসার? তো কি? আই ডোন্ট কেয়ার।" যেন ডায়রিয়া হয়েছে কিম্বা জ্বর। বেড়াতে গিয়ে তা হলেও আমরা ভয় পেয়ে যাই। ২৪x৭ রেডিয়েশান নিয়েও ওনার বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। ফেসবুকে ছবি আপডেট করছেন, হোয়াটস্যাপে নাতিনাতনীর সঙ্গে কথা বলছেন, জুয়েলারী কিনে চলেছেন এখনো। এনাকে অহোরাত্র মনেমনে কুর্ণিশ জানিয়েছি আমি। মনে মনে বলেছি, এমনি থেকো মিসেস গুরগুইশ। টেক কেয়ার। ভালো থেকো!

Thursday, May 26, 2016

বোহেমিয়ান ডায়েরী পর্ব-৬


ক্র্যাকুফে দুরাত






 মাদের বোহেমিয়ান সফরের ষষ্ঠতম দিনে ওয়ার'স থেকে ক্র্যাকুফ ( Krakow, কিন্তু উচ্চারণ একেবারেই ক্র্যাকাও নয়) ।  যথারীতি হোটেলের ঘরে ইন্টারকমে পোলিশভাষায় সুন্দরী মেয়ে বলে উঠল" dzien-do-bry" যার অর্থ হল ওয়েক আপ বা সুপ্রভাত যাই বলো । চোখ রগড়িয়ে দেখি সাড়ে পাঁচটা বাজে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিয়ে হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্টের দিকে যাই। আবারো সেই ইউরোপিয়ান ব্রেকফাস্ট ব্যুফে। ফলের রস, দুধ সিরিয়াল, ফলের কুচি, টক দৈ, ডিম, সসেজ, হ্যাম, বেকন এর সাথে নানাবিধ পাঁউরুটির পসরা। এর মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু সদ্য আভেন থেকে বেরিয়ে আসা ট্রে ভর্তি ক্রোয়েসেন্ট। ক্রেসেন্ট মুন বা বাঁকা চাঁদের আদলে তৈরী পাঁউরুটির এই শিল্পটি ইউরোপের অন্যতম বেকারী প্রডাক্ট।  আমার এইসব মাংসে আপত্তি। তাই বাকী সব দিব্যি চলল।  এবার কফিতে চুমুক দিয়েই দে ছুট। মালপত্র বাসে উঠে গেল। আবারো সাতচল্লিশজন। আবারো একসাথে দিনরাত্তিরের সংসার তাদের সাথে। বাসের সিট বদলিয়ে নেওয়া। অদলবদলে প্রাণের শান্তি, মনের আরাম।   কে সামনে, কে পেছনে নিয়ে ঝগড়া নেই। সেদিন ওয়ার'স থেকে প্রথম হল্ট হবে চেষ্টচোয়া (Czestochowa) । সেখানে এক জাগ্রত পোলিশ মনাস্ট্রিতে অতি জাগ্রত দেবী ব্ল্যাক ম্যাডোনা কে প্রণাম জানিয়ে পথ চলা। জায়গার নাম জাস্না গোরা ( Jasna Gora) চতুর্দশ শতাব্দীর অন্যতম তীর্থস্থান। পলের মুখে ব্ল্যাক ম্যাডোনার গল্প শুনতে শুনতে পথ চলা। 




পোলিশরা এই  ব্ল্যাক ম্যাডোনাকে আমাদের কালীর মত মানে।  ওরা বলে  Our lady of Czestochowa । এ দেবী নাকি অসাধ্য সাধন করেন। খুব জাগ্রত এখানে।  ব্ল্যাক ম্যাডোনা দেবীর এই পোলিশ অধিষ্ঠান জাসনা গোরা মনাষ্ট্রি হল পোল্যান্ডের অন্যতম ঐতিহাসিক মনুমেন্ট।  এখানে কুমারী মেরীর কোলে যীশু। কিন্তু এর সর্বাঙ্গ কালো। অর্থাত ইনি আমাদের কালীর মত কৃষ্ণকলি।   




