স্ট্যাচু অফ লিবার্টি |
ম্যানহাটন শহর |
ওনার পিএইচডির কাজ শেষ হল । এবার বাকি ডিসার্টেশান । খুব একটা কাজের চাপ ছিলনা আর । এবার পাড়ি দেবার সময় নিউইয়র্কে । স্ট্যাচু অফ লিবার্টির রাজ্যে, নায়গ্রা জলপ্রপাতের কাছে...এমন আরো কত কিছুর আকর্ষণে । ডালাস-ফোর্টওয়ার্থ এয়ারপোর্ট থেকে ট্রান্সওয়ার্লড এয়ারলাইন্সের (TWA, বর্তমানে আর নেই) ছোট্ট একটা বিমানে চড়ে বসলাম এক সকালে । নিউইয়র্ক পৌঁছলাম নির্ধারিত সময়ে । জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে , আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নামে বিখ্যাত এই বিমানবন্দর । ব্রুকলিনের এক বন্ধু ত্যাগরাজন এসেছিল আমাদের পিক আপ করতে । সেখান থেকে সোজা তার বাড়ি গিয়ে উঠলাম । তার দুটো ঘর । একটা আমাদের ছেড়ে দিল । রান্নাঘরে হরেক রকম ইন্ডিয়ান খাবার রান্না করার সরঞ্জাম রয়েছে দেখা গেল । বন্ধু একা দিনের পর দিন হাত পুড়িয়ে খেতে অভ্যস্ত। রান্নাঘরে আমি আসার ফলে ত্যাগরাজন বেশ মুক্ত বিহঙ্গের মত নিজের কাজে মনোঃসংযোগ করে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দিনকয়েক । পৌঁছেই আমি ভাত, ডাল, বেগুণ ভাজা রান্না করে ফেললাম । বন্ধুটিও খুব উল্লসিত। সে ছিল নিরামিশাষী । অবিশ্যি তাতে আমাদের অসুবিধে নেই । কাছেই ছোট্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে পরদিন ব্রেকফাস্টের জন্য ব্রেড, ডিম, দুধ সব কিনে আনলাম । রাতে বন্ধুর জন্য আলুপরোটা বানালাম, টক-দৈ আর আচার সহযোগে আমরাও মহাতৃপ্তিতে উদরপূর্তি করলাম ।
খেয়ে উঠে নিউইয়র্ক শেডিউল ছকে নেওয়া হল । গাইড করল ত্যাগরাজন ওরফে আমাদের বন্ধু ত্যাগু । ব্রুকলিন শহর থেকে একটু হেঁটেই ধরা যায় নিউইয়র্ক মেট্রো বা সাবওয়ে । ঠিক হল আমরা রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ব্রুকলিন ব্রিজ ক্রস করে ব্রুকলিন মেট্রো স্টেশনে যাব ।টিকিট কেটে নিয়ে মেট্রোরেলে উঠে পড়া হল । ডাউনটাউন নিউইয়র্ক পৌঁছলাম অতি সুন্দর, ঝকঝকে পথঘাট কিন্তু পুরোণো শহরের ছোঁয়া ।সবকিছুই আছে কত সুন্দর করে । রাস্তায় মানুষের ভীড় আছে কিন্তু সুসংবদ্ধ, শৃঙ্খলিত । নিউইয়র্কের এইখানটা আমাদের কোলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারেরর মত জণাকীর্ণ। সর্বক্ষণের কর্মব্যস্ততা সেখানে । কিন্তু ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে কোনো অসুবিধে নেই ।পৃথিবীর অন্যতম বৃহত প্রাকৃতিক বন্দরের সন্নিকটে নিউইয়র্ক শহর । ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, ম্যানহাটান, কুইন্স এবং স্টেটেন আইল্যান্ড ...এই পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে নিউইয়র্ক শহর বষ্টন এবং ওয়াশিংটন ডিসির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত । হাডসন নদীর উত্সমুখে নিউইয়র্ক । হাডসন নদী এই শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটল্যান্টিক মহাসাগরে পড়েছে । হাডসন নদী নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি শহরকে পৃথক করে । জলবায়ু বেশ উষ্ণ ও আর্দ্র ।
ম্যানহাটন শহর হাডসন নদীর ওপারে। আর এপারে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ।
প্রথমে আমরা গেলাম স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে । একুয়ামেরিন রঙের স্ট্যাচু। তার একহাতে আলোর মশাল আর অন্যহাতে আমেরিকার সংবিধানের খসড়া । ১৭৭৬ সালে ৪ঠা জুলাই স্বাধীনতা লাভের পর একশো বছর পূর্তিতে , ১৮৮৬ সালে ইউনাইটেড ষ্টেটসকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি উপহার স্বরূপ দিয়েছিল ফ্রান্সের মানুষ । নিউইয়র্ক বন্দরের ঠিক মাঝখানে লিবার্টি আইল্যান্ড আলো করে হাডসন নদীর বুকে দন্ডায়মান এই মূর্তি হল রোমান স্বাধীনতার দেবী লিবারেটসের, তার পায়ের কাছে এক ভাঙা শৃঙ্খল (চেন) যা স্বাধীনতার প্রতীক চিহ্ন । হাডসন নদীর ওপারের স্কাইলাইন জুড়ে তখনো ছিল টুইন টাওয়ার । ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১'র বিদ্ধ্বংসী বিস্ফোরণের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই লিবারেটসের মূর্তি । তারপর কত জল বয়ে গেছে হাডসন দিয়ে । উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে চলেছি একে একে । ঘুরে ঘুরে দেখতে দারুন লাগে নদীর পারে ব্যস্ত বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য । স্যুভেনিয়ার শপ থেকে চট করে কিনে ফেললাম পোর্সেলিনের ছোট্ট স্ট্যাচু অফ লিবার্টির রেপ্লিকা ।
১৯৮৯ সালে ডিজিটাল ক্যামেরা কোথায়? স্টুডেন্ট স্টাইপেন্ড জমিয়ে কেনা বেশ গোদা মাপের জাপানী রিকো ক্যামেরা। রেকারিং খরচ ফোটোতোলায়। ফিল্ম ভরো আর ফোটো নাও। এখনকার মত আনলিমিটেড ছবিতোলার সুযোগ নেই । প্রতি মূহুর্তেই কোডাক চলো। ডলার ফেল। জীবনের নাইস মোমেন্টস হাতছাড়া হবার ভয়ে তাই ফেল কড়ি মাখো তেল । এখন যেমন অপছন্দ ছবি এক ক্লিকে ডিলিট করতে নো চাপ। তখন পাঁচটা ছবি তুলে একটা বেছে নাও । কিন্তু বাকী চারটে পয়সা দিয়ে কেনা। ফেলতেও মন চায়না আবার এলবামে সে ছবির এক্কেবারে নো এন্ট্রি। অবিশ্যি আমরা দুজনে খুব সাবধানে চলেছিলাম । সীমিত পকেটমানি আর কিছু জমানো ডলার আমাদের মোট সঞ্চয়। অযথা বেশভূষার পেছনে না দৌড়ে শুধু নতুন দেশ দেখব আর ভালো ভালো ছবি তুলব তাই কোডাক কোম্পানিকে একটু বড়লোক করে দিলাম । সেগুলোই আমাদের স্মৃতি হয়ে রইল। পোষাক আশাক আর সুখাদ্যের তো শেষ নেই কিন্তু এখনকার বাজারে বিদেশভ্রমণ যে কি ভয়ানক ব্যয়বহুল তা ভাবলে শিউরে উঠে আর ভাবি ভাগ্যি কিছু ছবি তোলা ছিল ।
এরপর সেন্ট্রাল পার্ক গেলাম । নিউইয়র্কের এই পরিছন্ন পার্কটি নাকি রাতের বেলায় নিরাপদ নয় মোটেও ।আমরা অবিশ্যি দিনের আলোতেই দেখলাম । পার্কের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ জিরেন হল । পরে যখন এনিমেটেড ছোটদের সিনেমা "স্ট্রুয়াট লিটল" দেখেছি তখন শ্যুটিং স্পট রূপে এই সেন্ট্রাল পার্কটিকে চিনতে অসুবিধে হয়নি ।
