Wednesday, October 22, 2014

কালীপুজোয় আকালীপুর

জানো কি মহারাজা নন্দকুমারের গুহ্যকালীর গল্প? কালীপুজোয় ঘুরে এসো তবে আকালীপুর।

                                            কালীপুজোয় আকালীপুর

বাতাসে অল্প হিমেল গন্ধ আর সাথে শিউলির শেষ রেশটুকুনি নিয়ে শহর ছেড়ে রাঙামাটির পথে পাড়ি দিয়ে ঘুরে আসা যেতেই পারে কালীপুজোর ছুটিতে আকালীপুর ভদ্রপুর । নলহাটি বহরমপুর সড়কপথে বাসে করে গেলে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের ওপর নগোরার মোড় । সেখান থেকে আকালীপুর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার । আজিমগঞ্জ-নলহাটী শাখায় রেল স্টেশন লোহাপুর থেকে আকালীপুর মাত্র ছ'কিলোমিটার দূরে । কোলকাতার কাছেই এই মন্দিরের খোঁজ অনেকেরই হয়ত বা অজানা ।
কথায় বলে " কীর্তযস্য স জীবতি " ! মহারাজা নন্দকুমারের কীর্তিসমূহ হেস্টিংস বিলোপ করতে চেয়েও পারেন নি । তাঁর অজস্র কীর্তির মধ্যে অন্যতম হল বীরভূমের আকালীপুরে উত্তরবাহিনী ব্রহ্মাণী নদীতীরে গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা ।


নন্দকুমার যখন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তখন ঐ গ্রামে জনাকয়েক মানুষের বাস ছিল তার মধ্যে কিছু ভট্টাচার্য বামুন ছিল । নদীতীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ । কথিত আছে এই গুহ্যকালী মহাভারতে বর্ণিত মগধরাজ জরাসন্ধের আরাধ্যা দেবী । কালস্রোতে ইনি কাশীরাজ চৈতসিংহের গৃহে পূজিতা হন । রাজা চৈতসিং তাঁর রাহ্যে এক ইঁদারা খননের সময় এই কালীর হদিশ পান । অস্থায়ী মন্দির নির্মিত হয়ে পুজো শুরু হয় । হেষ্টিংস সে সময় এই অপূর্ব গুহ্যকালীর শিল্পশৈলীর কথা জানতে পেয়ে ইংল্যান্ডের এন্টিক বস্তুর সংগ্রহশালায় ঐ দামী কষ্টিপাথরের মূর্তি নিয়ে যাবার ফন্দী আঁটেন । চৈতসিং এইকথা জানতে পেরে গোপনে দেবীকে ব্রাহ্মণী নদীর জলে নিমজ্জিত করে রাখেন ।মহারাজ নন্দকুমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতারাতি এই দেবীমূর্তিকে জল থেকে উদ্ধার করে তাঁর জমিদারীর অন্তর্গত আকালীপুর ভদ্রপুরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে স্থাপন করেন । কেউ কেউ বলেন হেষ্টিংস নাকি নৌকাপথে ঐ মূর্তিকে পাচার করে দিছিলেন । নন্দকুমার গঙ্গাবক্ষেই দেবীকে উদ্ধার করেন এবং ওনার কলিকাতার বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে প্রথমে রাখেন এবং পরে মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন । ব্রহ্মাণী নদী ভাগিরথীর সাথে কাটোয়ায় মিলিত হয়েছে । নন্দকুমার চেয়েছিলেন এই নৌকাকে ভদ্রপুরে থামাতে কিন্তু নৌকাকে থামানো যায়নি । তাই আকালীপুরে যখন নৌকা এসে ভিড়েছিল তখন ঐ মূর্তিকে নামানো সম্ভব হয়েছিল । উত্তরবাহিনী ব্রাহ্মণী নদী কালের স্রোতে পূর্বমুখী হয়েছে । কে জানে দেবী স্বয়ং দুরাচার, অর্থপিশাচ হেষ্টিংসের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই হয়ত জঙ্গল পরিবেষ্টিত আকালীপুরকেই নিরাপদ স্থান বলে ভেবেছিলেন । অদূরে ব্রহ্মাণী নদীর কোলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুঠিরের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসের উপদান হয়ে থেকে গেছে ।

