Friday, February 15, 2013

একটি প্রাগৈতিহাসিক চিঠি, ভীমবেটকার গুহা থেকে...


সেই গুহায় থাকত একদল আদিম মানুষ । সে প্রায় আন্দাজ দু'লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কোনো এক জায়গায় কোনোও এক বানর জাতীয় প্রাণী চতুষ্পদের কুব্জতা ছেড়ে দুপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মানব জাতিতে তাদের উত্তরণ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল।
সেই দ্বিপদ মানুষ আফ্রিকা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ছড়িয়ে পড়ে অধুনা ইউরোপ, এশিয়া এবং আমেরিকার দিকে । হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট থেকে জানা যায় যে এই জাতির একটি শাখা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে ভারতবর্ষের মাঝখান দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়া অতিক্রম করে আলাস্কার মধ্যে দিয়ে আমেরিকা প্রবেশ করে । কল্পনা করতে অসুবিধা হবেনা যদি আমরা ভাবি যে এই শাখার জনা কয়েক সদস্য ভারতবর্ষ অতিক্রম করার সময় বিন্ধ্য পর্বতের নিকটবর্তী অধুনা "ভীমবেটকা" নামক স্থানে কিছু অসাধারণ গুহা দেখে থমকে গিয়েছিল । তারা ভেবেছিল থাক আর সুদূর আমেরিকায় না গিয়ে ঐ স্থানেই ঘর-গেরস্থালি পাতা যাক । ১ লক্ষ বছর আগে থেমে যাওয়া জনৈক আদিম মানবের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের প্রথম জনপদ না হলেও শৈলাশ্রয় বা যাকে বলে রক-শেলটার । প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই ১লক্ষ বছরকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন : নিম্নপ্যালিওলিথিক যুগ ( ১০০০০০ - ৪০০০০ বছর ), মধ্য প্যালিওলিথিক যুগ ( ৪০০০০-২০০০০ বছর) , উচ্চ প্যালিওলিথিক (২০০০০-১০০০০ বছর) এবং মেসোলিথিক যুগ ( ১০০০০-২৫০০ বছর)


মেসোলিথিক যুগ আমাদের পৌঁছে দেয় আমাদের অতি পরিচিত ঐতিহাসিক যুগে। যার খবর আমরা ইতিহাসের পাতায় অনেক পড়েছি। কিন্তু আজকের কাহিনী পাঠককে পৌঁছে দেবে সেই আক্ষরিক অর্থের প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে যখন প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক যুগের সন্ধিক্ষণে যখন মানুষ প্রথমবার আহার, আশ্রয় এবং মৈথুন এর চিন্তা অতিক্রম করে সৃজনশীলতার বাতায়নে ভাসিয়ে দিল তার গা । ভাষার সফিষ্টিকেশন হয়ত তখনো হয়নি কিন্তু ক্ষুন্নিবৃত্তির অবকাশে সে তার মনের কথা দেওয়াল লিখনে রূপান্তরিত করে নিজের পারিপার্শ্বিক জনজীবনের ও দৈনন্দিন কর্মজীবনের একটা রেখাচিত্র ফুটিয়ে তুলল যা আজকে দশ হাজার বছর পরেও আমরা জানতে পারি ভীমবেটকার বিখ্যাত গুহাচিত্র বা রক-আর্ট রূপে ।

ভারতবর্ষের মানবসভ্যতার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ১৯৫৭-১৯৫৮ এ কে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন ডাঃ ভি এস ওয়াকাঙ্কার । প্রায় ৪০০টি চিত্রাঙ্কিত গুহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভীমবেটকার গভীর জঙ্গলে । এবং এই শৈলাশ্রয়গুলিকে এর প্রাচীনত্ব এবং মানব ইতিহাসে এর তাত্পর্য স্বীকার করে UNESCO তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ তো হল তত্ত্বকথা । আশ্চর্য বিষয় এই যে আজো একবিংশ শতাব্দীতে বিশাল এই গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে এবং গুহার দেওয়ালের চিত্রগুলি দেখলে মনে হয় আমরা আবার ফিরে গেছি সেই ১০০০০বছর পূর্বে যখন গৃহস্বামী শিকার করে কুলায় ফিরেছেন এবং "গৃহবধূ"সেই শিকারের মাংস আগুণে ঝলসাচ্ছেন ও অন্য কেউ হয়ত সেই অবকাশে গুহার দেওয়ালে মেলে ধরছে তার সৃজনশীলতা। স্থান মাহাত্ম্যের দাপটে গায়ে কাঁটা দেয় ।

