Monday, February 11, 2013

সৌন্দর্য্য আর ভালোবাসার মান্ডু

প্রতিধ্বনি শুনি আমি......

 

বিন্ধ্যাচলে ২০০০ ফুট উচ্চতায়, মালওয়া প্লেটোর, ধর জেলায় অবস্থিত মান্ডু । পাথরের স্থাপত্যের অভাবনীয় উত্কর্ষের চরম উদাহরণ মান্ডু। যার মধ্যে মিশে আছে জীবন, সম্ভোগ, আনন্দ, যৌবন এবং ভালোবাসার কাহিনী । পাথরের নিপুণ শৈলী দেখলে মনে হয় মানুষ কি না পারে ! মান্ডুর রাজপ্রাসাদ এবং প্রতিটি মহল দেখলে বোঝা যায় তার বিশালতা এবং রাজকীয়তা । এখনো মধ্যপ্রদেশের মালওয়ার চারণকবিরা গেয়ে থাকেন কবি এবং রাজপুত্র বাজ বাহাদুর আর তার হিন্দুরাণী রূপমতীর প্রণয় গাথা । আফগান স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন এই মান্ডু । মুঘল সম্রাটদের আরামের শৈলশহর ছিল পাহাড়ের অলঙ্কার এই মান্ডু । সমতল থেকে উঁচুতে, মালভূমির শীর্ষদেশ জুড়ে লেক, রাজপ্রাসাদ, উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর সব মিলিয়ে মান্ডুদুর্গ এক অনন্য ট্যুরিষ্ট ঠিকানার জায়গা করে নিয়েছে । আজো সেই রাজমহলগুলির ভেতরে প্রবেশ করলে হয়ত শুনতে পাওয়া যাবে রাজকীয় সেই সোনাটা । ভুলভুলাইয়ার মত প্রাসাদে হারিয়ে গেলে অন্ধকারে শোনা যেতে পারে উতসবের রাতে কোনো রাজনর্তকীর বিছুয়ার অণুরণন । আর পাথরের দেওয়ালে কান পাতলে হয়ত বা পাথর শোনাতে পারে রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের রোম্যান্সের টুকরো গসিপ । মালওয়ার পারমার শাসকদের আদি রাজধানী ছিল মান্ডবগড় বা মান্ডু । ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে খিলজিদের আক্রমণে মান্ডু তাদের দখলে চলে যায় ; আফগান গভর্নর দিলাওয়ার খান গৌরী মান্ডুতে তার রাজধানী স্থাপন করেন । তারা প্রথমেই মান্ডুর নামকরণ করেন "শাদিয়াবাদ" বা "সিটি অফ জয়"
আমরা ভোপাল থেকে ইন্দোর গিয়েছিলাম । সকাল সকাল ইন্দোর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম মান্ডুর পথে । ইন্দোর থেকে মান্ডুর দূরত্ব ৯৮ কিমি । পুরো মান্ডু ভালো করে দেখতে সারাদিন সময় লেগে যাবে ।
মান্ডুর কাছাকাছি পৌঁছতেই চোখে পড়তে লাগল দূরে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে পুরোণো ছোট বড় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। বুঝলাম মান্ডু এসে গেছে । পেরোতে লাগলাম বিখ্যাত বারটি প্রবেশদ্বার গুলি । যার মধ্যে নাম করতে হয় আলমগীর এবং ভাঙ্গি দরোয়াজার । এছাড়াও রয়েছে রামপল দরোয়াজা, জাহাঙ্গীর গেট এবং তারাপুর গেট । গাড়ী করে চলতে লাগলাম দিল্লি দরোয়াজার মধ্য দিয়ে। কি প্রকান্ড গেট ! সুদূর অতীতে পাহাড়ের মাথা বেয়ে যে বিরাট প্রাচীর ছিল সেই প্রাচীরকে লঙ্ঘন করার জন্যই এই বিরাট বিরাট দরোয়াজা । প্রবেশ করলাম ১২০ মিটার লম্বা জাহাজ মহলে। এর মধ্যে দুটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে যাদের নাম "মুঞ্জ তালাও" "কাপুর তালাও" । সুলতান গিয়াসুদ্দিন খিলজীর হারেম ছিল এই জাহাজ মহল । এই জাহাজ মহলের টেরেস থেকে পূর্ণিমার মোম জোছনায় চোখ ভিজিয়ে দেখলে পুরো মান্ডু রাজপ্রাসাদের ফোর্ট, সমাধি, প্রাসাদ এইসবকিছুর রেখাচিত্র