Friday, February 15, 2013

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে কয়েকদিন....

 ১৭ই মে ২০১২
প্রতিবার পাহাড় না সাগর এই বিতর্কে হেরে যাই আমি । গরমের ছুটির ফাঁদে পা দিলেই হিমালয় টেনে নিয়ে যায় তার কাছে । এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না ।

আমরা তিনজনে দিল্লী থেকে আবার শ্রীনগরের উড়ানে ।


ভূস্বর্গ কাশ্মীর কে তুলনা করা হয় ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে । কয়েকদিনের জন্যে না হয় তোলা থাক সে তুলনা । সুইস আলপ্‌সের স্মৃতি তোলা থাক এলবামে । ওরে হিমালয় যে আলপ্‌সের চেয়ে কিছু কম নয় ...এই বলতে বলতে এগিয়ে চললাম ফোটোশপড নীল আকাশের দেশে । এমন নীল যে কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি চলল হৃদয়পুরা দিয়ে । 
-->
ঝাউগাছ আর লতানে গোলাপের গুল্মের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বারবার মনে পড়ছিল ওপি নায়ারের কাশ্মীর কি কলির গানের সিকোয়েন্স । 

স্লোপিং রুফের বাড়িগুলো দেখে মনে পড়ে গেল খবরের কাগজের তুষারপাতের কথা । পথে চাপদাড়ি যুবক, বোরখা ঢাকা যুবতী আর মোড়ে মোড়ে সিআর পিএফ জওয়ানদের ভ্যান গাড়ি দেখে অনুভব করলাম কাশ্মীরের প্রতিকূলতা । 

পথে পড়ল রাজবাগ পার্ক । ঝিলামকে দেখলাম একঝলক । একে বলে বিতস্তা । ড্রাইভার মুক্তেয়ার বলল "দরিয়া ঝালেম" । 
-->
ঝিলাম সেতু পেরিয়ে ডাল ঝিলে এলাম আমরা । একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ । 

লেক যে এত বড় হয় আগে কখনো দেখিনি । শিলং এ বড়াপানি লেক দেখেছিলাম, সুইজারল্যান্ডের লুগানো লেক দেখেছিলাম । কিন্তু তাই বলে এত হৈ হৈ হাউসবোটের পসরা আর কূলে কূলে এত শিকারা
 শিকারার সারি বাঁধা ডাল লেকের ধারে.......

 ডালঝিলের মধ্যে ভাসমান পোষ্ট অফিস দেখে যারপরনেই অবাক আমরা !

নেহরুগার্ডেনে অবতরণ গোলাপের বাগানে । একটু ছবি তোলা । 


  নেহেরু গার্ডেন থেকে ডাললেকের প্যানোরমিক লুক  !!!
ডাললেকে ভোরের আলোয় একরকম । 

আবার ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যের ঝুলে তার রূপ অন্যরকম । আবার রাতের বেলা যেন পরী সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঙীন আলোর হাউসবোটের পসরা নিয়ে সেই একই ডাললেক সুন্দরী  ।  

আবার ভাসমান শিকারায় । মাছ খেগো বক, সারস আরো কত কি সেই ডাললেকের জলে ।  

 আশপাশে ভাসমান সবজী বাগানের মধ্যে দিয়ে লিলিপুলের মধ্যে দিয়ে । 

 হাউসবোটের রোয়াক ঘেঁষে । 

১৮ই মে ২০১২ 

শ্রীনগরের ডাললেকের ধারে হোটেলের কামরা থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শব্দে ঘুম গেল ভেঙে । মেঘ না মৌসুমী ? কাঁচের জানলায় অন্ধকারের থাবা । ভূস্বর্গ বৃষ্টিস্বর্গে পৌঁছে গেল না কি ! মনখারাপের পার্টির শুরু । জানলার ভারী পর্দা সরিয়ে দেখি কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে । 

প্রথমে টুথব্রাশ তারপর চায়ের কাপ হাতে আমি চোখ রেখেছি পাহাড়ের মাথায় । কখনো মেঘ উড়ে গেলে তুষারশিখর মুখ বেরে করছে আবার মেঘের চাদর তার গায়ে । আমাদের মনের চাপা টেনশনে ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ততক্ষণে । রুম হিটার বন্ধ করলাম । হঠাত চানঘর থেকে এসে দেখি রোদ উঠেছে । পাহাড়ের চূড়ো হাসতে শুরু করেছে খিলখিল করে । সবজী পরোটা আর দৈ সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া হল পহেলগামের উদ্দেশ্যে । হালকা ঠান্ডা তখন চিনার বনের মধ্যে । ঝিলামের ধারে ধারে চিনারের এই অভিভাবকত্ব মুঘল আমল থেকে । চিনারকে কেউ কুড়ুল মারতে পারবেনা । এই ইকোফ্রেন্ডলি চিনারকে নিয়ে কাশ্মীরিদের খুব গর্ব । 
এই সেই ঐতিহাসিক চিনার বৃক্ষ । সবুজতায় আর রাজকীয়তায় পূর্ণ !  চিনার পাতা কাশ্মীরের শিল্পকর্মের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত । 