পেশাদারি প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ভীমবেটকায় পাওয়া পাথরের অস্ত্র, প্রাগ্‌ঐতিহাসিক কঙ্কাল, ভস্মচূর্ণ এবং মৃত্পাত্রের টুকরো নিয়ে অনেক গবেষণা করে ১লক্ষ বছরের কাহিনী তৈরী করেছেন । কিন্তু আমাদের মত আপামর জনসাধারণের কাছে ভীমবেটকার মাহাত্ম্য হল তার গুহার দেওয়াল চিত্রণ। এখনো যা ঐতিহ্যের সাথে বর্তমান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । সময়ের দলিল বলছে যা পুরাতন । কালের স্রোত যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি । মুছে যায়নি সেই সব গুহাচিত্রের রং । অজানা কোন রঙে তুলি ডুবিয়ে আঁকা সেই গুহারা । আজকের মোটিফ রূপে যা পাঞ্জাবী, শাড়িতে আমরাও দেখি সেই লোকচিত্রের সারল্য নিয়ে স্বমহিমায় ভীমবেটকার গুহাচিত্রেরা অমলিন। যে গুহাচিত্রগুলি এখনো বর্তমান সেগুলির কাল নির্ণয় করে দেখা যায় যে সম্ভবতঃ ৯ হাজার বছর (মেসোলিথিক যুগ)থেকে ২৫০০বছর আগে অবধি এইগুলি আঁকা হয়েছিল । অতএব এই গুহাচিত্রগুলি ভারতবর্ষের মানব সভ্যতার ৬৫০০ বছরের দলিল । এই সাড়ে ৬ হাজার বছরের মানবজাতির যা চিন্তার পরিবর্তন হয়েছিল চিত্র অঙ্কনের প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছিল এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল তারও নজির রয়ে গেছে ভীমবেটকার এই দেওয়ালে । ছবির বিষয়বস্তু প্রথমে ছিল পশুপাখীর । পরে তার সাথে জুড়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুর অবয়ব । তার ও পরে পশুর সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ, পশুর পিঠে মানুষের আরোহণ ইত্যাদি । আবারো দেখা গেল কিছু তদানীন্তন সামাজিক পটভূমি । ঘোড়ায় চড়া ও মাথায় ছাতা নেওয়া রাজার ছবির অপূর্ব চিত্র যা এখনো নজর কাড়ে । এছাড়াও রয়েছে জ্যামিতিক নকশাচিত্র এর থেকে বোঝা যায় যে কালের আবর্তনে সমাজ কিভাবে পাল্টে গেছে ।