গল্প শুনেই নেমে পড়ি জাসনা গোরা মনাস্ট্রিতে। অসাধারণ সুন্দর স্থাপত্য সেই চার্চের। প্রবেশ করি অন্দরমহলে। সেদিন শনিবার। কোনো মাস চলছিল। একপাল স্কুলপড়ুযা ব্যাসিলিকার ভেতরে সুসংবদ্ধ লাইনে প্রবেশ করছিল। তাদের সামনে ও পেছনে একজন করে সিষ্টার ছিলেন। আমরা ইশারায় সেই লাইনে ঢুকে পড়লাম। সিষ্টারের অনুমতি নিয়ে। তারপর ছবি তুলতে তুলতে সোজা পৌঁছে গেলাম ব্ল্যাক ম্যাডোনার প্রতিকৃতির সামনে। তারপর দিব্যি পুরোটা ঘুরে ফেললাম ঐ খুদে স্কুল পড়ুয়াদের পেছন পেছন। আমাদের মন্দিরের ছবি তোলার কোনো বিধিনিষেধ নেই এসব জায়গায়।   



পোলিশ কিংবদন্তী বলে বহুযুগ আগে পোল্যান্ডে ওয়ায়েল পাহাড়ের নীচে এক ভয়ানক ড্রাগন বাস করত। ক্র্যাকুফ স্শহরের কেউ তাকে মারতে পারছিলনা। সারা স্শহরের লোকজন সেই ড্রাগনের ভয়ে থরহরিকম্প।  লোকজন প্রায়শঃই তার তর্জন গর্জন শুনত । একদিন রাজা ক্রাক ঠিক শহরবাসীকে ধেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করলেন  

"He who once and for all puts this dragon
Shall recieve my sceptre and my royal crown,
So come and defeat this most horrid beast

And win my daughters hand and a wedding feasts"

বহু দূর দূর থেকে রাজপুত্রেরা, সাহসী যোদ্ধারা সব পোল্যান্ডে এসে সেই ড্রাগনকে হত্যা করে রাজা ক্র্যাকের কন্যার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতে চ্চাইল। সারা শহর তীরধনুকে ছয়লাপ হল কিন্তু কেউ ড্রাগনকে মারতে পারলনা। অবশেষে একজন অল্পবয়সী মুচি সেই স্শহরে এসে জানাল সে ঐ ড্রাগনকে হত্যা করতে সক্ষম। তার যুদ্ধের কোনো স্সাজসরঞ্জাম ছিলনা। কেবল ছিল প্রখর বুদ্ধি, ছুঁচ ও সূতো। সে রাজপুরীতে প্রবেশ করেই রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইল।  রাজা ক্রাক তো হতবাক! ঐটুকুনি এক বালক মুচি কিনা ঐ বিশাল ড্রাগনকে মারবে? ছেলেটি বলল, আমার চাই ভেড়ার চামড়া, একটু গন্ধক আর একটু সর্ষেদানা। রাজা বলল, বেশ তাই হবে। স্থানীয় মানুষেরা জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল সেই ড্রাগন নিধন যজ্ঞ। সেই বিস্ময়কর মুচিবালকটি সেই ভেড়ার চামড়ার মধ্যে গন্ধক পাউডার আর সর্ষে ভর্তি করে সেটিকে কায়দা করে সেলাই করে দিল ছুঁচ-সুতো দিয়ে। ভোরবেলায় সূর্যোদয় হতেই সে ঐ গন্ধক আর সর্ষে ভর্তি বস্তা নিয়ে ড্রাগনের কাছে যাবার আয়োজন করল।  ড্রাগন জেগেই ছিল। সে খিদের তাড়নায় পাহাড়ের নীচে কিছুদূর এগুতেই একটা দেখল একটি ভেড়ার মৃতদেহ। সে সেই চামড়া বন্দী গন্ধক সব খেয়ে ফেলল। খেয়ে ফেলা মাত্র‌ই ড্রাগনের পেট ফেটে মৃত্যু হল।  রাজ্যের সব লোক তখন সেই ড্রাগন দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করল পাহাড়ের নীচে ভিসটুলা নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। সালফারে বিস্ফোরণ হয়ে ড্রাগনের আগুণ নেভাতে নদীর  জল প্রায় শেষ।  


এই রোমাঞ্চকর পোলিশ কিংবদন্তী শুনতে শুনতেই পথে পড়ল ভিশটুলা নদী। বাস থেকে ক্লিক ক্লিক। আবারো চলা।  
ড্রাগনের গল্প শুনে এবার নেমে পড়া ক্র্যাকুফ মেইন টাউন স্কোয়ারে।  একর্ডিয়ানের সুর বাজছে কোথাও। কোথাও  করুণ সুরে ভায়োলিন। পুরণো শহরের অলিগলি হাঁটতে গিয়ে কেবলি মনে পড়ে নিজের শহরটাকে। কোথাও আবারো টুংটাং ঘোড়ারগাড়ির আওয়াজ।  কি রাজকীয় তাদের সাজপোষাক!  