এবার আমাদের গন্তব্য ইউনাইটেড নেশানস বিল্ডিং ।একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এই ইউ. এন. ও (UNO) । যেখানে সব দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন এবং বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য কি করা উচিত সেটি নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে উপদেশ দেন ।
ইউনাইটেড নেশানস বিল্ডিং |
সারে সারে উড্ডীয়মান ইউনাইটেড নেশানসের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির রংবেরংয়ের জাতীয় পতাকা । আমাদের তেরঙাকে খুঁজে পেয়ে যারপরনেই উদ্বেলিত মন । টুক করে তার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে গর্বিত ভারতীয়রূপে নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করলাম মনে মনে । তারপর ইউএন প্লাজায় বসে একটু বিশ্রাম ।
আবার পরদিন সকালে মেট্রো চড়ে যাওয়া হল গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন । সেখান থেকে বিখ্যাত নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট দেখতে । স্প্যানিশ চিত্রকর ফ্র্যান্সিসকো গয়ার প্রদর্শনী চলছিল সে সময় । টিকিট কেটে নিয়ে ঢুকে পড়লাম মিউজিয়ামের ভেতরে । একে একে দেখতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে । দিকপাল সব চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্ম । কোনোটা তৈলচিত্র, কোনোটা জলরং বা প্যাস্টেল । অপূর্ব সংরক্ষণ, নিখুঁত পরিমন্ডল। ফরাসী চিত্রশিল্পী হেনরী মাতিজের ঝকঝকে ম্যুরাল, স্টিললাইফ। রং গুলি যেন মনে হয় নতুনের মত । ফরাসী ইম্প্রেশানিস্ট পেন্টার ক্লড মোনে এবং রেনোঁর অসাধারণ সব ছবি ছিল গ্যালারীতে । আর ছিল দুই পোষ্ট ইম্প্রেশানিষ্ট পেন্টার ফরাসী পল গঁগা ও ডাচ আর্টিস্ট ভিনসেন্ট ভ্যান গগের অনবদ্য কিছু ভালো ছবি । মন যেন ভরে গেল আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখে ।
মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট |
এবার থকে গিয়ে রাস্তায় এসে লাঞ্চ খাওয়ার তোড়জোড় । পিত্জা-হাটের সাথে প্রথম হাতেখড়ি হল । মাত্র ৯৯ সেন্টসে পাওয়া গেল চিকেন আর ভেজ টপিং দেওয়া পার্সোনাল প্যান পিত্জা । অসাধারণ লাগল প্রথম স্বাদেই । এখানকার পিত্জাহাটে যাই এখন তবে সেই ওরেগ্যানোর প্রথম গন্ধ আর ব্ল্যাক অলিভ আর মোত্জারেল্লা চিজের সেই স্বাদ যেন পাইনা । চিজ উপছে পড়ছে প্রতিটি পিত্জায় । পেপারনি অর্থাত বিফ আমার নাপসন্দ তার চেয়ে আমি সুইট কর্ণ, ব্ল্যাক-অলিভ, বেলপেপার (ক্যাপসিকাম) অনিয়ন, মাশরুম পিত্জাতেই বেশি খুশি হলাম। ওখানে পিত্জাহাটের টেবিলে সেই বিশাল লাল প্ল্যাসটিক জগে ঠান্ডা কোক আর টেবিলে রাখা চিজের গুঁড়ো বড্ড মিস করি আজকের পিত্জায়। ভারতীয় পিত্জা হাটে একটু কার্পণ্য আছে চিজ আর চিকেনের ব্যাপারে ।
পিত্জা, গার্লিকব্রেড আর কোক খেয়ে প্রস্থান । নিউইয়র্কের পথে পথে ঘুরছি পায়ে হেঁটে । ট্যাক্সিভাড়া করার সামর্থ্য নেই তবে নতুন শহর খুঁটিয়ে দেখার তাগিদে ভালোই লাগছিল পথশ্রম ।পুরোণো কলকাতার অলিগলি । যেন ফ্রিস্কুল স্ট্রীট কিম্বা পার্কস্ট্রীট । অথবা নিউমার্কেট পাড়া কিম্বা এসপ্ল্যানেড । কিন্তু পুরোণো বাড়িগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় । নিউইয়র্কের রাস্তায় পর্যাপ্ত মানুষও আছে। কিন্তু সাথে আছে পরিকাঠামো ।শপিংমল থেকে বড় বড় হোটেল, অফিস কাছারি সব আছে । ঘিঞ্জি একেবারে । কিন্তু কত সাজানো ।
ওয়াল স্ট্রীটর রাস্তায় |
এবার গেলাম হাঁটতে হাঁটতে নিউইয়র্কের ব্যস্ততম রাস্তা ওয়াল স্ট্রীটে । আমাদের মুম্বাইয়ের দালাল স্ট্রীট, কোলকাতার লিয়নস রেঞ্জ আর নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীট, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ অর্থাত যেখানে শেয়ার কেনাবেচা হয় । মিনিট দশেক হাঁটা পথে এবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে । ১৯৮৯ সালে ছিল গগনচুম্বী সেই টুইন-টাওয়ার যার নীচে দাঁড়িয়ে একসাথে ছবি তুলেছিলাম তা আর নেই আজকে । বোয়িং ৭৬৭ জঙ্গী বিমান হানায় ভস্মীভূত হয়ে গেছিল এই ট্রেড সেন্টার ২০০১ সালে । কত কত নামী দামী অফিসের নথি, নজির কত মানুষ কিছুক্ষণের একটানা অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল এই হিংসাত্মক ঘটনায় । এখন আবার নবনির্মিত সেই টাওয়ার কিন্তু আগেরটি এখন ইতিহাস যা স্বচক্ষে দেখেছিলাম । আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের ব্যাবসায়িক প্রাণকেন্দ্র এই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার । এবার যাওয়া হল ফিফথ এভিনিউ এবং ওয়েষ্ট থার্টিফোর স্ট্রীটের ক্রসিংয়ে আমেরিকার উল্লেখযোগ্য স্কাইস্ক্রেপার একশো দুইতলা এম্পায়ার ষ্টেট বিল্ডিং দেখতে । ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পর আমেরিকার দীর্ঘতম বিল্ডিং হল এটি ।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ! |
সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর অনেক রসদ নিয়ে আর ক্যামেরা ভর্তি ছবির নজির নিয়ে মিশে গেলাম নিউইয়র্ক মহানগরের কোলাহল মুক্ত মেট্রোরেলের জনস্রোতে ।
আবার ব্রুকলিন দিয়ে গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিবাস । পাঁচ-পাঁচটা দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল তা ভাবতেই পারিনা এখনো। শুধু স্মৃতির সরণি বেয়ে হেঁটে চলি আজো। অনুভব করি সেই আলোআঁধারি মহানগরের সন্ধ্যে আঁচ আর নরম সরম দুপুরের হালকা রোদ্দুরের ওম। এরপর আমাদের শেডিউলে নিউজার্সি থেকে নায়গ্রা । তা নিয়ে আবারো প্ল্যানিং, উত্তেজনা আর কোডাক ফিল্ম লোড করে নেওয়া রিকো ক্যামেরায় ।
ইচ্ছামতী ছোটদের পত্রিকায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment