সালটা
ছিল ১৯৮৯ । মার্চ মাস ।
সুদূর
ডালাসে পাড়ি দেওয়া হল । আমেরিকার
দক্ষিণ পশ্চিমের টেক্সাস
স্টেটে অবস্থিত ডালাস । বহু
প্রতীক্ষিত বায়ুপথে ভ্রমণ..
বিমানবন্দর
থেকে একে একে চোখের বাইরে চলে
গেল মা, বাবা আর
ভাইয়ের ছলছল চোখ ।
জীবনে
প্রথম বায়ুপথে হারিয়ে যাওয়া
। দমদম থেকে দিল্লী । সেখানে
বন্ধুবান্ধবের সাথে গেটটুগেদার
। মধ্যরাতে দিল্লী এয়ারপোর্টে
গিয়ে আবার উড়ানে জার্মানি ।
সেখান থেকে আরো দূরে আটল্যান্টা
।
এয়ারপোর্টে
ফ্রেস হয়ে বিধ্বস্ত জামাকাপড়
বদল করে ছোট্ট এক ফ্লাইটে
আটল্যান্টা থেকে সোজা ডালাস
পৌঁছালাম বিকেলবেলায় ।
ইউটিডালাসের ম্যনেজমেন্ট
স্কুলের পিএইচডি স্টুডেন্টরা
সব এসেছে.. একপাল
অপরিচিত মুখ সাদরে অভ্যর্থনা
করল ডালাস এয়ারপোর্টে । ভারতীয়
স্টুডেন্টদের একাধিক গরীব
রথ বরণ করে ঘরে তুলছে আমাকে
... সে এক অভিনব
অভিজ্ঞতা ।
অবশেষে
পৌঁছলাম ডালাস ক্লিফব্রুক
কন্ডোমিনিয়ামের এপার্টমেন্টে
। ঘুমে তখন দুচোখ বুঁজে আসছে
। অথচ বন্ধুদের হল্লা আর
হুল্লোড়ের খামতি নেই । গরম
ভাত থেকে শুরু করে পঞ্চব্যঞ্জন
রেঁধে রেখেছে বাঙালী বন্ধু
পত্নী । আমি তখন জেটল্যাগ
সর্বস্ব । তবুও হাসিমুখে আলাপ
পর্ব সেরে চলতে হল সকলের সাথে
।
আমেরিকার
মাটিতে পা দিয়েই মনে হল ঈশ্বরের
আশীর্বাদ ধন্য এই দেশ, কত
সুন্দর সৌজন্যবোধ মানুষের,
সুন্দরের সত্য পূজারী
তারা,
তারা
কত রুচিশীল, সত্যিই
তারা গড়তে জানে নিজেদের আর
ভালবাসে তাদের দেশকে, রক্ষা
করতে পারে ভগবানের সৃষ্টিকে,
আর নিজেদের সৃজনশীলতাকে
বিকশিত করে, উজাড়
করে দিতে পারে বিশ্বের দরবারে;
তুমি
বলবে কৃত্রিমতা এ শতাব্দীর
অভিশাপ কৃত্রিমতা যদি উন্নতি
ঘটায় তাহলে বাধা কোথায়?
বিজ্ঞান যদি কাজের
বন্ধু হয় তাহলে আপত্তি কিসে
? সৃষ্টিসুখের
উল্লাসে আমরা বাঁচিনা একটু
সহজ করে, সাবলীল
ভাবে!
আসলে
যে দেশের নাগরিকের চিন্তাধারা
সুস্থ, যারা সভ্যতায়
পরিপুষ্ট, বিধাতাপুরুষ
বোধ হয় দুহাত তুলে তাদের
আশীর্বাদ করেন..
প্রাকৃতিক
সম্পদের প্রাচুর্য্যে,
প্রাকৃতিক জলবায়ুর
মিষ্টতায় সে দেশের মাটিতে
মাথা ঠেকিয়ে রোজ আমরা প্রণাম
জানাতাম নিজের দেশমাতৃকাকে
।
এর মধ্যে
দেশের মানুষগুলোর জন্য মন
কেমন করলেই চিঠি লিখছি ফাঁকে
ফাঁকে । তবে বেড়ানোর আনন্দে
দখিনের খোলা জানলায় সব ওলটপালট
। ফাগুণের ওমে শীত লুকোল
শুকনোপাতায় । পলাশের হাসিতে
শীত-ফুলেরা মুখ
ঢেকেছে চুপিসাড়ে । শিমূল,
অশোকের হট্টমেলায়
ডালেডালে কাঁচা সবুজের ছোঁয়া
। মাতাল বসন্তে রঙীন প্রকৃতি
।
ভোরবেলা
কিচেনের ব্লাইন্ডস সরিয়ে
ক্লিফব্রুক কন্ডোমিনিয়ামসের
পার্কিং লটে তাকিয়ে থাকা সার
সার গাড়ির ছাদে দুধসাদা বরফের
চাদর ..তার সাথে
সূর্যের আলোর মাখামাখি !
দুপুরবেলা
বান্ধবীদের সাথে শপিংমলের
হাতেখড়ি, একরাশ
বিদেশী পারফিউমের গন্ধ নিয়ে
ফিরে আসা, বিকেল
হলেই নতুন জলখাবার তৈরী আর
প্রতীক্ষা...
তারপর
রোজ চোখ রেখেছি অপার বিস্ময়ে,
কখনো ডালাস ডোমের
মাথায় গরম কফি হাতে, টেক্সাস
ও ওকলাহোমার বর্ডারে অসাধারণ
টেক্সোমা লেকের জলের ধারে ।
কখনো টাইলার রোজ গার্ডেনের
গোলক ধাঁধায়, কখনো
নেচে উঠেছে প্রাণ টার্নার
ঝোরার ধারে, গুহার
ভেতর .. গেয়ে উঠেছে
মুক্তির আনন্দে, নেচে
উঠেছে ঝোরার জলের ছন্দে...
এল বি
জে এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর দিয়ে
লং ড্রাইভে ছুটেছি কত কত বার
আমার স্টুডেন্ট স্বামীর
সেকেন্ডহ্যান্ড দুধসাদা
মাজদা ৬২৬ গাড়িতে, হৈ
হৈ করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে
উইকএন্ডট্রিপ !হঠাত
প্ল্যান করেই "চলো
লেটস গো" বলে
বেরিয়ে পড়া আর কি !
প্রতি
সপ্তাহান্তে এমন ছোটখাটো
বেড়ানোর সাথে ছিল ভারতীয়
বন্ধুমহলের কারোর একজনের
বাড়িতে আয়োজিত পটলাক পার্টি
। দারুণ আইডিয়া । বিদেশে এসে
শিখেছিলাম । যার বাড়িতে পার্টি
হবে সে ভাত/রুটি
বানানোর দায়িত্বে থাকবে আর
অন্যেরা যে যার ইচ্ছেমত ডিশ
বানিয়ে আনবে । কেউ আবার
পেপারপ্লেট, চামচ
আর কোল্ডড্রিংক্সয়ের ভার নিত
। দারুণ মজা হত এমন পার্টিতে
। একঘেয়ে মেনু নয় কিন্তু পট
লাক (potluck) অর্থাত
কোন্ পটেতে কি আছে সেটা খাবার
সময় খুলে দেখবার । আর সবচেয়ে
বড় কথা হল যিনি পার্টির জন্য
বাড়িতে সকলকে ডেকেছেন তাঁর
ওপর অযথা চাপও পড়লনা ।
ডালাসে
যেখানে ইউনিভার্সিটি অফ
টেক্সাস অবস্থিত তার নাম
রিচার্ডসন । যেন শহুরে গ্রামের
মাদকতা সেই অঞ্চলে ।
(University of Texas @ Dallas )
রথযাত্রা
দেখেছিলাম ডালাসে । ডালাস