মনে হয় আরো কি করে সুন্দর হয় সে! ক্র্যাকুফেও ট্রাম চলে অনবরত।



পথের ধারে ঘন্টি বাজিয়ে সেখানেও অনবরত ট্রাম চলে যায় নিঃশব্দে। কত দূষণ কম তাই। মানুষ ট্রামকে ব্যবহার করেও। ব্যস্ত রাস্তায় অনামা চিত্রশিল্পীর সুন্দর চিত্র প্রদর্শনীও হয়। 




মনে মনে ভাবি সেদিক থেকেও আমরা পিছিয়ে নেইকো মোটেও। রাস্তার মোড়ে মোবাইল পোষ্ট-অফিস ভ্যান। 


হলুদ পিটুনিয়া শীতের শেষ রেশটুকুনি মেখে তখনো এক এভিনিউ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে।  


পথের ধারে রেস্তোঁরায় আবার সামান্য দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নি। রেস্তোঁরায় টয়লেট সারতে গিয়ে দেখি প্রকান্ড কাঠকয়লার আঁচে মাংস ঝলসানোর পর্ব চলছে অহোরাত্র।  





শিল্প আর শিল্পীর সমাবেশকে আমার শহরও পাত্তা দেয় যথেষ্ট। আর গান-তাল-বাদ্য সেদিক থেকেও পিছিয়ে নেই সে। তাহলে অসুবিধে কোথায়? মানে কলকাতার রাস্তায় পোল্যান্ডকে নামিয়ে আনতে?  
দূরে বসে কলকাতাকে বলে উঠি..."dzien-do-bry"     

জাগো সুন্দরী! ভোর হয়েছে, দ্যাখো....

Sunday, May 22, 2016

বোহেমিয়ান ডায়েরী (পর্ব ৫)

পোল্যান্ডে দ্বিতীয় দিনে ওয়ার'স  ( Warsow) 


পিয়ানিষ্ট Chopin  এর স্মৃতি বিজড়িত পার্কে 


পোলিশ ভাষায়  Warszawa বলে।  পোল্যন্ডের বর্তমান রাজধানী। অন্যতম বৃহত শহর।  বার্লিন থেকে পজনান হয়ে ওয়ার'স যাবার পথে ঘন সবুজ জঙ্গল চলল আমাদের সাথে।  পথে পড়ল ওডার ( Oder )নদী। পোলিশ ভাষায় Odra. চেক রিপাবলিক থেকে উত্পন্ন হয়ে এই নদী  পোল্যান্ড ও জার্মাণীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।  

যথারীতি বাস থামল কিছু পরেই।  টয়লেট সেরে নিয়ে বাসে ওঠার মুখে চোখে পড়ল টিউবওয়েল। এই ওয়ার'স পোলিশ ফ্লিন্ট, জুয়েলারী, এম্বার, পটারী উত্পাদনে বিখ্যাত।  আবার সেই সকালে মন ভারি হয়ে গেল ওয়ার'স ঘেট্টো (ghetto) এল। ট্যুর ম্যানেজার পলের মুখে বিভীষিকাময় ওয়ার'স বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে হাজির হলাম ওল্ড টাউনে।  


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ( ১৯৩৯, থার্ড সেপ্টেম্বর) হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করল এবং রাশিয়ার সাথে একটি গুপ্ত চুক্তি থাকার ফলে রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে  পোল্যান্ডকে দুভাগে ভাগ করে পশ্চিমদিকটা জার্মাণি দখল করেছিল আর পূর্বদিকটা দখল করেছিল রাশিয়া। একমাস ভয়ানক যুদ্ধের পর ওয়ার'স ধ্বংস হলে পোল্যান্ড আত্মসমর্পণ করল।      হিটলারের মতে স্লাভিক জাতি অর্থাত রাশিয়ান, পোলিশ...এরা মানুষের মধ্যে পড়েনা এবং জু (jew) বা ইহুদীরাও এদের দলে। অতএব দেশ খালি করে জু এবং পোলিশদের যেনতেনপ্রকারেণ হত্যা করে সেখানে জার্মাণ জাতির বসতি কায়েম করার উদ্দেশ্যে বর্তী হল নাতসী পার্টির নেতা হিটলার।   অনেকগুলি কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প তৈরী হল যেখানে সবল পুরুষ নাগরিকদের রাখা হত ক্রীতদাসের মত যেখানে তারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করত। আর দুর্বল, নাবালক ও মহিলাদের মেরে ফেলা হত। ওয়ার'স তে বহু ইহুদীদের একত্র জড়ো করা হয়েছিল এই কারণে। সেই জায়গার নাম হল ঘেট্টো। এই অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ওয়ার'স তে দুবার সামরিক উত্থান করার চেষ্টা হয়েছিল। একবার ইহুদীরা সেই চেষ্টা করে। আরেকবার পোলিশ হোম আর্মিরা এই চেষ্টা করে। কিন্তু জোশেফ স্ত্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়া নিষ্ক্রিয়তার সাহায্য নিয়ে হিটলারের নাত্সীরা এই দুই উত্থানকে নির্মমভাবে অবদমিত করে এবং ওয়ার'স ঘেট্টোর প্রতিটি বাড়ি ধ্বংস করে ও প্রত্যেক মানুষকে খুন করে ওয়ার'স তে শ্মাশানের শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে অঅসে। ওয়ার'স সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু পরবর্তীকালে সেই ওল্ড টাউনকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পুণরায় নির্মাণ করা হয়(  Reconstruction)  এবং এই পুনঃনির্মাণ এত‌ই নিখুঁত যে ওল্ড টাউনকে  UNESCO হেরিটেজ সাইট রূপে ঘোষিত করা হয়েছে।  
ইউরোপে ওয়ার'স এর নাম করলেই যার কথা সর্বাগ্রে মনে পড়ে তিনি হলেন বিখ্যাত পিয়ানিষ্ট শপিন ( Chopin) বিশাল সবুজ এক প্রাঙ্গণের মধ্যিখানে রাখা এই শিল্পীর স্থাপত্য। তিনি যেন বাতাস থেকে সুর হাতড়ে তাকে ছন্দে আরোপিত করেছিলেন হাতের যাদুতে। কি চমত্কার শপিনের অবয়বটি। হাঁটতে হাঁটতে হাজির হ‌ই পুনঃনির্মিত ওয়ার'স এর টাউন স্কোয়ারে। থরেথরে সাজানো পথ রেস্তোঁরা। ঢুকে পড়ি একটি তেমনি ছাতার নীচে।  সুন্দরী পোলিশ মেয়ে হাসিমুখে আতিথেয়তা জানায়। ইউরোপে জল বুঝি কেউ খায়না। আবারো গলা ভেজাই স্থানীয় পোলিশ বিয়ার Perla তে। ঠান্ডায় ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে বেশ ছুটির আমেজ অনুভূত হয় দুপুরবেলায়। হরেক কিসিমের চিজ দিয়ে বোঝাই মস্ত এক চিজ প্ল্যাটারে কামড় দি আমরা। কিছুপরেই একফালি গ্রিলড চিকেন আসে। মাছভাতের তৃপ্তি হয়ত নেই কিন্তু অন্য আরো কিছু আছে যা মনে ধরে রাখার মত। ওয়ার'স পুরোণো শহরে আর রয়েছে সেন্ট জন'স ক্যাথিড্রাল, রয়্যাল প্যালেস। আর পোলিশ কিং জ্যান সোবেইস্কির বাসস্থান উইলানোউ প্যালেসটিও দেখবার মত।  

খাবার খেতে খেতে পিয়ানো একর্ডিয়ানে রাজকাপুরের মেরা নাম জোকারের  সুর ভেসে আসল কানে।  শুধু এখানেই নয় অনেক জায়গায় রাস্তার ধারে অনামা আর্টিষ্টের একর্ডিয়ানে  এই সুর আমাকে আপাততঃ তাড়িয়ে নিয়ে চলল ওয়ার'স এর অলিগলিতে। আর দেখলাম ঘোড়ারগাড়ি।    




