শীত পড়লেই মন উসখুশ! আমার রূপসী দক্ষিণবাংলায় গ্রীষ্মে তো বেড়ানোই দায়। তাই অমৃত কমলার ভোর গড়িয়ে পৌষের রোদ গায়ে মেখে প্রতিবারই বেরিয়ে পড়া আর কি! কত কিছুর স্বাদ নেওয়া, কত অজানা অচেনা দ্রষ্টব্য নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে লেখা এখনো বাকী। বীরভূম এমনি একটি জেলা যেখানে দেখবার শেষ নেই। তার বোলপুর সার্কিটটা ভাল করে দেখতেই সপ্তাহখানেক সময় লেগে যাবে। আর কলকাতা থেকে গেলে শান্তিনিকেতনকে বেস করাই ভাল। সারাদিন ধরে ঘুরে এসে শান্তির বিশ্রাম নিয়ে আবারো পরদিন ঘোরা যায়। প্রচুর ট্রেন ছাড়ে কলকাতা থেকে। আর শান্তিনিকেতন থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যেতেই পারে। আর নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই।
শীত এলেই পৌষমেলার টানে কত হুজুগে মানুষ প্রতিবছর শান্তিনিকেতনে পৌঁছে যান। কিন্তু তার সিকিভাগ মানুষজনও কোলাহল মুক্ত পরিবেশে শীতকে উপভোগ করতে বোলপুর শহর ছেড়ে কিছুটা দূরে যাবার কথা ভাবতেও পারেন না। পৌষমেলা দেখে নিয়েও কিন্তু শান্তিনিকেতন থেকে অতি অনায়াসেই পৌঁছানো যায় জয়দেব প্রসিদ্ধ কেন্দুলি হয়ে ঘুরিশা আর মৌখিড়া গ্রামদুটিতে। ইলামবাজারের চৌপাহাড়ি জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে শীতের সকালে প্রথমে হাজির হয়েছিলাম অজয় নদের ধারে কেন্দুলি বা কেন্দুবিল্ব গ্রামে।
গীতগোবিন্দ প্রসিদ্ধ কবি জয়দেবের জন্মস্থান এই কেন্দুলি গ্রাম। মকরসংক্রান্তিতে মেলা বসে জমিয়ে। আউল-বাউল-বৈষ্ণব কীর্তনিয়া দূরদূরান্ত থেকে হাজির হন এখানে। উন্মুক্ত পরিবেশে গান-উৎসব হয় মহা সমারোহে। জয়দেবের আরাধ্য রাধাবিনোদের টেরাকোটা মন্দিরটির পাশাপাশি কদম্বখন্ডীর ঘাটে রাধামাধবের বিগ্রহপ্রাপ্তির গল্প আজো মুখে মুখে ফেরে। অজয় নদে পুণ্যস্নান করেন অগণিত মানুষ। কবি জয়দেবের ভিটের ওপরেই রাধাবিনোদের নবরত্ন টেরাকোটা মন্দিরটি আজো নজর কাড়ে। মন্দিরের গায়ে রামরাবণের যুদ্ধ থেকে দশাবতার আর গর্ভগৃহে রাধাবিনোদের যুগলমূর্তিটি জয়দেবের আরাধ্য বলে এখনো মানুষের বিশ্বাস। বর্তমানে আর্কিওলজিকাল সোশ্যাইটির তত্ত্বাবধানে রেখাদেউল রীতিতে নির্মিত এই মন্দির । কুলেশ্বর ঘাটের কাছে কুলেশ্বর শিবমন্দিরে কবির সিদ্ধাসন এর প্রস্তরখন্ডটি আজো রয়েছে। প্রকান্ড এক মহীরুহ। মাটীতে টুকটুকে লাল বটফলের গালিচা আর গাছের ওপর থেকে অসংখ্য ঝুরি নামা দেখে বোঝা যায় মূল বৃক্ষটি বট। তার ফোকরের মধ্যে দিয়ে উঠেছে একটি পাকুড়গাছ । আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল বট ও পাকুড়ের মধ্যিকারের ব্যাবধানে প্রকৃতির ইচ্ছেয় আরো দুটি বড়গাছের মধ্যস্থতায় তালের আঁটি পড়ে একটি শালপ্রাংশু তালগাছ সকলকে ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছে। এই বট-পাকুড় আর তাল গাছের ত্রহ্যস্পর্শে বাঁধানো শানের বেদীতে গিয়ে বসলাম খানিক। কিছুদূরেই অজয়নদের রুক্ষ ও শুষ্ক নদীবিছানা। বালির বুক চিরে একটু একটু জল। রোদের আলো পড়ে সেইটুকুই চিকচিক করে ওঠে। আদিগন্ত শুকনো চরাচর। গাছপালাও কম। জনবসতিও বিরল। অজয়নদের তীরে এই ঘাটটি নতুন করে বাঁধিয়ে সংস্কার করা হয়েছে । এরই নাম কদম্বখন্ডীর ঘাট।
