কার্তিকের হিমপড়ার শুরু হয়েছে দুর্গাঠাকুর জলে যাবার ঠিক পরে পরেই । বিজয়া দশমী আর কোজাগরী উত্সবের শেষরেশটুকুনি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের দেশের এক প্রাচীন শহর বারাণসীতে ।বারাণসীর পূর্বের নাম ছিল আনন্দবন । তারপর কাশী । বরুণা আর অসি এই দুই নদীর সঙ্গম তীর্থ বারাণসী বা বেনারস । গঙ্গায় এসে পড়েছে এই দুই ছোটনদী ঠিক এইখানে । কত বড় বড় মানুষ ঘাট বাঁধিয়েছেন গঙ্গার ধারে ধারে । তাঁদের নামে ঘাটের অধুনা নামকরণ । সবশুদ্ধ ৩৬৫ টি ঘাট রয়েছে এখানে । নৌকা করে কিম্বা পায়ে হেঁটে হেঁটে বেশ কয়েকটি পরিক্রমা ও করা যায় নদীর ধার দিয়ে । কত কত তীর্থপ্রেমী মানুষের আনাগোনা এই চির প্রাচীন মন্দিরময় শহরে । দেশবিদেশের পর্যটকরা কিসের আকর্ষণে সমবেত হন জানা নেই তবে দেশী তীর্থযাত্রীদের ভীড় ও নেহাত কম নয় এখানে । দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই রাণী অহল্যাবাঈ হোলকার প্রতিষ্ঠিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আর পাশেই অন্নপূর্ণা মায়ের মন্দির । কথিত আছে বহুযুগের প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দিরটি প্রথমে মহম্মদ ঘোরী, তারপর কুতুবুদ্দিন আইবক, ফিরোজ শাহ তুঘলক ও সবশেষে মোগল সম্রাট ঔরঙজেবের হুকুমে বিনষ্ট করে একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল । প্রাচীন শিবলিঙ্গকে পাশ্বর্বর্তী জ্ঞান ব্যাপী কুন্ডের মধ্যে পুরোহিতরা লুকিয়ে ফেলেছিলেন কিন্তু সেটিকে আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব যায়নি । মুঘল ও মুসলমান শাসনের অবসানের পর এবং হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্বরূপ হিসেবে রাণী অহল্যাবাঈ হোলকারের সৌজন্যে নবনির্মিত বিশ্বনাথ মন্দিরে বিশ্বনাথের নতুন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই শিবলিঙ্গই আজ চুম্বকের মত দেশ ও পৃথিবীর কোণা কোণা থেকে মানুষকে বারাণসীর এই মন্দির তলে টেনে নিয়ে আসে । হাওড়া থেকে অমৃতসর মেলে বারাণসী পৌঁছেই আমরা একটি হোটেলে মালপত্র রেখে অটোরিক্সা নিয়ে চলে যাই কালভৈরব মন্দিরে । এই কালভৈরবকে বলা হয় বারাণসীর কোতোয়াল বা বডিগার্ড যিনি বারাণসীকে বাঁচিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে । সরু গলি প্রধান এই পুরোণো শহরের পেল্লায় ষাঁড় গুলি রাজকীয় । তারা স্বমহিমায় গলির আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দন্ডায়মান । শহরের ভীড়ভাট্টা, অটোরিক্সার হর্ণ, মোটরবাইকের ধাক্কাতেও তাদের কোনো হেলদোল নেই । গলি জুড়ে আর রয়েছে দর্শনার্থীদের লাইন । কোনো মতে কালভৈরবের মাথায় ফুল-বেলপাতা চড়িয়ে বেরিয়ে এসে ঘাটের দিকে রওনা দিলাম । কেদারঘাটে এসে নৌকো নিলাম । নৌকো চড়ে ওপারে রামনগর প্যালেস দেখতে যাওয়া । প্রায় এক ঘন্টা মোটর বোটে চড়ে ঘাট পেরোতে লাগলাম একে একে । কাশীর রাজা চৈত সিং নির্মিত ঘাট, প্রভুঘাট, নিরঞ্জনী ঘাট , পঞ্চকোট ঘাট, মহানির্বাণ ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট, শ্রী নিষাদরাজ ঘাট, মীরঘাট ( যেখানে মীরাবাঈ স্বয়ং তপস্যা করেছিলেন ) দিগম্বর জৈন ঘাট, সুপার্শ্বনাথের জন্মভূমি প্রসিদ্ধ ; সুপার্শ্বনাথ ঘাট, আনন্দময়ী ঘাট, মাতা ভদারিণি ঘাট হিন্দী রামায়ণ রচয়িতা তুলসী দাসের নামে তুলসী ঘাট, রীবা