Saturday, May 21, 2016

বোহেমিয়ান ডায়েরী- পর্ব(৪)


পোল্যান্ডে প্রবেশ
শহরের নাম পজনান (Poznan)











বার্লিন থেকে পোল্যান্ড পৌঁছতে প্রায় চারঘন্টা লেগে গেল। বাসের সহযাত্রীদের সঙ্গে এরই মধ্যে বেশ আলাপ জমে উঠেছে।  ৪৭ জনের মধ্যে আমরা ছাড়া কুয়েতবাসী এক কেরালাইট দম্পতি আছেন। বেশ হাসিখুশি মহিলাটি, আমার সমবয়সী। হালকা হাসি, ঠাট্টা মশকরা, একসাথে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে টয়লেটে থামা কিম্বা কফি খেতে খেতে ভারত-গল্পে মশগুল হওয়া...ভালোই লাগে বিদেশ বিভুঁইয়ে। তবে যেইমাত্র শুনলাম কলকাতার নামে তার নাক বেঁকানো আর কলকাতাকে দরিদ্রসীমার নীচে বলে ছোট করা তখন‌ই মনে মনে বলি আর নয় বাপু, এবার দূরে দূরে চল...যাইহোক আমার কলকাতা, তিলোত্তমা, কল্লোলিনী...তার অনেক রূপ এক অঙ্গে।  তাকে বলেই ফেলি, তুমি কলকাতা গিয়েছ কখনো? লিভিট নামের ঐ কেরালাইট মহিলা বলল, না, কিন্তু খুব সস্তা শুনেছি। আমি বললাম তুমি আগে যা শুনেছ, সেই কলকাতা এখন আর নেই। তারপরেই মনেমনে বলি, সত্যি কি তাই? আমাদের কলকাতা কি সত্যি বদলেছে?   



যাইহোক পোল্যান্ডে পা রেখেই মনে হল কি সুন্দর, শান্ত, রুচিশীল একটা দেশ। সেখানেও ট্রাম। এবার কারেন্সি বদল। Euro ভাঙিয়ে  Zloty । আর পলিশ লোকজনের কি সুন্দর সাজপোষাক তাদের মানানস‌ই গায়ের রং আর টিকোলো নাক-ঠোঁটের সাথে  । মনে আমি বললাম এত রূপসর্বস্বতায় আর কি আসে যায়! শুনেই রাহুল বলল, মা ওয়ার্ল্ডস বেষ্ট সফটওয়ার প্রোগ্র্যামার আর ফ্রম পোল্যান্ড। বললাম, তাহলে এরা রূপে কার্তিক, গুণে গণেশ ...কি বল? ছেলে বলল, অন্ততঃ আমাদের ইউএস ইউনিভার্সিটিতে তো তাই দেখি।  



 পজনান পোল্যান্ডের পুরোণো রাজধানী শহর। বাস আমাদের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে নামিয়ে দিল শহর ঘুরে দেখবার জন্য।    লক্ষ্য করলাম প্রাচীন পোল্যান্ডের গথিক স্থাপত্য। সেদিন টাউন স্কোয়ারে একপাল স্কুলের খুদেরা এসেছে। সেখানে চার্চের মাথায় এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটে প্রতিদিন দুপুর বারোটায়। কিছুটা কিংবদন্তীর ভেলায় ভেসে চললাম আমরাও।  
এই পজ্নান শহরের ওল্ড টাউন হলের শেফ হরিণের মাংস রান্না করছিল। আগুণের আঁচে সেই হরিণের মাংস এতটাই বেশী পুড়ে গেল যে শেফ তখন তাড়াতাড়ি পাশের একটি মাঠ থেকে দুটো চরে খাওয়া ছাগল ধরে এনে পোড়াতে গেল। হরিণের মাংসের বদলে ছাগলের মাংস‌ই রান্না হবে সেদিন। কিন্তু ছাগলদুটি বুঝতে পেরেই রান্নাঘর থেকে পালিয়ে ওল্ড টাউন হলের চার্চের মাথায় উঠে গেল। এবার স্এই থেকে স্থানীয় মানুষের মনে এক অদ্ভূত বিশ্বাস দানা বাঁধে। চার্চের ঘড়িতে ঠিক দুপুর বরোটায় ঘন্টাধ্বনি হয় আর দুটি যান্ত্রিক ছাগল বেলের মাথা থেকে একটি জানলা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়াবে। আবার কিছুপরেই ভেতরে প্রবেশ করবে। ছোটছোট স্কুলপড়ুয়ারা এই দৃশ্য দেখবে বলে সেখানে বসে থাকে আবার দেখেই লাইন করে টিচারের সাথে চলে যায়। টাউন স্কোয়ারে সবকিছু গোটের আইকন। আর পজনান কে বলা হয়  The city of headbutting goats!

Wednesday, May 18, 2016

বোহেমিয়ান ডায়েরী- পর্ব( ৩)

বাই বাই বার্লিন !

বার ভোরের আলো, ঠান্ডা হাওয়া আর এক আধপশলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসে ওঠা। বার্লিনে আজ আমাদের সারাটা দিন, সারাটা রাত কাটানোর পালা।  গতকাল সন্ধ্যেবেলায় ব্রান্ডেনবার্গ গেটের ভাল ছবি নেওয়া হয়নি বলে একটু খুঁতখুতুনি ছিল। অগত্যা সেখানেই প্রথম যাওয়া। ইষ্ট বার্লিনের রাস্তায় হরেক কিসিমের ট্রাম দেখলাম বাপু। যেমন ঝাঁ চকচকে ট্রামের সাজুগুজু তেমনি নেটওয়ার্ক। ক্রিশক্রশ ভাবে সারা শহর যেন ট্রামময়। কেবলি মনে হচ্ছিল বাস থেকে নেমে ট্রামে উঠে পড়ি। আর আমাদের কলকাতার ট্রামগুলোর কথা ভাবলেই লজ্জা হচ্ছিল।



আমরা কিনা কতগুলো রাস্তার ট্রাম তুলেই দিলাম! সারেসারে লিন্ডন গাছের কচি সবুজ পাতায় তখন সোনা গলানো ভোরের রোদ।   টাউন হলের মাথায় পতপত করে ওদেশের পতাকা উড়ছে। তারপর একে একে জন চেনাতে লাগল বার্লিন ডোম, কাগজের পাতায় পড়া সেই এডলন হোটেল । এই এডলন হোটেলের উঁচু, খোলা জানলা দিয়ে মাইকেল জ্যাকসন  তার সন্তানকে ঝুলিয়ে মজা দেখাতে গিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিল।  



















এবার নদীর ধারে যাওয়া। ঠান্ডা হাওয়ায় আরো তীক্ষ্ণ ধার অনুভূত হল। নদীর নাম স্প্রে( Spree) । নদী বেশ ছোট‌ই কারণ আমাদের চোখ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দেখে অভ্যস্ত। তবে সুনিপুণভাবেই লঞ্চ চলছে নদীর বুকে। ওপরে ব্রিজ। বেশ ফোটো নেবার আদর্শ ভারতীয়ের ক্যামেরায়। নদীর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই  জন বলল, "look at the Berlin Wall ! "এই সেই ইতিহাস খ্যাত বার্লিনের প্রাচীর? মন ভারি হবার আগেই জন বলল, এদিকটা হল "the most funny part of the wall" বললাম, এতে আবার মজা কোথায় দেখল সে? রাহুল বলল, ঐ দ্যাখো মা দেওয়ালের গায়ে কি অদ্ভূত পেন্টিং এখনো রয়েছে। বার্লিন ওয়াল যখন ভেঙে ফেলা হল তখন প্রায় ১০০ জন চিত্রশিল্পী প্রতিবাদে সরব হয়ে বলেছিল, রাখা হোক দেওয়ালটা। আমরা না হয় সুন্দর করে এঁকে সাজিয়ে রাখব আমাদের শিল্পকর্ম। ঐটুকুনি দেওয়াল  সবচেয়ে লম্বা যা এখনো বেঁচেবর্তে আছে। নদীর জলে হালকা ঢেউ তুলে নৌকো যাচ্ছে। নদীর ধারে পিয়ানো একর্ডিয়ানে হালকা সুর বাজাচ্ছে কেউ।  
এতজন চিত্রশিল্পীর দেওয়াল চিত্র সম্বলিত এই স্থানকে বলা হয় ইষ্টসাইড গ্যালারী।  এরপর গেলাম বার্লিন প্রাচীরের আরেকটা দিক দেখতে। 





বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ছাড়াও জার্মাণী ও বার্লিনের একটি দ্বিতীয় অস্তিত্ত্ব আছে। তা হল আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার অর্থাত ক্যাপিটালিজম ও কমিউনিজম এবং পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের  slavic এর রণভূমি  হয়ে ওঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রতে সারাবিশ্ব ভরে উঠেছিল তখন এই দুই রাষ্ট্রের কূটনৈতিকেরা এক নতুন পন্থা অবলম্বন করল যার নাম কোল্ড ওয়ার। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে গুপ্তচর এবং দেশদ্রোহীর সাহায্যে  একে অপরের ক্ষতিসাধন করার দুষ্টু অভিসন্ধির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল এই বার্লিন।মিত্রপক্ষের তিন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যৌথভাবে পশ্চিম জার্মাণী দখল করেছিল এলব নদী অবধি ও রাশিয়া  পূর্ব জার্মাণী দখল করল।  বার্লিন যদিও পূর্ব জার্মাণীতে তবুও সেই শহর‌ও দ্বিধাবিভক্ত, ইষ্ট ও ওয়েষ্ট বার্লিন।  পূর্ব বার্লিন রাশিয়া অধিকৃত কমিউনিষ্ট ও ডিক্টেটরশিপের পীঠস্থান আর পশ্চিম জার্মাণী ছিল গণতান্ত্রিক, লিবরাল। সাধারণ জার্মাণরা পূর্বজার্মাণী থেকে পশ্চিমে পালাতে শুরু করল।   গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য। এটিকে বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই ১৯৬১ সালে তৈরী হল শহরের বুক চিরে, পশ্চিম বার্লিনকে ঘিরে ঐতিহাসিক এই বার্লিন ওয়াল। সেই পাঁচিল টপকাতে গিয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হল।  
অবশেষে ১৯৯০ সালে জনরোষের মুখে পড়ে সেই বার্লিন ওয়াল ভেঙে দেওয়া হল। ও তার সাথে ভেঙে পড়ল পূর্ব জার্মাণীর কমিউনিষ্ট স্বৈরতন্ত্র। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মাণীর এই মিলনে জার্মাণী এখন উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। স্প্রি নদী পেরিয়ে একবার একূলে যাই তো আরেকবার ওকূলে গিয়ে দাঁড়াই। আক্ষরিক অর্থে এই নদীও যেন উভয় জার্মাণীর সীমারেখায়  প্রবহমান। একদিকে ব্রিটিশ এমব্যাসি, মিউজিয়ামে ছয়লাপ । ঠিক দুপুর বারোটায় বেজে উঠল চার্চের ঘন্টা। দূরে চোখ রাখি আকাশছোঁয়া বার্লিন ডোমে ও জার্মাণ হিষ্ট্রি মিউজিয়ামে। ওয়ার মেমোরিয়ালে চোখ রাখলেই ভারি হয়ে ওঠে চোখের পাতা। তারপরেই আইনস্টাইন ও কার্লমার্ক্সের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামবোল্ট ইউনিভার্সিটি নজর কেড়ে নেয়। দুপুরে একটু বিশ্রাম নেওয়া রাস্তার ধারে কফিশপে। আবার একটু চাঙ্গা হয়ে দেখতে যাওয়া ঐতিহাসিক বুক-বার্নিং স্কোয়ার। ১৯৩০ সালে ঠিক এই জায়গায় ২০০০০ ব‌ই পুড়িয়েছিল । এক জার্মাণ লেখক এই ঘটনার ১০০ বছর আগে নাকি নাত্‌জী বাহিনীর এই নারকীয় কর্মকান্ডের ভবিষ্যদ্বাণী  করেছিলেন  । তিনি বলেছিলেন যারা ব‌ই পোড়ায়, তারা একসময় মানুষ ও পোড়াবে।  এই উক্তি অক্ষরে অক্ষরে  মিলে গেল যখন হিটলার তার বীভত্স কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে কাতারে কাতারে মানুষকে মারল।