এবার পা বাড়ালাম ঘুরিশার দিকে।
ইলামবাজার থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। শাল, সোনাঝুরির এভিনিউ এর মধ্যে দিয়ে "পায়ের মোড়" পেরিয়ে প্রথমে খোঁজ নিলাম ঘুরিশা গ্রাম পঞ্চায়েতের। কারণ হাতের মুঠোর গুগ্ল ম্যাপ এর দিশা অন্ততঃ তাই বলছিল। তারপর ঘুরিশা ইস্কুল মোড় পেরুতেই চোখে পড়ল তিনোর বাসস্ট্যান্ড। স্থানীয় মানুষেরা বলল, পুরাতন মন্দির এই পথে। ব্যাস গাড়ি ঘুরিয়ে সেই পথে। স্থানীয় মানুষেরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ঘুরিশার বিখ্যাত রঘুনাথজী মন্দিরে। বাংলার চারচালার স্টাইলের টেরাকোটার অপরূপ মন্দিরটি। বহু পুরণো বোঝাই যায়। সে সময় ইলামবাজার ছিল বাংলার অন্যতম বিজনেস সেন্টার। নীলকর সাহেব এবং আখচাষের হেতু চিনি উত্পাদন কেন্দ্র হিসেবে বেশ নামডাক ইলামবাজারের। ঘুড়িশা গ্রামে হত ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা। রঘুনাথ ভট্টাচার্য ( মতান্তরে, রঘুনাথ আচার্য ) এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনুমানিক সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দে । এটি প্রধানতঃ রামচন্দ্রের মন্দির। মন্দিরের মধ্যে রামচন্দ্রের স্বর্ণমূর্তিটি মারাঠা বর্গীদস্যুরা লুঠ করে নিয়ে চলে যায়। তাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই মন্দির । এরপর স্থানীয় শ্রী রামময় পঞ্চতীর্থ ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরটিকে সংস্কার করে গর্ভগৃহে পশুপতি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মূল মন্দিরটি বেশ উঁচুতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। মন্দিরের দুটি প্রবেশপথ। চার দেওয়ালের টেরাকোটার অভিনব স্থাপত্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এই পোড়ামাটির পৌরাণিক শিল্পকর্ম যে কত নান্দনিক হতে পারে আর তার বিচিত্র কারুকার্য যে কোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকর্ষণ করবে। অনেকটা যেন বিষ্ণুপুর টেরাকোটা মন্দিরের স্টাইল সেই পোড়ামাটির কাজে।
শীতের সকালে প্রত্যন্ত এক গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলেছি। গ্রামের মানুষেরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, ভাবে এই গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের টানে গাড়ি চেপে শহরের মানুষ আসে ? আর সেই মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার মণিমুক্তো নিয়ে তাদের তো কোনো হেলদোল নেই! একজন ছেলে তার বন্ধুটিকে জিগেস করেই বসল, কি আছে রে মন্দিরে? আমি ঝটিতি জবাব দিলাম, সোনাদানা, হীরে জহরত। ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আমার দিকে। এ পাশে ফুলুরি-জিলিপির দোকান ওপাশে অঘ্রাণের ধান ঝাড়াই হয়ে পৌষের রোদে সোনা হয়ে পড়ে রয়েছে। রাজহংসী কম্বুকন্ঠ ঘুরিয়ে আড়ে আড়ে চাইল অপরিচিতের দিকে। তারপরেই ধীর পায়ে নেমে গেল পুকুরের জলে। চলেছিলাম মরাই ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর সারিসারি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে। ধান কাটার পর্ব শেষে। এবার আসন্ন নবান্নের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই আমার বাংলা। বাগাল ছেলের অমলিন হাসি, গামছা গায়ে তণ্বী তনয়াদের দলে দলে পুকুর স্নান আর হাঁস চরা থৈ থৈ পান্না পুকুরকে সঙ্গী করে এগুতে থাকি আমরা। মাইলের পর মাইল খেতি জমিতে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপির ফলন দেখতে দেখতে আরো এগুতে থাকি। খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধা তখন। এখন এ গ্রামের ধান বুলবুলিতেও আর খায়না আর বর্গীরাও আসেনা লণ্ডভণ্ড করতে। মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথটি যথারীতি পুবদিকে। প্রবেশদ্বারের মাথা অর্ধচন্দ্রাকৃতি। সুচারু হাতে পোড়ামাটিতে খোদাই করা রয়েছে ষাঁড়ের পিঠে বেশ লম্বা শিবমূর্তি। এর ঠিক ডানদিকে রাজহংসের পিঠে চতুরানন ব্রহ্মা আর বাঁদিকে গরুড়াসনা বিষ্ণু। বেশ ক্ষতিগ্রস্ত সব কারুকাজ। তবে এখনো অনেকটাই রয়েছে দেখবার মত। এছাড়াও রয়েছে ছিন্নমস্তা এবং অপরূপ এক কালীমূর্তি। কেউ মনে করেন এটি নরমুন্ডের মালা পরিহিতা চামুন্ডা কালী। এছাড়াও দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, শিব-পার্বতী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী মূর্তিগুলি বেশ স্পষ্ট। কোথাও আবার টেরাকোটার প্যানেলে রাম-রাবণের যুদ্ধ, কোথাও বা বিষ্ণুর অনন্তশয্যা, রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা চমত্কার ফুটে উঠল চোখের সামনে।
এবার আরো এগিয়ে চলি স্থানীয় মানুষদের জিগেস করতে করতে। প্রত্যন্ত এই গ্রামে শহরায়নের ছাপ বেশ স্পষ্ট। মোবাইল ফোনের রমরমা মাটির দেওয়ালের বিজ্ঞাপনে। হাওয়ায় উড়ছে 3G, 4G কিন্তু যুবক যুবতীদের কাছে সে কনসেপ্ট এখনো অধরা। প্রকৃতি লুটেপুটে খাচ্ছে ধুলোমলিন ঘুড়িশা গ্রামের দারিদ্য। সামান্য চাষাবাদ, গরু, হাঁসমুরগী প্রতিপালন এই মানুষদের জীবিকা। তবুও হাসিমুখে উত্তর দেয় কথার। গোবর লেপতে লেপতে, ধান ঝাড়তে ঝাড়তে মেয়েরা বলে, "এই তো সামনেই, আরেকটু যান, গোপাল, লক্ষী-জনার্দন মন্দিরটা দেখতে পাবেন"
এঁকেবেঁকে ধানের গোলায় ধাক্কা খেতেই চেয়ে দেখি সুউচ্চ নবরত্ন মন্দিরের চূড়া। হিন্দুরীতি মেনে এটিও পুবমুখী মন্দির। এটিতে নিত্যপুজো হয়। আর এর অবস্থা আগেরটির চেয়ে একটু ভাল মনে হল। বহু প্রাচীন মন্দির। ১৭০০ সালের।