ঘাট প্রভৃতি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘাট দেখতে দেখতে মাথায় কার্তিকের সূর্য নিয়ে গঙ্গা পরিক্রমণ করতে করতে অবশেষে পৌঁছলাম রামনগর । কার্তিক পূর্ণিমায় সব ঘাট গুলির সিঁড়িতে মাটির প্রদীপ জ্বলে একসাথে । তখন না জানি কি সুন্দর হয় ঘাটের শোভা ! গঙ্গা উত্সব পালিত হয় তখন মহাধূম করে । গঙ্গার জলে প্রদীপের আলোর সেই প্রতিফলন কি অপূর্ব আলোর জলছবি সৃষ্টি করে তা কল্পনা করে নিলাম মনে মনে । দীপাবলীর প্রাক্কালে ঘাটের সিঁড়িগুলির মেরামতি চলছিল সেই কারণে ।
রামনগর প্যালেস ও ফোর্ট
কাশীর রাজার রাজবাড়ী এবং স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মস্থান এই রামনগর । রাজবাড়ি, ফোর্ট এবং মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখবার মত ।
অতি উপাদেয় পাওভাজি-চাট এবং লস্যি সহ দুপুরের আহার হল এখানে । লসিতে জল মেশায়না বারাণসীতে । টাটকা টক দৈ ফেটিয়ে তার মধ্যে রাবড়ি দেয় এবং ওপর থেকে খানিকটা ঘন ক্ষীর ছড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে সার্ভ করে ।
কাশী-বিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা মন্দিরে
সন্ধ্যেবেলায় যাওয়া হল কাশীবিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা মন্দিরে পুজো দিতে । ফেরার পথে রাস্তার ধারে ফুটন্ত গরম দুধ এবং রাবড়ি খাওয়া হল । তারপর বেনারসী পান ।
সারনাথ
পরদিন সকালে অটো চড়ে সোজা সারনাথ । বুদ্ধ যেখানে প্রথম বাণী প্রচার করেছিলেন । তাই সারা বিশ্বের সকল দেশ যেমন জাপান, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা থেকে বহু মানুষের ভীড় দেখলাম সারনাথে । পরিচ্ছন্ন শহর সারনাথ । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে সারনাথ এবং তার সংলগ্ন মিউজিয়ামটি একটি দ্রষ্টব্য স্থান ।
মণিকর্ণিকা
বেনারসে গঙ্গার তীরে অন্যতম ঘাট হল মণিকর্ণিকা এবং তার সংলগ্ন মহা শ্মশান । এখানে চিতার আগুণ কখনো নেভে না । চব্বিশ ঘন্টা জ্বলতেই থাকে । ঘাটে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম বেল, আম প্রভৃতি গাছের শুকনো গুঁড়ি সারেসারে রাখা রয়েছে স্তুপাকারে । আর দূর থেকে ভেসে আসছে সেই শবপোড়া গন্ধ । জ্বলছে লাল চিতা । এখানে মৃত্যু হলে নাকি পরলোকযাত্রা হয় আত্মার । তাই বুঝি পূর্বে কাশীবাসী হতেন অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে । মৃত্যু এখানে মঙ্গলময়ের চরণে ঠাঁই দেয় আত্মাকে । তাই মণিকর্ণিকা মহাশ্মশান একটী পুণ্যতীর্থ । এখানে সতীর কুন্ডল এবং মহাদেবের মণি পড়েছিল দক্ষযজ্ঞের সময় । তাই মণিকর্ণিকা একটি একান্ন পিঠের অন্যতম পিঠস্থান । সতীর অপূর্ব মন্দিরটি এখন গঙ্গার জলে অনেকটাই নিমজ্জিত । কিন্তু উপরের অংশটী এখনো দৃশ্যমান । মণিকর্ণিকার ঘাট থেকে নৌকো চড়ে দীপবলীর ভূত চতুর্দশীর রাতে মাঝ গঙ্গায় গিয়ে গঙ্গারতি দেখলাম । নৌকোয় ভাসমান হয়ে লাইভ কীর্তন-ভজন কনসার্টের সাথে আরতি দেখিনি কখনো । নৌকো থেকে গঙ্গার জলে পদ্মপাতায় ফুলের ভেলায় দীপ জ্বেলে ফুল-আলোর ছোট্ট নৌকা ভাসিয়ে মা গঙ্গার পুজো দিলাম । সারে সারে অগণিত ভক্তের ভাসানো আলোর ভেলা নিয়ে তির তির করে প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পুণ্যতোয়া গঙ্গার বুকে দক্ষিণ থেকে উত্তরে ।
No comments:
Post a Comment