মন্দিরটি ছিল আটকোণা দুর্গের অণুকরণে নির্মিত । চুন-সুরকির গাঁথনির মধ্যে ছোট ছোট বাংলা ইঁট দিয়ে তৈরী । পাঁচিল পলাস্তরা বিহীন । দেওয়ালের খোপে দেবীর দশমহাবিদ্যার মূর্তির অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা । জনশ্রুতি আছে ভদ্রপুরের মহারাণী রাজপ্রাসাদ থেকে মন্দিরের চূড়ো দর্শন করতে চেয়েছিলেন । রাণীর ঐ দম্ভ দেবীর সহ্য হয় নি । তাই দৈব দুর্যোগে একরাতের মধ্যে নির্মিত ঐ মন্দিরের চূড়ো নষ্ট হয়ে যায় ও মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে ফাটল ধরে ।কারো মতে এই দেবীমূর্তি শ্মশানকালী বলে মন্দির প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকতে নারাজ । তাই নির্মাণকালেই এই মন্দিরটি বিদীর্ণ হয় এবং এখনো অসমাপ্ত ।
মন্দিরের গর্ভগৃহটিকে বেষ্টন করে পরিখার মত আবরণী । তিনটি দরজা । প্রধান দরজা দক্ষিণদিকে । ত্রিনয়না দেবী দক্ষিণমুখী । ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এমন কালীমূর্তির নিদর্শন নেই । অনেকটা নেপাল বা চীনের কালীমূর্তির মত গড়ন । কালো কষ্টিপাথরের একখন্ড টুকরো কেটে কোনো এক অনামা শিল্পী বানিয়ে ছিলেন । আয়তাকার কালো পাথরের বেদীতে দুটি কুন্ডলীকৃত সাপের ওপর অর্ধ পদ্মাসনে উপবিষ্টা দেবী । দেবীর ডান পা সাপের মাথা স্পর্শ করে আছে । দেবীর মস্তকে পাঁচটি ধাপে সহস্রাধার । অর্থাত হটযোগে যে মস্তকে যে সহস্রাধারের কথা বলা হয় এই সাপের মুকুট তারই প্রতীক । দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুন্ড দিয়ে তৈরী মালা । কর্ণ কুহর থেকে বুক অবধি নেমে এসেছে দুটি শিশুর মৃত শবদেহ । দেবীর সর্প উপবীত । নাভীকুন্ডের ওপর দিয়ে সাপের কোমর বেষ্টনী । দুহাতে সাপের বলয় । উন্মুক্ত লোলজিহ্বা, বিস্ফারিত ত্রিনয়ন আর মুখ গহ্বরে নাকি আসল নরদন্তের সারি । চক্ষু ও নাকি নর-করোটির অংশে নির্মিত । দুই হাতে বর এবং অভয় । একাধারে সৃষ্টি এবং লয়ের প্রতীকি এই দেবীর ভয়ানক রূপের মধ্যে আবার তাঁর প্রস্ন্ন রূপটিও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে । ব্রহ্মাণী নদীতীর সংলগ্ন শ্মশানঘাটটির পরিবেশও বেশ ছমছমে ।
দেবীর ভৈরব গৌরীশঙ্করের মূর্তিও আছে পাশেই । গুহ্যকালীর নিত্যপুজো হয় এখানে । দশপোয়া অতপচালের ভোগ দেওয়া হয় দুর্গাপূজার পর চতুর্দশীতে ভেড়া, ছাগল ও মোষ বলির ও প্রচলন আছে । মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজোতে মেলাও বসে এখানে ।তান্ত্রিকরা এই কালীকে বেদের বেটী বলে থাকেন । ২০০৪ সাল থেকে এই মন্দিরের উন্নয়নে জোর কদমে কাজকর্ম চলছে । ব্রহ্মাণীনদীর সবুজ অরণ্যময়তায়, তুঁতচাষের বাহুল্যে আর বাঁশবনের মর্মরতায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপুষ্ট এই আকালীপুর ভদ্রপুরের গুহ্যকালী বোলপুরের অন্যান্য সতীপিঠ অপেক্ষা কোনো অংশে কম নয় । আর মহারাজা নন্দকুমারের অপরিমিত সাহস ও দূরদৃষ্টির কথা বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই মন্দির । শক্তিসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে এই তীর্থভূমি পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটি তীর্থ সাধনার স্থানের মতই ।

শারদীয়া "স্মরণিকা" ২০১৪, প্রান্তিক, বোলপুর এ প্রকাশিত