থেকে অনেকটা দূরে ইস্কনের
কালাচাঁদজীর মন্দিরে রথের
রশি টেনে কিছুটা স্বদেশের
জন্য ব্যাকুলতা কাটিয়ে উঠতে
পেরেছিলাম ।লুচি আর পাঁচমেশালী
একটি তরকারী সহযোগে ভোগপ্রসাদও
পেয়েছিলাম।
এরপর
মনে পড়ে ৪ঠা জুলাইয়ের সেই লঙ
উইকএন্ডের কথা । আমেরিকার
স্বাধীনতা দিবস । ডালাসের
সাবার্বে একটি খোলা মাঠের
ওপর বিকেল থেকে জমায়েত হল কয়েক
হাজার মানুষ । তারপর সন্ধ্যের
ঝুলে একে একে আকাশে ফুটে উঠতে
লাগল রঙ বেরঙের ফায়ারওয়ার্কস
। আতস বাজি, আলোর
বাজি এত সুন্দর ভাবে পরিবেশন
আর কোথাও দেখিনি । ব্যাবস্থাপনায়
কোনো ত্রুটি নেই । সুষ্ঠুভাবে
প্রায় তিন চার ঘন্টা বাজি
পোড়ানো হল সেই মাঠের ওপর ।
কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে
পড়ল না । অথচ বৈচিত্র্যময়তায়
ভরা সেই দীপাবলীর রাত যেন
আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল ।
ফায়ারওয়ারক্স দেখে সে রাতের
প্রোগ্রাম ছিল দল বেঁধে সকলে
মিলে পিত্জা হাটে পিত্জা খেতে
যাওয়া । তখন ভারতবর্ষে প্রবেশ
করেনি পিত্জা হাট । তাই আমি
অপার বিস্ময়ে গোগ্রাসে গিলেছিলাম
সেই লোভনীয় ইটালিয়ান খাদ্য
। তবে ভারতবর্ষের পিত্জা হাট
কিন্তু চিজ ছড়ানোর ব্যাপারে
আমেরিকার পিত্জা হাটের মত
এখনো অত জেনারাস হতে পারেনি
সেটাই বড় দুঃখ আমার । ঠাটবাট
সব ঠিকই রইল কিন্তু কোয়ালিটি
একটু নিকৃষ্ট হয়ে গেল ।
সে ফাগুনের
এক ভোরে আমরা প্ল্যান করে
বায়ুপথে পাড়ি দিলাম ডালাস
থেকে নিউইয়র্ক । আমেরিকার
প্রেসিডেন্টের নামে জন এফ
কেনেডি এয়ারপোর্টে অবতরণ হল
। কি ঝকঝকে এয়ারপোর্ট আর কেমন
সুন্দর সব ব্যবস্থা । এখানে
সব কিছুর মেন্টেন্যান্স দেখলে
অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকতে
হয় । এমনটিই থাকে বছরের পর
বছর, যুগের পর যুগ
।
নিউইয়র্কে
এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিনের
জন্য আস্তানা বেঁধে সারাটাদিনের
জন্য যাওয়া হল ওয়াশিংটন ডিসি
।
একটা
গাড়ি নিয়ে রাজধানী শহর ওয়াশিংটন
ডিসির রাজপথে.. অর্থাত
যা কিনা বর্তমান রাষ্ট্রপতি
বারাক ওবামার অফিস । ১৯৮৯ এ
সেই সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন
জর্জ বুশ । হোয়াইট হাউস বা
প্রেসিডেন্টের অফিসকে এখানে
ক্যাপিটল বলে ( capitol)।
ডিসির
রাজপথ হোয়াইট হাউসের রাজকীয়
শুভ্রতায় কি অসাধারণ শন্তিময়তা,
বাইরের সবুজ লনে কি
সুন্দর সজীবতা সাথে গেরুয়া
মরশুমি ফুলের একরাশ উচ্ছ্বাস
দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম ।
এই তিন
রঙ মনে করিয়ে দিল আমার
ধন্যধান্যপুষ্পে ভরা নিজের
দেশের কথা । মনে মনে প্রনাম
জানালাম ত্রিরঙা জাতীয়
পতাকাকে।
ক্যাপিটল
হিলের কাছে লিংকন মেমোরিয়াল
চির শুভ্রতায় জ্বাজ্জল্যমান
এব্রাহাম লিংকনের স্মৃতি
নিয়ে । সেখান থেকে ন্যাশানাল
মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল
হিস্ট্রিতে । সেই বহু বিতর্কিত
এবং অভিশপ্ত হোপ ডায়মন্ড দেখে
অবাক হতে হয় । ঘন নীল হীরে ।
কোনোদিনো দেখিনি এর আগে ।
(Smithsonian Museum of air and space)
ন্যাশানাল
গ্যালারি অফ আর্ট থেকে এয়ার
এন্ড স্পেস মিউজিয়ামে ঝুলন্ত
ছোট বড় কত কত উড়োজাহাজের মডেল,
আর তার বিবর্তন ।
তার
মধ্যে থেকেই উঠে এল স্মৃতির
মণিকোঠা থেকে রাইট ব্রাদার্সের
হাতে তৈরী প্রথম প্লেনের মডেল
। ক্লাস নাইনের ফিসিক্স বইয়ের
সেই ছবি আজ ত্রিমাত্রিক মডেল
হয়ে ঝুলছে চোখের সামনে..অরিভিল
এবং উইলবার রাইট এই দুই ভাই
সর্বপ্রথম আকাশের বুকে হাওয়া
কাটিয়ে ত্রিমাত্রিক এরোপ্লেনের
মডেল তৈরী করেছিলেন । মনে মনে
ভাবলাম সার্থক হয়েছে ওয়াশিংটন
আসা ।
সাময়িক
বাকরূদ্ধতা !
ওয়াশিংটন
ডিসির ন্যাশানাল গ্যালারী
অফ আর্ট এ এসে পৌঁছালাম । বহু
প্রতিক্ষীত ভাবনালোকের রূপসাগর
..
ডুব
দিলাম সেই রূপসাগরে..
ইম্প্রেশানিস্ট,
স্যুরিয়ালিস্টিক
সবরকমের পেন্টিংয়ের সাথে
হাতেখড়ি হল ! বিদেশের
নামী সব শিল্পীর দামী সব
তৈলচিত্র ।
Matisse, Rennoir, Claude Monet, Van
Gogh, Paul Gauginর গল্পে মাত
হয়ে গেছিল আর্ট গ্যালারির
প্রতিটি করিডোর !
সবচেয়ে
আশ্চর্যের বিষয় হোল Da Vinciর
আর এক বিরল সৃষ্টি দেখে যা
মোনালিসার থেকে কোন অংশে কম
নয় ।মোনালিসার হাসি নেই তাতে
কিন্তু সেই ভয় মিশ্রিত
গাম্ভীর্য্য..
অনবদ্য
লাগল সেই আর্ট গ্যালারী পরিদর্শন
। আরো চোখ জুড়িয়ে গেল ঐতিহ্যকে
সংরক্ষণ করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা
দেখে ।
বিদায়ের
সময় মনে মনে বলে উঠলাম, বিদায়
ওয়াশিংটন!
ডিসি
তুমি দিগবসনা, সবুজ
আঁচল শুভ্ররাজবেশে ছড়িয়ে
দিয়েছো নীলের দিগন্তে ,
সৌন্দর্য তোমার
অলংকার, রাজকীয়তা
তোমার মজ্জাগত, নিয়ম
শৃঙ্খলা তোমার সহজাত,
বেঁচে
থাকো ডিসি তোমার অমলিন স্বর্গীয়
রাজকীয়তা নিয়ে, আর
সর্বকালের অহংকার নিয়ে ।
রাজধানী হবার যোগ্যতা তোমার
মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ।
No comments:
Post a Comment