Tuesday, October 30, 2012

গৃহনৌকা


 
-->
প্রতিবার পাহাড় না সাগর এই বিতর্কে হেরে যাই আমি । গরমের ছুটির ফাঁদে পা দিলেই হিমালয় টেনে নিয়ে যায় তার কাছে । এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না । 
 আমরা তিনজনে দিল্লী থেকে আবার শ্রীনগরের উড়ানে ।
প্রিন্সলি স্টেট কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শহর শ্রীনগরে এলাম ঘুরতে ঘুরতে । এসে অবধি জ্যৈষ্ঠ্যের  অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি আমাদের পথ ছাড়তে নারাজ । -->
ঝিলাম সেতু পেরিয়ে ডাল ঝিলে এলাম আমরা । একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ । লেক যে এত বড় হয় আগে কখনো দেখিনি ।শিলং এ বড়াপানি লেক দেখেছিলাম, সুইজারল্যান্ডের লুগানো লেক দেখেছিলাম । কিন্তু তাই বলে এত হৈ হৈ হাউসবোটের পসরা আর কূলে কূলে এত শিকারা
-->
দরদস্তুর করে শিকারার মাঝির আমন্ত্রণে চড়ে বসলাম শিকারায় । এমন কাশ্মীরি নৌকোর ছবি দেখেছি । চড়িনি আগে । পড়ন্ত রোদের আলোয় ডালঝিল রমরম করছে তখন । হাউসবোটের উঠোন ঘেঁষে শিকারা চলেছে মাঝির খেয়ালে । কখনো কাশ্মীরি পশমিনার দোকানের রোয়াকে কখনো আখরোট কাঠের ওয়ার্কশপে কখনো বা মীনাকারির গয়নার শিকারার বারান্দায় । সবাই মিলে বাসছি আমরা ডাললেকের জলে । শিকারার দাঁড় কাঠের পানের গড়নের । মাঝি কি অবলীলায় না সর্বক্ষণ সে দাঁড় বাইছে আপনমনে । আমাদের নৌকার সমান্তরালে এগিয়ে এল উলের পোষাক, পাথরের গয়নার মোবাইল দোকানি । এল শুকনোফল আর কেশর । এগিয়ে এল ফোটোগ্রাফারও রাজারাজড়ার পোশাক-গয়না হাতে । একটু অনুরোধ বৈ আর কিছুই নয় । এইভাবে সেই প্রদোষে ঘন্টা দেড়েক শিকারা ভ্রমণ। মাঝে দু একটা পিটস্টপ । নেহরুগার্ডেনে অবতরণ গোলাপের বাগানে । একটু ছবি তোলা । আবার ভাসমান শিকারায় । আশপাশে ভাসমান সবজী বাগানের মধ্যে দিয়ে লিলিপুলের মধ্যে দিয়ে ।, হাউসবোটের রোয়াক ঘেঁষে । কাশ্মীরি শাল আলোয়ানের দোকানের পাশ দিয়ে একটু আধটু ছোঁক ছোঁকানি , কি কিনি কি কিনি এই ভাব নিয়ে ।
 
  আপাতত  আমরা ত্রয়ী সুবিস্তৃত ডাল-ঝিলের মধ্যে  ভাসমান এক বিলাস বহুল গৃহনৌকার মধ্যে ।  পথে দেখেছি ঝিলামের রূপ । সোনামার্গ যাওয়ার পথে সিন্ধুদর্শনও হয়েছে ।  পহেলগামে লিডার নদীকেও ছুঁয়ে এসেছি । তবে ডাল লেকের বিশালতা দেখে মনে পড়ে গেল ১৯৮৯তে স্যুইটজারল্যান্ডের লুসার্ন আর লুগানো লেকের কথা । সেখানে সুইস আল্পসের কোল জুড়ে লেকগুলি আর ভারতীয় এই ভূস্বর্গে হিমালয়ের কোল আলো করে এই ডাললেক । শিকারায় করে যে হাউসবোটটিতে আমরা বন্দী হলাম দুদিন-দুরাতের জন্য তার নাম ক্যালিফোর্নিয়া । রূপকথার গল্পে পড়া পঙ্খের কাজ করা পিঙ্ক হাউসবোট । পুরো জাহাজ বাড়িটি দেওদার বা সেডার কাঠের তৈরী । জলে ডুবে আছে বছরের পর বছর । পচ ধরেনা এই কাঠে ।যেন ছোট্ট রাজবাড়িতে ঢুকলাম । প্রবেশ দ্বার থেকে কাশ্মিরী কার্পেটে মোড়া  । প্রশস্ত বারান্দায় বসার সোফা পাতা । প্রবেশ পথ পেরিয়ে ড্রয়িংরুম বা টিভি লাউঞ্জ । দেওয়ালে কাঠের কাজ ছাদে কাঠের কারুকার্য আর চারিদিকে আখরোট কাঠের ছড়ানো ছেটানো আসবাব । এমন কি ছাদের মধ্যিখান থেকে ঝুলন্ত ঝাড়লন্ঠন ! জানলা ও দরজায় কাশ্মীরি কাজের পর্দা । এবার ডাইনিং রুম । কাঁচের বাসন সম্বলিত আলমারী, বিশাল ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার্, ডিনার ওয়াগান । ঠিক জাহাজ বা ট্রেনের মত লবি পেরিয়ে বেডরুমে এসে বিছিয়ে দিলাম নিজেকে । আবার সেই আখরোট কাঠের পালঙ্ক, চেষ্ট অফ ড্রয়ারস্, টেবিল... ড্রেসিং রুম, ওয়াড্রোব আর সংলগ্ন বাথরুম ।    কোনো অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই । দেওয়ালে কাশ্মিরী কাজের ওয়াল হ্যাংগিং থেকে কাঠের সূক্ষ কাজের পেলমেট ও বাহারী ল্যাম্পশেড ।
রাতের আহার সেরে হাউসবোটের ডেকে এসে ঘুমন্ত ডালঝিলকে একঝলক দেখে ঝিম ধরে গেল মাথায় । নেশাগ্রস্তের মত একদৃষ্টে চেয়ে র‌ইলাম তার দিকে । ফুটফুটে লাল নীল সবুজ আলো জ্বলছে আশপাশের হাউসবোট থেকে আর তাদের প্রতিবিম্ব ডালঝিলের জলে দুলে বেড়াচ্ছে জলপরীদের মত, রাতপরীদের মত ।  
ঘুমিয়ে পড়লাম দেবী চৌধুরাণির বজরায় । স্বপ্নে মনে পড়ে গেল চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার কথা । এমনটিই ছিল হয়ত সে সময় ।  মাঝরাতে বৃষ্টি ঝরল হাউসবোটের ছাদে । কাঠের ছাদে  টুপটাপ বৃষ্টিকণার শব্দ কানে লেগে র‌ইল । 
এবার পহেলগামে দুদিন । অবন্তীপুরম, কেশর ক্ষেত,  উইলো কাঠের ব্যাট,  শুকনো ফলের পসরা ফেলে এবার পহেলগামের দিকে । রাস্তা দুদিকে চলে গেছে । একদিকে জম্বু যাওয়ার রাস্তা  অন্যদিকে পহেলগামের পথ । ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর পথ ছাড়েনা ।
ঘোড়ায় চেপে বৈশরণ এডভেঞ্চার । তিনটে জবরদোস্ত ঘোড়া , দুই সহিস আর আমরা তিন মূর্তি । ঘন বাদামী আট বছরের বুলডোজার্, হালকা বাদামী দশ বছরের চেতক আর আমার সফেদ ঘোড়া মাত্র তিন বছরের বাদল । 