কিছু কিছু ছবিতে শিকারের দৃশ্য ও নৃত্যরত মানব মানবীর দেহ লক্ষ্য করা গেল । মজার ব্যাপার হল এই মানব মানবীর আঁকার ধরণটির সাথে এখনকার সাঁওতাল ও তফশিলী উপজাতির পুজোর সময় গৃহ অলঙ্করণের দেওয়াল চিত্রের বেশ ভালরকম মিল পাওয়া যায় । ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন এই ভীমবেটকা । সাড়ে ছ'হাজার বছরের বিবর্তনে ছবির বিষয়বস্তু যেমন বদলে গেছে ঠিক তেমনি পাল্টেছে ছবি আঁকার পদ্ধতি, ব্যবহৃত রঙ ও সরঞ্জাম। ভীমবেটকার গুহাচিত্রে তিন ধরণের ছবি দেখা গেল । যা এখনকার ভাষায় জল রং, তেল রঙ এবং শুকনো মোম রং। বেশীর ভাগ ছবি সাদা ও লাল রঙে আঁকা । কিন্তু কিছু কিছু সবুজ, কমলা, হলদে ও বেগুণী । এই সব রং, রঙ করার পদ্ধতি এবং ছবির বিষয়বস্তু দিয়ে ভারতের যে ইতিহাস ফুটে ওঠে তাতে একটি অসাধারণ ইঙ্গিত আছে । সম্ভাব্য ৫০০০ বছরের পূর্বে কোনো ছবিতে ঘোড়া জাতীয় কোনো পশু দেখা যায় না । এই থেকে মনে হয় যে ৫০০০ বছর আগে যখন আর্য সভ্যতা ভারতে প্রবেশ করে সেই সময় থেকেই দেশে ঘোড়া আমদানী হয় ।
মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের ৪৫ কিমি উত্তর পূর্বে ও হোসাঙ্গাবাদের ৩০ কিমি উত্তর পশ্চিমে, ওবাইদুলাগঞ্জ-ইটার্সি হাইওয়ের ( NH 69)ধারে ভীমবেটকার বিশাল জঙ্গল। দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপকণ্ঠে, বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমানার গা ঘেঁষে, মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার রাতাপানি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংক্চুয়ারির মধ্যে, একটি রুক্ষ এবং নীচু পাহাড়ী অঞ্চল জুড়ে ভীমবেটকার ব্যাপ্তি। ভীমবেটকার পর্ণমোচী (ডেসিডুয়াস) জঙ্গলমহল পাহাড় প্রকৃতির রুক্ষতাকে ঢেকে দিয়েছে অনেকটাই । ভীমবেটকার গা ঘেঁষে ভিয়ানপুর গ্রাম। ভীমবেটকার পাহাড়গুলি সমুদ্র লেভেলের ৬০০ মিটার উঁচুতে ।
নিঝুম সন্ধ্যায় বনমোরগ, কোয়েল, হুপো, শালিখ আর মাছরাঙারা দলে দলে এসে আশ্রয় নেয় ভীমবেটকার গুহার মধ্যে । পাইথন, কোবরা ও আপনমনে ঘোরে হেথায় হোথায় । মেঘ ডাকলে ময়ূর পেখম তুলে ময়ূরীর সাথে শৃঙ্গারের বার্তা পৌঁছে দেয় । আছে শ্লথ বেয়ার, হায়না, নীলগাই, চিতল হরিণ আর সজারু । গ্রামের মানুষ আর পশুপাখীর জন্য আছে বেতোয়া আর নর্মদা নদীর জল । মিডিয়াম আকৃতির দানা দানা স্যান্ড স্টোনের এই পাহাড় গুলির অনেকটাই মেটামরফোসিস হয়ে অর্থকোয়ারজাইট পাথরে রূপান্তরিত হওয়ায় দুধ সাদা রঙে হালকা গোলাপী ছোঁয়া এসেছে । ভীমবেটকার ঘন জঙ্গল সংলগ্ন উপত্যকায় ঘন জঙ্গলে বসন্তে পলাশের আগুন জ্বলে । মহুয়া ফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করে । এত প্রত্যন্ত পরিবেশে পশুপাখী, ডেসিডুয়াস বৃক্ষরাজি আর পাহাড়মাটির এই একাত্ম ইকোসিস্টেম ভীমবেটকার পরিবেশকে একটা অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে । প্রকৃতির খেয়ালে পাহাড় যেন কথা বলে ওঠে এখানে । এক একটি পাহাড়ের আকৃতি এক একরকম । সয়েল ইরোশানের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এগুলি । প্রাগ ঐতিহাসিক যুগে যখন মানুষ ছিলনা তখন এই পাহাড় ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি । তখন জলের খরস্রোতে তৈরী হয়েছিল গুহাগুলি । এবং কালের আবর্তনে সেই পাহাড় যখন সমুদ্র থেকে উঠে হিন্দুস্তানের মধ্যিখানে পৌঁছে যায় তখন আদিম মানুষ সেই গুহা আবিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করে আর আপনমনে মেলে ধরে তাদের সৃজনশীলতা যার ফলস্বরূপ আজো আমরা দেখতে পাই এই গুহাচিত্রগুলি। কোনোটি রচনা করেছে গুহার মধ্যে অডিটোরিয়ামের মত নিস্তব্ধ এম্বিয়েন্স । একখানা পাহাড় বিশাল কচ্ছপের মত আকৃতি নিয়ে মহাস্থবির জাতকের মত আবহমান কাল ধরে পাহাড়ের মাথায় বসে সব কিছু দেখে চলেছে । সৃষ্টি হয়েছে মাশরুমের মত একখানা দৈত্যাকার পাহাড় । এমন কত যে আকৃতি তা দেখে শেষ করা যায় না । কিন্তু সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হল গুহাচিত্র । বিশাল একখানা জু-রক রয়েছে যার ভেতরে আপন খেয়ালে বহু যুগ ধরে বহু মানুষ এঁকে গেছে একপাল পশুর রেখাচিত্র । কোনো ছবিতে ঘোড়সওয়ার নিয়ে চলেছে একপাল যোদ্ধা । কোনোটিতে কেউ এঁকে রেখেছে ১৯খানা মোষের প্রতিকৃতি। কোথাও আবার হাতীর পাল কিম্বা ছুটন্ত হরিণের সার । কেউ এঁকে রেখে গেছে ঘোড়ার পিঠে বাজনদার এবং নৃত্যরত মানুষ। কোনটিতে রাখাল বালক একপাল গবাদি পশুকে সামলাচ্ছে । এইভাবে জল, আর হাওয়ার দাপটে যুগ যুগ ধরে ভীমবেটকার গুহা গুলি বাঁচিয়ে রেখেছে এই দুষ্প্রাপ্য গুহাচিত্রগুলিকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাকে ছুঁতে পারেনি এবং ভ্যান্ডালিজম যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি ।


কথিত আছে পঞ্চপান্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় এইখানে বাস করেছিলেন । আর ভীমবেটকার সংলগ্ন লাক্ষাজুহার জঙ্গলে পান্ডবদের দুর্যোধন পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে লাক্ষা নির্মিত গৃহ সকৌশলে নির্মাণ করেন । মহাভারত ছিল এবং থাকবে । আজ এই কিংবদন্তী সত্য কি মিথ্যা তা আমরা যাচাই করার কেউ ন‌ই । আমাদের কাছে বহু প্রাচীন এবং প্রাগঐতিহাসিক ভারতের রূপরেখা নিয়ে ভীমবেটকা অতীতের সব ঝড়ঝাপটা সামলেও স্বমহিমায় বর্তমান ।




আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০১২ 

1 comment: