ক্র্যাকুফে দুরাত
পোলিশরা এই ব্ল্যাক ম্যাডোনাকে আমাদের কালীর মত মানে। ওরা বলে Our lady of Czestochowa । এ দেবী নাকি অসাধ্য সাধন করেন। খুব জাগ্রত এখানে। ব্ল্যাক ম্যাডোনা দেবীর এই পোলিশ অধিষ্ঠান জাসনা গোরা মনাষ্ট্রি হল পোল্যান্ডের অন্যতম ঐতিহাসিক মনুমেন্ট। এখানে কুমারী মেরীর কোলে যীশু। কিন্তু এর সর্বাঙ্গ কালো। অর্থাত ইনি আমাদের কালীর মত কৃষ্ণকলি।
গল্প শুনেই নেমে পড়ি জাসনা গোরা মনাস্ট্রিতে। অসাধারণ সুন্দর স্থাপত্য সেই চার্চের। প্রবেশ করি অন্দরমহলে। সেদিন শনিবার। কোনো মাস চলছিল। একপাল স্কুলপড়ুযা ব্যাসিলিকার ভেতরে সুসংবদ্ধ লাইনে প্রবেশ করছিল। তাদের সামনে ও পেছনে একজন করে সিষ্টার ছিলেন। আমরা ইশারায় সেই লাইনে ঢুকে পড়লাম। সিষ্টারের অনুমতি নিয়ে। তারপর ছবি তুলতে তুলতে সোজা পৌঁছে গেলাম ব্ল্যাক ম্যাডোনার প্রতিকৃতির সামনে। তারপর দিব্যি পুরোটা ঘুরে ফেললাম ঐ খুদে স্কুল পড়ুয়াদের পেছন পেছন। আমাদের মন্দিরের ছবি তোলার কোনো বিধিনিষেধ নেই এসব জায়গায়।
পোলিশ কিংবদন্তী বলে বহুযুগ আগে পোল্যান্ডে ওয়ায়েল পাহাড়ের নীচে এক ভয়ানক ড্রাগন বাস করত। ক্র্যাকুফ স্শহরের কেউ তাকে মারতে পারছিলনা। সারা স্শহরের লোকজন সেই ড্রাগনের ভয়ে থরহরিকম্প। লোকজন প্রায়শঃই তার তর্জন গর্জন শুনত । একদিন রাজা ক্রাক ঠিক শহরবাসীকে ধেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করলেন
"He who once and for all puts this dragon
Shall recieve my sceptre and my royal crown,
So come and defeat this most horrid beast
And win my daughters hand and a wedding feasts"
বহু দূর দূর থেকে রাজপুত্রেরা, সাহসী যোদ্ধারা সব পোল্যান্ডে এসে সেই ড্রাগনকে হত্যা করে রাজা ক্র্যাকের কন্যার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতে চ্চাইল। সারা শহর তীরধনুকে ছয়লাপ হল কিন্তু কেউ ড্রাগনকে মারতে পারলনা। অবশেষে একজন অল্পবয়সী মুচি সেই স্শহরে এসে জানাল সে ঐ ড্রাগনকে হত্যা করতে সক্ষম। তার যুদ্ধের কোনো স্সাজসরঞ্জাম ছিলনা। কেবল ছিল প্রখর বুদ্ধি, ছুঁচ ও সূতো। সে রাজপুরীতে প্রবেশ করেই রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। রাজা ক্রাক তো হতবাক! ঐটুকুনি এক বালক মুচি কিনা ঐ বিশাল ড্রাগনকে মারবে? ছেলেটি বলল, আমার চাই ভেড়ার চামড়া, একটু গন্ধক আর একটু সর্ষেদানা। রাজা বলল, বেশ তাই হবে। স্থানীয় মানুষেরা জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল সেই ড্রাগন নিধন যজ্ঞ। সেই বিস্ময়কর মুচিবালকটি সেই ভেড়ার চামড়ার মধ্যে গন্ধক পাউডার আর সর্ষে ভর্তি করে সেটিকে কায়দা করে সেলাই করে দিল ছুঁচ-সুতো দিয়ে। ভোরবেলায় সূর্যোদয় হতেই সে ঐ গন্ধক আর সর্ষে ভর্তি বস্তা নিয়ে ড্রাগনের কাছে যাবার আয়োজন করল। ড্রাগন জেগেই ছিল। সে খিদের তাড়নায় পাহাড়ের নীচে কিছুদূর এগুতেই একটা দেখল একটি ভেড়ার মৃতদেহ। সে সেই চামড়া বন্দী গন্ধক সব খেয়ে ফেলল। খেয়ে ফেলা মাত্রই ড্রাগনের পেট ফেটে মৃত্যু হল। রাজ্যের সব লোক তখন সেই ড্রাগন দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করল পাহাড়ের নীচে ভিসটুলা নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। সালফারে বিস্ফোরণ হয়ে ড্রাগনের আগুণ নেভাতে নদীর জল প্রায় শেষ।
এই রোমাঞ্চকর পোলিশ কিংবদন্তী শুনতে শুনতেই পথে পড়ল ভিশটুলা নদী। বাস থেকে ক্লিক ক্লিক। আবারো চলা।
ড্রাগনের গল্প শুনে এবার নেমে পড়া ক্র্যাকুফ মেইন টাউন স্কোয়ারে। একর্ডিয়ানের সুর বাজছে কোথাও। কোথাও করুণ সুরে ভায়োলিন। পুরণো শহরের অলিগলি হাঁটতে গিয়ে কেবলি মনে পড়ে নিজের শহরটাকে। কোথাও আবারো টুংটাং ঘোড়ারগাড়ির আওয়াজ। কি রাজকীয় তাদের সাজপোষাক!
মনে হয় আরো কি করে সুন্দর হয় সে! ক্র্যাকুফেও ট্রাম চলে অনবরত।
মনে মনে ভাবি সেদিক থেকেও আমরা পিছিয়ে নেইকো মোটেও। রাস্তার মোড়ে মোবাইল পোষ্ট-অফিস ভ্যান।
হলুদ পিটুনিয়া শীতের শেষ রেশটুকুনি মেখে তখনো এক এভিনিউ আলো করে দাঁড়িয়ে আছে।
পথের ধারে রেস্তোঁরায় আবার সামান্য দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নি। রেস্তোঁরায় টয়লেট সারতে গিয়ে দেখি প্রকান্ড কাঠকয়লার আঁচে মাংস ঝলসানোর পর্ব চলছে অহোরাত্র।
শিল্প আর শিল্পীর সমাবেশকে আমার শহরও পাত্তা দেয় যথেষ্ট। আর গান-তাল-বাদ্য সেদিক থেকেও পিছিয়ে নেই সে। তাহলে অসুবিধে কোথায়? মানে কলকাতার রাস্তায় পোল্যান্ডকে নামিয়ে আনতে?
দূরে বসে কলকাতাকে বলে উঠি..."dzien-do-bry"
জাগো সুন্দরী! ভোর হয়েছে, দ্যাখো....
No comments:
Post a Comment