বুলডোজার জ্ঞানী বৃদ্ধ, সাবধানী এবং ভব্য সভ্য । বাদল খুব চালাক এবং দুষ্টুমিষ্টি স্বভাবের । আর চেতক হল সবচেয়ে পাজি এবং ওপরচালাক । ঘোড়ায় চেপে তো বসলাম তিনজনে ভয়েভয়ে  দুই সহিস পায়ে হেঁটে আমাদের পেছন পেছনে চলল । অসমতল পাহাড়ি পথ । খানাখন্দে ভরা তায় আবার বৃষ্টি পড়ে কর্দমাক্ত । চেতক শুধু ওভারটেক করায় ব্যস্ত শুরুথেকেই । বাদল ও বুলডোজার না এগিয়ে যায় ওর থেকে । চড়াই পথে আমাদের লাগাম ধরে আমাদের নীচু হয়ে যাওয়া আর উতরাই পথে লাগাম ধরে আমাদের পিছে হেলে যাওয়া । এই নিয়ে বারবার টানাপোড়েন । তার মধ্যে মেঘের বাড়ির দরজায় পৌঁছলেই বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে কেবল । সামনে আবার নীল আকাশ, পেছনে বরফচূড়ো । কিছুটা নদীর উপত্যকা তো আবার পাহাড়ী । সবুজ মেডো, দু একটা দাঁড়কাক  আবার হেলতে দুলতে চলা ঘোড়াদের মর্জিমত । কাইনমার্গ পৌঁছলাম । সবুজ মাঠ। দূষণ নেই । বৃষ্টি পড়ে আরো সবুজ লাগছে । সাজানো প্রান্তর ।  আচমকা এক চোরা নদী পাহাড় থেকে এঁকে বেঁকে নেমে এসে ঢুকে পড়ল পায়ের কাছে । ঘোড়া তার স্রোতে বেশ ন্যায়দম খেতে খেতে চলছে । কাদায় পা পড়লেই মনে হচ্ছে পা পিছলে যাবে ওদের । কিন্তু ওদের পায়ে নাল পরা থাকে বলে ওরা স্বচ্ছন্দ্যে অবলীলাক্রমে নদীর গতিপথে পা রেখে   চলতে লাগল । ততক্ষণে আমাদের জুতো আর প্যান্টে জলকাদার প্রিণ্ট । বৈশরণ এল বুঝি । পাইনগাছের সারি দিয়ে ঘেরা সবুজ প্রান্তর । দূর দিগন্তে নীল আকাশের পৃথিবী । পৃথিবীর নীচে ঐ প্রান্তর যার নাম সুইত্জারল্যান্ড পয়েন্ট । ছবি তুলে তফাত করা যাবেনা ।  ভিউপয়েন্টও বটে ।  আল্পসের বরফচূড়ো  আর হিমালয়ের বরফচূড়োয় । নো প্লাস্টিক জোন । পরিচ্ছন্ন চা-কফির ঠেক । ঘোড়া থেকে নেমে গরম চায়ে চুমুক ।  ননস্টপ ডিজিটাল ক্লিকে বন্দী হল ভারতের সুইস পয়েন্ট । 
  চা খেয়ে ওপরে উঠে এসে আবার বাদল, বুলডোজার আর চেতকের ভরসায় চেপে বসলাম ওদের পিঠে । ওরাই আমাদের একমাত্র বল ভরসা । আবার সেই ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, এক চিলতে রোদ্দুর মেখে  পাইনবনের মধ্যে দিয়ে অন্যপথে ফেরা হোল হোটেলে ।