এ মন্দিরের সংস্কার হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। বসেছিলেন এক বয়স্ক মহিলা। মাসীমা বলেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাসিমুখে তিনি উত্তর দিলেন প্রশ্নের। বললেন, আমার শ্বশুরমশাই বর্ধমানের মানুষ ছিলেন। তিনি এর দেখভাল করতেন। নিত্য পুজোপাঠের ব্যাবস্থা তখন থেকেই দেখে আসছি। উনি থাকলে আপনারা আরো তথ্য পেতেন। মূল মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বর্ধমানের এক গন্ধবণিক ক্ষেত্রনাথ দত্ত। ব্রিটিশ আমলে ইলামবাজারের নামকরা লাক্ষা ব্যাবসায়ী ছিলেন। উঁচু প্ল্যাটফর্মে গিয়ে তখন আমরা একে একে টেরাকোটা প্যানেলের ছবি তুলেই চলেছি। কি অপূর্ব নান্দনিক সেই কারুকার্য। মন্দিরের তিনটি আর্চ করা প্রবেশপথ গিয়ে পড়েছে এক বারন্দায়। তারপরে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ। গোপাল, লক্ষ্মী আর জনার্দণের বিগ্রহ আছে। বৃদ্ধা বললেন, জানিয়ে এলে ভোগের ব্যাবস্থা করতে পারতাম। এই নবরত্ন মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ দেখলেই বোঝা যায় এটি বৈষ্ণব মন্দির। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ তাঁদের পার্শ্বদদের সাথে নৃত্যরত। এছাড়াও রাধাকৃষ্ণ ও রয়েছে। তবে আর্চ করা খিলানের মাথায় শাক্ত ধর্মাবলম্বীর ছোঁয়া। টেরাকোটায় ফুটে উঠেছে ত্রিপুরাসুন্দরী, ষোড়শীর ন্যায় কালীর দশমহাবিদ্যার রূপ। এছাড়াও রয়েছে রাম, সীতা, গণেশ। মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্ত বণিকের কমলেকামিনী ও ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে সদলবলে যুদ্ধযাত্রা। বৃদ্ধা জানালেন, গর্ভগৃহে প্রতিনিয়ত শালগ্রাম শিলা, গোপাল, ত্রিপুরাসুন্দরী, গণেশ এবং মঙ্গলচন্ডীর পুজোপাঠ হয়।
ডিজিটাল ক্লিকে মুখর নবরত্ন মন্দিরের টেরাকোটার দেওয়াল। নেমে দাঁড়াতেই গায়ে কষে সর্ষের তেল মাখতে মাখতে শীতের রোদ পোহাচ্ছিলেন বৃদ্ধার এক আত্মীয়। তিনি বললেন, ফেরবার সময় মনসার থানে মাথা ঠেকিয়ে যাবেন কিন্তু। সাপখোপ নিয়ে বেঁচে থাকত মানুষ সেসময়। এখন জঙ্গল কেটে সাফ। তবুও মা মনসার দোর ধরে আমরা পড়ে আছি এ গ্রামে। এগিয়ে গেলাম। মনসা মন্দিরটি আরো প্রাচীন। তার নাটমন্দিরে এক জেলে দম্পতি মাছ ধরবার জাল বুনছে । মন্দির বন্ধ। বেশ ভগ্নপ্রায় তার অবস্থা। এখন অরণ্যমেধ যজ্ঞে সামিল গ্রামের মানুষ। পালিয়েছে সাপ। আর মা মনসা তার আগেই স্বর্গবাসী হয়ত। তবুও মানুষের বিশ্বাস যায়না ম'লে।
এরপর আমাদের গন্তব্য ইলামবাজারের দক্ষিণে আরেকটি গ্রাম মৌখীড়ায়। বর্ধমান-বীরভূম সীমান্তে ইলামবাজার থেকে যার দূরত্ব মাত্র মাইল তিনেক। আবার গুগ্লম্যাপ। আবার স্থানীয় পুছতাছ। ওদিকে পাশের দ্বারন্দা গ্রামে বনলক্ষ্মীর তপোবনে আমাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যাবস্থা করা আছে। অতএব ফোন ঘোরাও। ওপ্রান্ত থেকে বনলক্ষ্মীর উত্তর, দেরী হলেও আসুন । আপনাদের, গরম ভাত আর চিংড়ির মালাইকারী রেডি থাকবে। অগত্যা চলো লেটস গো টুওয়ার্ডস মৌখীড়া। ইলামবাজারের এত কাছে মন্দিরপ্রধান গ্রাম মৌখীড়া? সেখানেও আঠারোশো খ্রীষ্টাব্দের প্রাচীন সব মন্দির। গ্রামের রাস্তায় প্রবেশ করলেই দেখতে পাওয়া যায় ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