নিয়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি হতে পারে । এই দ্বিতল বিশাল প্রাসাদের টেরেসে দাঁড়িয়ে দুপাশে দুটি লেকের জলে তাকালে মনে হবে একটি জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি । এই দুই লেকের জলে নোঙর করা জাহাজমহল থেকে নেমে ঘুরে দেখা হল মান্ডুর মিউজিয়াম যেখানে দেখতে পেলাম রাজপ্রাসাদের অনেক ধ্বংসাবশেষ, মাটি থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্বিক অবশেষ, দেবদেবীর মূর্তি এবং চীনামাটির বাসন কোসনের টুকরো ।
এবার যাওয়া হল হিন্দোলা মহল দেখতে । এটি একটি অডিয়েন্স হল বা দেওয়ানি দরবার সমতুল্য । স্লোপিং দেওয়াল এবং পিলারের কারসাজি দেখে বিভ্রান্ত হতে হয় । দেখে মনে হয় দোদুল্যমান এই মহলটি । তাই বুঝি এমন নাম । স্যান্ড স্টোনের কি অপূর্ব কাজ !
জাহাজমহল ও হিন্দোলামহল ঘুরে এবার যাওয়া হল হোসং শাহের সমাধিক্ষেত্র দেখতে । মার্বেলের তৈরী সূক্ষ আফগান স্থাপত্য । সেখান থেকে যাওয়া হল জামি মসজিদ যেটি কিনা দামাস্কাসের বিখ্যাত মসজিদের অণুকরণে বানানো । দেখা হল রেওয়া কুন্ড । যেটি একটি জলাধার বাজ বাহাদুর বানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী রূপমতীর জন্য । এবার আমাদের গন্তব্য বাজবাহাদুরের প্রাসাদ এবং রূপমতী প্যাভিলিয়ন ।
হোসং শাহের আমলে মান্ডু তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ঐশ্বর্যে খ্যাতি লাভ করে । অনেক হাত বদলের পর ১৫৫৪ সালে বাজ বাহাদুর ক্ষমতায় আসেন । বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান । সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অকুন্ঠ ভালবাসা । কুমারী রূপমতী ছিল এক অতি সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের অসাধারণ রূপসী তনয়া । তার গলার স্বরে ছিল এক অনবদ্য মিষ্টতা যা আকৃষ্ট করেছিল বাজ বাহাদুরকে । একদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন বাজবাহাদুর । বাগাল, রাখাল বন্ধুদের সাথে রূপমতী গান গেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনে । সুলতান তাকে দেখে তার সাথে রাজপুরীতে যেতে বললেন এবং তাকে বিয়ে করবেন জানালেন । রূপমতী একটি ছোট্ট শর্তে সুলতানের রাজধানী মান্ডু যেতে রাজী হলেন । রূপমতী রাজার প্রাসাদ থেকে কেবলমাত্র নর্মদা নদীকে দর্শন জানাবার বাসনা জানালেন । বাজ বাহাদুর সম্মত হলেন । সুলতান তার হবু বেগম রূপমতীর জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতী প্যাভিলিয়ন এবং যার ওপর থেকে রূপোলী সূতোর এক চিলতে নর্মদাকে রোজ দর্শন করে রাণী তবে জলস্পর্শ করতেন । নর্মদা ঐ পথে এঁকে বেঁকে পশ্চিম অভিমুখে আরবসাগরে গিয়ে পড়েছে । রাণীর জন্য তৈরী হল পুণ্যতোয়া নর্মদার জলে রেওয়া কুন্ড । হিন্দু এবং মুসলিম উভয় রীতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন হল তাদের কিন্তু পরিণতি সুখকর হলনা । মোঘল সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে অধম খানকে মান্ডুতে পাঠালেন শুধুমাত্র মান্ডু দখল করতেই নয় রূপমতীকে ছিনিয়ে আনতে । বাজ বাহাদুরের ছোট্ট সেনাবাহিনী পারবে কেন সম্রাট আকবরের সেনাদের সাথে ? বাজ বাহাদুর ভয়ে চিতোরগড়ে পালিয়ে গেলেন রাণীকে একা ফেলে রেখে । রূপমতী সেই খবর পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । সুলতান লিখতেন কবিতা । রাণী গাইতেন গান । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক রূপকথার ভয়ানক পরিসমাপ্তি ঘটল । এখনো রূপমতী প্যাভিলিয়নে হয়ত বা ঘুরে বেড়ায় রূপমতীর অতৃপ্ত আত্মা । চুপকথার চিলেকোঠায় চামচিকেরা আজো শুনতে পায় তার পায়ের নূপুরের শব্দ । দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ যার নাম মেহবুবা । এখনো রাজপ্রাসাদের মধ্যে সেই ক্যানাল দিয়ে কলকল করে জল বয়ে চলেছে অবিরত । নর্মদাও রয়ে গেছে আগের মত শুধু রূপমতীই পারলেন না এই মহল ভোগ করতে ।
এবার গেলাম বাজ বাহাদুরের প্রাসাদ দেখতে । পাহাড়ের স্লোপে এক সুন্দর নৈসর্গিক পটভূমিতে দন্ডায়মান এই প্যালেস । পাঠান বা আফগান প্রাসাদের মতসুন্দর বাগান, লন সবকিছুর মধ্যে রাজপ্রাসাদ । অভিনব তার স্থাপত্য । দুটি দরবার রয়েছে ভেতরে । সম্ভবত দেওয়ানি আম এবং দেওয়ানি খাসের আদলে । বাইরে দুটি অভূতপূর্ব বারান্দা রয়েছে যেখান থেকে পুরো মান্ডুর সৌন্দর্যের আস্বাদ বুঝি গ্রহণ করতেন সুলতান । প্রধান প্রবেশ দ্বারে খোদিত পার্সি লিপি বহন করছে সেই সময়ের দলিল অর্থাত । এবার ফেরার পালা । সূয্যি তখন আকাশের গায়ে মুখ লুকোতে যাবে । তাড়াতাড়ি আমরা পৌঁছলাম নীলকন্ঠ মন্দিরে যা আগে ছিল নীলকন্ঠ প্রাসাদ । নাম শুনেই বোঝা গেল শিব মন্দির । আশ্চর্য হলাম মুসলিম রাজত্বে শিবমন্দিরের অক্ষয়, অব্যয় চেহারা দেখে । গাইডকে জিগেস করতে তিনি দেখালেন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অক্ষত একরাশ পার্সি লিপি । জানলাম সম্রাট আকবরের গভর্ণর নাকি স্থাপন করেছিলেন এই মন্দির । শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে । নর্মদা থেকে জল এসে পড়েছে ঐ লিঙ্গের ওপরে । এমনভাবেই তৈরী ঐটি । পাহাড় থেকে নীচে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে যেতে হয় । বাঁদরের বড় উত্পাত ভেতরে । আর দেখলাম মন্দির থেকে জল শোধনের আশ্চর্য্য ব্যবস্থা । পাথরের আঁকিবুঁকির এক প্রণালীর মধ্য দিয়ে ব‌ইতে ব‌ইতে প্রবাহিত জল ধূলিকণা মুক্ত হয়ে সবশেষে বিশুদ্ধ হচ্ছে অবিরত ।
মান্ডু দেখা শেষ হল কিন্তু গাইডের বলা রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প লেগে রয়ে গেল কানে । কিছুটা প্রতিধ্বনি, কিছুটা উদ্বায়ী আবেগ, কিছুটা এলোমেলো চিন্তার জটে সেই কাহিনী হোটেলে ফিরে এসে লিপিবদ্ধ করলাম । 
 

কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে ইন্দোর গিয়ে গাড়ি নিয়ে মান্ডু যাওয়া যায় । ইন্দোর থেকে মান্ডু যেতে দুঘন্টা সময় লাগে ।
কোথায় থাকবেন : মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের রেসর্ট ছাড়াও অনেক হোটেল আছে মান্ডুতে । এছাড়া ইন্দোরে হোটেলে থেকেও মান্ডু ঘুরে ফিরে যাওয়া যায়
কখন যাবেন: গরমে প্রচন্ড গরম এখানে তাই জুলাই থেকে মার্চ হল আদর্শ সময় 

সানন্দা ম্যাগাজিন, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১২  

No comments:

Post a Comment