“It is an object very dear to my heart and I cannot help welcoming any endeavours towards its realisation”
চলেছি আর বারেবারে মনে করছি রবিঠাকুরের কথাগুলি। আমার রূপসীবাংলায় সে যুগে দলে দলে ক্রাফটসম্যান ছিলেন আর কিছু মানুষ ছিলেন এদের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। এই সব শিল্পীদের দিয়ে তাঁরা তৈরী করেই চলতেন একের পর এক মন্দির। এ যেন কারিগরের চাঁদের হাটে বাংলার গ্রাম উঠত জেগে। আর ছড়িয়ে পড়ত টেরাকোটার শিল্পকর্ম এভাবেই। অতএব ইট, চুন, সুরকি, বালি আর প্লাসটার। ফুটিয়ে তোলো তিরিশ কিম্বা পঞ্চাশ ফুট লম্বা মন্দিরের গায়ে সেই অভিনব পোড়ামাটির মোটিফ। পয়সার অভাব নেই। শিল্পীর হাতের কাজ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। তখন বাংলায় বিত্তবানদের বাস। জমিদার, রেশম ব্যাবসায়ী, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, পানের বরজের মালকিন, কয়লার ব্যাবসায়ী, সকলের সম্মিলিত ধনদানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক বাংলার গ্রামের পর গ্রাম। ঠিক তেমনি এক গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল সেদিন। নাম কালিকাপুর। সেখানকার দুর্গাবাড়ি আজো সুপ্রসিদ্ধ। নামী বাংলা ছায়াছবির শ্যুটিং স্পট। একদা নীলকুঠি পাড়া। আজো একরের পর একর তাদের জমি, প্রাসাদ, কুঠিবাড়ি সব পরিত্যক্ত, চাবি বন্ধ। আর সেই চত্ত্বরেই উন্মুক্ত প্রান্তরে জোড়া মন্দির। আবারো অভিনব স্থাপত্য তার গায়। নীলকর সাহেবদের আধিপত্য এখনো অমলিন মন্দিরের গায়ে। প্রায় এক ফুটেরো বেশী লম্বা সারে সারে মেম সাহেবের প্রতিকৃতি মূর্ত হয়ে রয়েছে মন্দিরের গায়ে। তার সঙ্গে আমাদের সব ধর্মীয় দেবদেবীরাও রয়েছে যথারীতি। পৌরাণিক কাহিনীও বর্ণিত দেওয়াল গাত্রে।
জমিদার পরমানন্দ রায় এর পুত্র কৈলাস রায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সেদিনকার মত মৌখীড়ার মন্দির দেখে এবার বনলক্ষ্মীর পথে দ্বারন্দা গ্রামে। সেখানে খেতের রাঁধুনিপাগল চাল, খেজুরের গুড়ের পিঠে, আচার, নতুন কলাই ডালের বড়ি আর হস্তশিল্প পর্ব সমাধা হতেই দেরীতে লাঞ্চ সেরেই সেদিনের মত ঘরে ফেরার গান। ভাগ্যি ভগবান কপালে প্রান্তিকে একটুকরো মাথা গোঁজার স্থান রেখেছিলেন। তাই বেলাবেলি টুক করে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে জমে যায় শীতের ছুটি, কেনাকাটির দুপুর, গ্যাস্ট্রনমিক ফুর্তি! আর গ্রাম বাংলার মন্দিরময়তা আর তার সারে সারে টেরাকোটার ছবি তুলে রাখে আমার মন ক্যামেরা। কলমে বেঁচে থাকে বাংলার ঐতিহ্য।
খুব ভালো লেখা,মনগ্রাহী। লেখা চালিয়ে যান। ধন্যবাদ
ReplyDelete