পথে পড়ল পান্থচক । পাথরের সব কারখানা । কারিগরেরা সেখানে খুদে খুদে বানাচ্ছে শিল নোড়া, খলনুড়ি, হামান দিস্তা । কিনে ফেললাম একটা খলনুড়ি । বেশ অন্যরকম দেখতে । এটাই কাশ্মীরের ট্র্যাডিশানাল মশলা পেষার কল ।

লিডারভ্যালির ওপর দিয়ে চলেছি আমরা । মেঘ এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে কখনো ।

টোলবুথে পয়সা ফেলে বেলাবেলি পহেলগামে প্রবেশ করলাম ।

 দাঁড়কাকের কর্কশ স্বর নির্জনতাকে ছাপিয়ে দিল । রাখাল ভেড়ার পাল লয়ে যায় মাঠে । ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে ঘন্টি নেড়ে হাঁটে । হোটেলে পিটস্টপ । মালপত্র রেখেই বিলেটেড লাঞ্চ । তারপরই দরদস্তুর করে ঝিরিঝিরি ঝাউয়ের মাথায় টুপটাপ বৃষ্টি নিয়ে আমাদের ঘোড়ায় চেপে বৈশরণ এডভেঞ্চার । তিনটে জবরদোস্ত ঘোড়া , দুই সহিস আর আমরা তিন মূর্তি । ঘন বাদামী আট বছরের বুলডোজার্, হালকা বাদামী দশ বছরের চেতক আর আমার সফেদ ঘোড়া মাত্র তিন বছরের বাদল । 

বৈশরণ এল বুঝি । পাইনগাছের সারি দিয়ে ঘেরা সবুজ প্রান্তর । দূর দিগন্তে নীল আকাশের পৃথিবী । পৃথিবীর নীচে ঐ প্রান্তর যার নাম সুইত্জারল্যান্ড পয়েন্ট । ছবি তুলে তফাত করা যাবেনা আল্পসের বরফচূড়ো আর হিমালয়ের বরফচূড়োয়। ভিউপয়েন্টও বটে । নো প্লাস্টিক জোন । পরিচ্ছন্ন চা-কফির ঠেক । ঘোড়া থেকে নেমে গরম চায়ে চুমুক । ননস্টপ ডিজিটাল ক্লিকে বন্দী হল ভারতের সুইস পয়েন্ট । 
 পহেলগামে  টিপিক্যাল কাশ্মীরি ডিনার হল এক পথ-হোটেলে । অসাধারণ সুস্বাদু কাশ্মীরি খানা । গরগরে, মশলাদার মাটন গুস্তাবা আর রিস্তা । সাথে গরম রুটি । গ্যাস্ট্রোনমিক আনন্দে উদরপূর্তি । 
 

১৯শে মে ২০১২
পাহাড়চূড়োয় বরফ । বরফচূড়োয় রোদ পড়েছে । মেঘমুক্ত আকাশ । গরমজলে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট আর তারপরেই বেরিয়ে পড়া মেঘমুক্ত আকাশের উদ্দেশ্যে । কখন আবার বৃষ্টির কবলে পড়ে যাই । আজ আমরা গাড়ি নিয়ে আবার লিডার উপত্যকায় বেড়াব । নদীকে ছুঁয়ে দেখব ; তার উষ্ণতায় আজ গরমদেশের মানুষের আহ্লাদে আটখানা হবার । 
 ২০শে মে ২০১২

কাশ্মীর ভ্যালি এল ।

 পৃথিবীর সর্বোচ্চ গল্ফকোর্স । ঠুকঠাক গলফ বল মারছে কোনো খেলাড়ি । গাড়ী সেই গল্ফকোর্স কে পাশ কাটিয়ে আরো আরো পাইন আর দেওদারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছাল মস আর ফার্ণ ঘেরা কাঠের হোটেল ঘরে । 
গুলমার্গ এডভেঞ্চার  শুরু !
২১শে মে ২০১২
গন্ডোলা অভিযান @ গুলমার্গ    ! লাইন দিয়ে গন্ডোলা রাইডের টিকিট কাটা হল । 

 কেবল কার রোপওয়ে দিয়ে উঠবে পাহাড়ের মাথায় । এখানে তাকে বলে গন্ডোলা রাইড । 
২২শে মে ২০১২
সোনমার্গ অভিযান  ! ছুঁতে হবে বরফকে । টবোগানিং ! অনাস্বাদিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি হল । বরফ থেকে গড়িয়ে পড়ার । সেই উঁচু থেকে নীচে ।  
 শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের পথ.....
 আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবার ৪ঠা আগষ্ট ২০১২
২৩শে মে ২০১২ 

ডাল লেকের এক হাউসবোটে বন্দী হলাম আপাততঃ দুদিন, দুরাতের জন্য ।  হাউসবোটের মালিক কাশ্মিরী । তার নিজস্ব হাউসবোটের নাম "হোটেল ক্যালিফোর্ণিয়া" !

 সেই হাউসবোটের ডাইনিং টেবিলে বসে গুগল ম্যাপে খোঁজা হচ্ছে আমাদের হাউসবোটের অস্তিত্ব ।
 রাহুল সেই গৃহ নৌকার মধ্যে ঢুকেই বসে পড়েছে ব্লগ লিখতে..
আমার অন্তরে তখন বাজছে সেই গিটারের সুর... বহুযুগ আগে ঈগলস্‌ এর সেই বিখ্যাত গান ।   
কেশর, আখরোট, শিলাজিত, উইলোকাঠের ক্রিকেট ব্যাট আর কাশ্মিরী কাঠের কারুকার্য , শাল-আলোয়ানের এম্ব্রয়ডারি,  আর পশমিনার সম্ভারে এখানকার মানুষজন অনেক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে রয়েছে । তবে মনে মনে এদের খুব গুমর কাশ্মীর কে নিয়ে, তার ঐশ্বর্য নিয়ে । আর কেনই বা হবেনা ?   

 










Monday, February 11, 2013

সৌন্দর্য্য আর ভালোবাসার মান্ডু

প্রতিধ্বনি শুনি আমি......

 

বিন্ধ্যাচলে ২০০০ ফুট উচ্চতায়, মালওয়া প্লেটোর, ধর জেলায় অবস্থিত মান্ডু । পাথরের স্থাপত্যের অভাবনীয় উত্কর্ষের চরম উদাহরণ মান্ডু। যার মধ্যে মিশে আছে জীবন, সম্ভোগ, আনন্দ, যৌবন এবং ভালোবাসার কাহিনী । পাথরের নিপুণ শৈলী দেখলে মনে হয় মানুষ কি না পারে ! মান্ডুর রাজপ্রাসাদ এবং প্রতিটি মহল দেখলে বোঝা যায় তার বিশালতা এবং রাজকীয়তা । এখনো মধ্যপ্রদেশের মালওয়ার চারণকবিরা গেয়ে থাকেন কবি এবং রাজপুত্র বাজ বাহাদুর আর তার হিন্দুরাণী রূপমতীর প্রণয় গাথা । আফগান স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন এই মান্ডু । মুঘল সম্রাটদের আরামের শৈলশহর ছিল পাহাড়ের অলঙ্কার এই মান্ডু । সমতল থেকে উঁচুতে, মালভূমির শীর্ষদেশ জুড়ে লেক, রাজপ্রাসাদ, উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর সব মিলিয়ে মান্ডুদুর্গ এক অনন্য ট্যুরিষ্ট ঠিকানার জায়গা করে নিয়েছে । আজো সেই রাজমহলগুলির ভেতরে প্রবেশ করলে হয়ত শুনতে পাওয়া যাবে রাজকীয় সেই সোনাটা । ভুলভুলাইয়ার মত প্রাসাদে হারিয়ে গেলে অন্ধকারে শোনা যেতে পারে উতসবের রাতে কোনো রাজনর্তকীর বিছুয়ার অণুরণন । আর পাথরের দেওয়ালে কান পাতলে হয়ত বা পাথর শোনাতে পারে রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের রোম্যান্সের টুকরো গসিপ । মালওয়ার পারমার শাসকদের আদি রাজধানী ছিল মান্ডবগড় বা মান্ডু । ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে খিলজিদের আক্রমণে মান্ডু তাদের দখলে চলে যায় ; আফগান গভর্নর দিলাওয়ার খান গৌরী মান্ডুতে তার রাজধানী স্থাপন করেন । তারা প্রথমেই মান্ডুর নামকরণ করেন "শাদিয়াবাদ" বা "সিটি অফ জয়"
আমরা ভোপাল থেকে ইন্দোর গিয়েছিলাম । সকাল সকাল ইন্দোর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম মান্ডুর পথে । ইন্দোর থেকে মান্ডুর দূরত্ব ৯৮ কিমি । পুরো মান্ডু ভালো করে দেখতে সারাদিন সময় লেগে যাবে ।
মান্ডুর কাছাকাছি পৌঁছতেই চোখে পড়তে লাগল দূরে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে পুরোণো ছোট বড় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। বুঝলাম মান্ডু এসে গেছে । পেরোতে লাগলাম বিখ্যাত বারটি প্রবেশদ্বার গুলি । যার মধ্যে নাম করতে হয় আলমগীর এবং ভাঙ্গি দরোয়াজার । এছাড়াও রয়েছে রামপল দরোয়াজা, জাহাঙ্গীর গেট এবং তারাপুর গেট । গাড়ী করে চলতে লাগলাম দিল্লি দরোয়াজার মধ্য দিয়ে। কি প্রকান্ড গেট ! সুদূর অতীতে পাহাড়ের মাথা বেয়ে যে বিরাট প্রাচীর ছিল সেই প্রাচীরকে লঙ্ঘন করার জন্যই এই বিরাট বিরাট দরোয়াজা । প্রবেশ করলাম ১২০ মিটার লম্বা জাহাজ মহলে। এর মধ্যে দুটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে যাদের নাম "মুঞ্জ তালাও" "কাপুর তালাও" । সুলতান গিয়াসুদ্দিন খিলজীর হারেম ছিল এই জাহাজ মহল । এই জাহাজ মহলের টেরেস থেকে পূর্ণিমার মোম জোছনায় চোখ ভিজিয়ে দেখলে পুরো মান্ডু রাজপ্রাসাদের ফোর্ট, সমাধি, প্রাসাদ এইসবকিছুর রেখাচিত্র নিয়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি হতে পারে । এই দ্বিতল বিশাল প্রাসাদের টেরেসে দাঁড়িয়ে দুপাশে দুটি লেকের জলে তাকালে মনে হবে একটি জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি । এই দুই লেকের জলে নোঙর করা জাহাজমহল থেকে নেমে ঘুরে দেখা হল মান্ডুর মিউজিয়াম যেখানে দেখতে পেলাম রাজপ্রাসাদের অনেক ধ্বংসাবশেষ, মাটি থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্বিক অবশেষ, দেবদেবীর মূর্তি এবং চীনামাটির বাসন কোসনের টুকরো ।
এবার যাওয়া হল হিন্দোলা মহল দেখতে । এটি একটি অডিয়েন্স হল বা দেওয়ানি দরবার সমতুল্য । স্লোপিং দেওয়াল এবং পিলারের কারসাজি দেখে বিভ্রান্ত হতে হয় । দেখে মনে হয় দোদুল্যমান এই মহলটি । তাই বুঝি এমন নাম । স্যান্ড স্টোনের কি অপূর্ব কাজ !
জাহাজমহল ও হিন্দোলামহল ঘুরে এবার যাওয়া হল হোসং শাহের সমাধিক্ষেত্র দেখতে । মার্বেলের তৈরী সূক্ষ আফগান স্থাপত্য । সেখান থেকে যাওয়া হল জামি মসজিদ যেটি কিনা দামাস্কাসের বিখ্যাত মসজিদের অণুকরণে বানানো । দেখা হল রেওয়া কুন্ড । যেটি একটি জলাধার বাজ বাহাদুর বানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী রূপমতীর জন্য । এবার আমাদের গন্তব্য বাজবাহাদুরের প্রাসাদ এবং রূপমতী প্যাভিলিয়ন ।
হোসং শাহের আমলে মান্ডু তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ঐশ্বর্যে খ্যাতি লাভ করে । অনেক হাত বদলের পর ১৫৫৪ সালে বাজ বাহাদুর ক্ষমতায় আসেন । বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান । সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অকুন্ঠ ভালবাসা । কুমারী রূপমতী ছিল এক অতি সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের অসাধারণ রূপসী তনয়া । তার গলার স্বরে ছিল এক অনবদ্য মিষ্টতা যা আকৃষ্ট করেছিল বাজ বাহাদুরকে । একদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন বাজবাহাদুর । বাগাল, রাখাল বন্ধুদের সাথে রূপমতী গান গেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনে । সুলতান তাকে দেখে তার সাথে রাজপুরীতে যেতে বললেন এবং তাকে বিয়ে করবেন জানালেন । রূপমতী একটি ছোট্ট শর্তে সুলতানের রাজধানী মান্ডু যেতে রাজী হলেন । রূপমতী রাজার প্রাসাদ থেকে কেবলমাত্র নর্মদা নদীকে দর্শন জানাবার বাসনা জানালেন । বাজ বাহাদুর সম্মত হলেন । সুলতান তার হবু বেগম রূপমতীর জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতী প্যাভিলিয়ন এবং যার ওপর থেকে রূপোলী সূতোর এক চিলতে নর্মদাকে রোজ দর্শন করে রাণী তবে জলস্পর্শ করতেন । নর্মদা ঐ পথে এঁকে বেঁকে পশ্চিম অভিমুখে আরবসাগরে গিয়ে পড়েছে । রাণীর জন্য তৈরী হল পুণ্যতোয়া নর্মদার জলে রেওয়া কুন্ড । হিন্দু এবং মুসলিম উভয় রীতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন হল তাদের কিন্তু পরিণতি সুখকর হলনা । মোঘল সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে অধম খানকে মান্ডুতে পাঠালেন শুধুমাত্র মান্ডু দখল করতেই নয় রূপমতীকে ছিনিয়ে আনতে । বাজ বাহাদুরের ছোট্ট সেনাবাহিনী পারবে কেন সম্রাট আকবরের সেনাদের সাথে ? বাজ বাহাদুর ভয়ে চিতোরগড়ে পালিয়ে গেলেন রাণীকে একা ফেলে রেখে । রূপমতী সেই খবর পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । সুলতান লিখতেন কবিতা । রাণী গাইতেন গান । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক রূপকথার ভয়ানক পরিসমাপ্তি ঘটল । এখনো রূপমতী প্যাভিলিয়নে হয়ত বা ঘুরে বেড়ায় রূপমতীর অতৃপ্ত আত্মা । চুপকথার চিলেকোঠায় চামচিকেরা আজো শুনতে পায় তার পায়ের নূপুরের শব্দ । দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ যার নাম মেহবুবা । এখনো রাজপ্রাসাদের মধ্যে সেই ক্যানাল দিয়ে কলকল করে জল বয়ে চলেছে অবিরত । নর্মদাও রয়ে গেছে আগের মত শুধু রূপমতীই পারলেন না এই মহল ভোগ করতে ।
এবার গেলাম বাজ বাহাদুরের প্রাসাদ দেখতে । পাহাড়ের স্লোপে এক সুন্দর নৈসর্গিক পটভূমিতে দন্ডায়মান এই প্যালেস । পাঠান বা আফগান প্রাসাদের মতসুন্দর বাগান, লন সবকিছুর মধ্যে রাজপ্রাসাদ । অভিনব তার স্থাপত্য । দুটি দরবার রয়েছে ভেতরে । সম্ভবত দেওয়ানি আম এবং দেওয়ানি খাসের আদলে । বাইরে দুটি অভূতপূর্ব বারান্দা রয়েছে যেখান থেকে পুরো মান্ডুর সৌন্দর্যের আস্বাদ বুঝি গ্রহণ করতেন সুলতান । প্রধান প্রবেশ দ্বারে খোদিত পার্সি লিপি বহন করছে সেই সময়ের দলিল অর্থাত । এবার ফেরার পালা । সূয্যি তখন আকাশের গায়ে মুখ লুকোতে যাবে । তাড়াতাড়ি আমরা পৌঁছলাম নীলকন্ঠ মন্দিরে যা আগে ছিল নীলকন্ঠ প্রাসাদ । নাম শুনেই বোঝা গেল শিব মন্দির । আশ্চর্য হলাম মুসলিম রাজত্বে শিবমন্দিরের অক্ষয়, অব্যয় চেহারা দেখে । গাইডকে জিগেস করতে তিনি দেখালেন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অক্ষত একরাশ পার্সি লিপি । জানলাম সম্রাট আকবরের গভর্ণর নাকি স্থাপন করেছিলেন এই মন্দির । শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে । নর্মদা থেকে জল এসে পড়েছে ঐ লিঙ্গের ওপরে । এমনভাবেই তৈরী ঐটি । পাহাড় থেকে নীচে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে যেতে হয় । বাঁদরের বড় উত্পাত ভেতরে । আর দেখলাম মন্দির থেকে জল শোধনের আশ্চর্য্য ব্যবস্থা । পাথরের আঁকিবুঁকির এক প্রণালীর মধ্য দিয়ে ব‌ইতে ব‌ইতে প্রবাহিত জল ধূলিকণা মুক্ত হয়ে সবশেষে বিশুদ্ধ হচ্ছে অবিরত ।
মান্ডু দেখা শেষ হল কিন্তু গাইডের বলা রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প লেগে রয়ে গেল কানে । কিছুটা প্রতিধ্বনি, কিছুটা উদ্বায়ী আবেগ, কিছুটা এলোমেলো চিন্তার জটে সেই কাহিনী হোটেলে ফিরে এসে লিপিবদ্ধ করলাম । 
 

কিভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে ইন্দোর গিয়ে গাড়ি নিয়ে মান্ডু যাওয়া যায় । ইন্দোর থেকে মান্ডু যেতে দুঘন্টা সময় লাগে ।
কোথায় থাকবেন : মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের রেসর্ট ছাড়াও অনেক হোটেল আছে মান্ডুতে । এছাড়া ইন্দোরে হোটেলে থেকেও মান্ডু ঘুরে ফিরে যাওয়া যায়
কখন যাবেন: গরমে প্রচন্ড গরম এখানে তাই জুলাই থেকে মার্চ হল আদর্শ সময় 

সানন্দা ম্যাগাজিন, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১২  

নববর্ষের চার কল্পতরু

পশ্চিম  মেদিনীপুরের এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে বছর শুরুর দিনে যেতে যেতে  বর্ষবরণ দেখে এলাম । খড়গপুর থেকে হিজলী ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে সালুয়া পেরিয়ে নাক বরাবর কেশিয়াড়ির পথে । সোজা গেলে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ভসরাঘাট না গিয়ে তার আগেই ডান দিকে মোরামের পথ, মাটীর পথ ধরে বহু পুরোণো দুর্গা মন্দির । সর্বমঙ্গলা মন্দির আর কাশীশ্বর জিউ ।
বেলা গড়িয়ে, দুপুর পেরিয়ে, বিকেলের সময় চলেছিলাম পয়লা জানুয়ারির দিন ।
শহরে তখন কত হিড়িক ধুম করে নিউইয়ার পার্টির । কত তোড়জোড় রেস্তোরাঁয়া, ক্লাবে, মাঠে ময়দানে। সার্কাসের তাঁবুতে, চিড়িয়াখানায়, শীতের মেলাপ্রাঙ্গনে তখন মানুষে মানুষে ছয়লাপ । গ্রামের মানুষের মনে সেই নিয়ে কোনো হেলদোল নেই । 
নতুন বছরের প্রথম সূর্যাস্ত তখন রঙ ছড়িয়ে চলেছে আপনমনে । ঠান্ডার দাপটও ছিল বেশ । আর রাস্তায় যেতে যেতে চড়ুইভাতির গন্ধ । তখন বনভোজনের রসুইখানার ঝাঁপ ফেলা হচ্ছে । তারই মধ্যে জোরে মাইকে বেজে চলছে" পরাণ যায় জ্বলিয়ারে "... বড়রাস্তার একপাশে সেন্ট পলস গীর্জায় বর্ষবরণের পার্টির শেষ ঝলক । মাদল বাজছে আর সাথে ট্রাইবাল ডান্স । বিলিভার্স চার্চে নিউইয়ারের ফেস্টুন ।  


সর্বমঙ্গলা মন্দির

খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার গেলে পড়বে ইন্দা বাজারের মোড় । সেখান থেকে পূবদিকে আরো খানিকটা গেলে পড়বে ইন্দা দুর্গা মন্দির আর তারপরই বাঁদিকে খড়গেশ্বরের শিব মন্দির । এই মন্দিরের নামেই এই জায়গার নাম খড়্গপুর । কারো মতে,   রাজা খড়্গসিংহ তৈরী করেছিলেন এই মন্দির । আবার কারো মতে বিষ্ণুপুরের রাজা খড়্গমল্ল ২০০ বছর আগে এই মন্দির তৈরী করেছিলেন ।মন্দিরের অভ্যন্তরে  গর্ভগৃহে প্রোথিত  খড়্গেশ্বর শিবলিঙ্গ  । শিবরাত্রি, আর গাজনের সময উতসব হয় এখানে ।


মন্দির চত্বরে বহু প্রাচীন একটি অশ্বত্থ গাছের বেদীমূলে রয়েছে আদিবাসীদের আরাধ্যা কোনো দেবতার প্রস্তর মূর্ত্তি । দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এই অঞ্চলগুলি প্রধানত:আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ছিল । তবে  এখন সূর্য দেব রূপে ইনি পূজিত হন ।



মন্দিরের নাট মন্দিরে এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে । স্থানীয় মানুষ জন আর মন্দিরের পুরোহিত বিদ্যালয়টি চালনা করেন । মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁরাই করেন আর মন্দিরের মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই স্কুলটি করেছেন তাঁরা ।জটাজুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহু পুরোণো অশ্বত্থ বৃক্ষ আর বহন করছে সময়ের সাক্ষ্য ।পুরো মন্দিরটী তৈরী পাথর দিয়ে । কোনো ইঁট নেই এর গায়ে । এখন সাদা রঙ করা হয়েছে ।


খড়গেশ্বর মন্দির

খড়্গেশ্বরের মন্দির  থেকে আরো কিছুদূর গ্রামের পথ ধরে স্থানীয় মানুষদের জিগেস করতে করতে পৌঁছনো যায় হিড়িম্বেশ্বরী মন্দিরে  ।


 বড় বড় দীঘি পরিবেষ্টিত  ইন্দার এই  গ্রামটির নাম বামুনপাড়া । কথিত আছে মহাভারতে পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাসের সময় ভীম ঘুরতে ঘুরতে  এসে স্থানীয় এক অনার্য নারী হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন  ;এই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলটির নাম ছিল " হিড়িম্বা ডাঙা "    এই অঞ্চলে হিড়িম্বার আরাধ্যা একটি অত্যন্ত জাগ্রত কালীমূর্ত্তি ছিল যা কালাপাহাড়ের অত্যাচারে,   কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ।এখনো গাছের নীচে সেই অতি প্রাচীন পাথরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় আর সেইখানেই বাংলার ১৩৭৫ সালে নতুন করে মন্দির স্থাপন করেন বামুনপাড়ার স্থানীয় মানুষ জন । মন্দিরের মধ্যে ধাতব কালীমূর্ত্তির পাশে শীতলারও ধাতব মূর্ত্তি পূজো হয় ।
 হিড়িম্বেশ্বরী মন্দির
এবার গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্‌ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর অগতির গতি  স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই ।  তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স ।  এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে ।  
তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর  পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে ।
 বর্গভীমা মন্দির

দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন  সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই   মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত । 
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি)  তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম । 
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী ।  মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে ।

মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে  দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে ।  

ছোটবেলায় নিয়ম করে প্রতিবছর দক্ষিণেশরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কল্পতরু উত্সবে সামিল হতাম । ভীড় ঠেলে দর্শন করাতেও কত তৃপ্তি মানুষের! এখন সেটাও খুব মিস করি । মিস করি গঙ্গার ধার, ঠাকুরের মন্দিরের নিরিবিলি নিস্তব্ধতা আর সেই একরাশ অনাবিল শান্তি নিয়ে কল্পতরুর কাছে প্রার্থনা করা । কি যে চাইতাম জানিনা । কিন্তু যেতাম ও সারাবছরের রেসোলিউশান নিয়ে চোখ বুঁজে অনেক ভাবতাম । "এই বছরে, এটা করবনা, সেটা করতে হবে"...আরো কত কিছু !  
নতুন বছরে সর্বমঙ্গলা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী আর বর্গভীমাই আমার কল্পতরু উত্সবে সামিল হলেন । 

ছোটদের ই-পত্রিকা ইচ্ছামতী, শীতসংখ্যা ২০১৩  

লাইমস্টোনেরাও কথা বলে.....


                                               অমরকন্টক
মরকন্টক ঘুরে এসে খুব ক্লান্ত ছিলাম । পরদিন ভোরে উঠে এবার আমাদের যাওয়া লাইমস্টোনের দেশে ।  বিখ্যাত জবলপুর মার্বেল রকস্‌  দেখতে । অমরকন্টকের হোটেলে সুস্বাদু নিরামিষ প্রাতঃরাশে আহ্লাদে উদরপূর্তি হল সুজির উপমা, পরোটা-টক দৈ-আচার এবং আলুর টিকিয়া দিয়ে  । সাথে ধূমায়িত চা এবং উত্তুরে হাওয়ার কনকনানি । প্রথমে যে জায়গাটিতে গেলাম তার নাম ভেরাঘাট ।  জবলপুরের ২২ কিমি দূরে নর্মদা নদী একটি গর্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এখানে । দুধসাদা পাথরের ওপর দিয়ে ঝরণার মত আছড়ে পড়ছে নর্মদার হাসি । ৩০ মিটার উঁচু থেকে নাচতে নাচতে পড়ছে তার জল । মাথার ওপর  দুপুর সূর্য্যি নিয়ে তো দেখছি আমরা । কে যানে পূর্ণিমার রাতে এখানকার নিসর্গ কেমন হয় !  
 ধূঁয়াধার ফলস

নর্মদার সৃষ্ট এই গর্জটির দৈর্ঘ্য ৩ কিমি । মধ্যে মধ্যে যেন উঠে এসেছে লাইমস্টোন বা মার্বেলের পাহাড় ।  দুধসাদা  শ্বেতপাথর অত্যন্ত নরম । আর  তাই বুঝি সেই সফট ষ্টোনকে কেটে কুটে  তা দিয়ে নানারকমের জিনিষ বানিয়ে পণ্য সাজিয়েছে আশপাশের স্থানীয় মানুষ ।   যেতে যেতে  প্রচুর পাথরের পসরা দেখতে পেলাম । 
যেতে যেতে পথে পড়ল গৌরনদী । তারপর ছোট হল্ট বার্গী ড্যামে । 

 বার্গী ড্যাম
দিগন্তরেখা জুড়ে বিশাল বিন্ধ্যরেঞ্জ আর তার কোলে নর্মদার কিছু অংশে এই ড্যাম ।  এবার সোজা ভেরাঘাট পৌঁছলাম । কেবলকারের টিকিট কেটে শূন্য থেকে নর্মদার তাথৈ নাচ দেখতে যাওয়া হল । আমরা কেবলকারের মধ্যে কাঁচের জানলা দিয়ে দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখছি । নর্মদা আমাদের নীচে আমরা লোহার রজ্জুতে গতিময় । 

এখানে নর্মদার নাম ধূঁয়াধার ফলস । সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে পুরো জায়গাটা ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে । সাদা ধুধের ফেনা হয়ে জল পড়ছে গর্জের মধ্যে আর পুরো জায়গাটি ধোঁয়াময় ।একঘন্টায় কেবলকারের রাইডে আসা এবং যাওয়া সম্পূর্ণ হল । এবার নেমে পায়ে হেঁটে নর্মদাকে ছুঁতে যাওয়া । তাকিয়ে দেখি  শ্বেতপাথরের দেওয়ালে অবাককরা রামধনু ! আর আমার গায়ে নর্মদার জলের ছিটে অনবরত ধেয়ে এল ।এবার পঞ্চবটী ঘাটে এসে নর্মদায় নৌকাবিহার ।  মার্বেল রকস দেখতে যাচ্ছি এতক্ষণে । 



 শিবানী নামে একখানা নৌকো পছন্দ করে টিকিট কেটে উঠে পড়া হল । দূরে ১০৮ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় পার্বতী মন্দির । এছাড়াও বিন্ধ্য পাহাড়ের গায়ে শঙ্কর মন্দির, পাঁচপটা মন্দির । নৌকোর মাঝি এমনটি বলল । বেশ মজার মাঝি সে । গানে গানে কবিতায় ছন্দে ভরিয়ে দিল একটা ঘন্টা । স্বরচিত কবিতা  যা কিনা পুরো মার্বেল রকসকে গল্পের মোড়কে হাজির করে চোখের সামনে ।







 সেই নৌকার কান্ডারীর ছন্দময়তায় আমাদের যাত্রাপথের আনন্দ বেড়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল একনিমেষে । হেলছে তরী, দুলছে তরী  ভেসে চলেছে  নর্মদায় ।ছুঁলাম হাত নীচু করে নর্মদাকে । পরেই দেখি পরের নৌকাটির গায়ে একখানা লম্বা জলঢোঁড়া সাপ জল থেকে ওঠার চেষ্টা করছে প্রাণপণে । মাঝি বললে "কিছুতেই উঠতে পারবেনা সে"; সত্যি সত্যি কিছুপরেই সে আবার জলের মধ্যে লাফিয়ে চলে গেল । লাইমষ্টোন্, মার্বেল, ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেটের পাহাড় চলল আমাদের দুপাশে । আমরা যেন ভেসে চলেছি একটা ক্যানালের মধ্যে দিয়ে । আমরা চলেছি বান্দরকুঁদনী ঘাটের দিকে যেখান থেকে লাইমষ্টোনের পাহাড়ের ওপর থেকে লাফে লাফে ঝাঁপ দিচ্ছে বাঁদর আর সেই সাথে রোজগারের আশায় দরিদ্র গ্রামের আদুড় গায়ে গ্রামের ছেলে । কোনো চাহিদা নেই তাদের তুমি যদি বল পয়সা দেবে তবেই সে জোরসে ডাইভ দেবে মাঝ নর্মদায় সেই ওপর থেকে । আর পয়সা হাতে নেয় না সে ছেলে মা নর্মদার কোল থেকে তুলে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে শুকিয়ে নিচ্ছে নোট । এই তার রুজি । মায়ের জন্য করে খাচ্ছে তাই মা'কে এত ভক্তি ! পুব থেকে পশ্চিমে বহতী নর্মদা । মাথার ওপরে কট কটে দূপুর সূর্য । একবার আকাশী মার্বল তো আবার সাদাকালো । কখনো আবার গোলাপী তো কখনো শ্লেট পাথর । ভুলভুলাইয়ার মত জলে র মধ্যে দিয়ে যেতে লাগলাম আর চারপাশের যে দৃশ্য তা ভাষায় বলতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রে র সাহায্য নিয়ে বলতে হয় " আহা! কি দেখিলাম ! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না " ! এবার সবচেয়ে গভীর জল, ৩৫০ ফুট গভীরে । ধারে দেখি মার্বেলপাহাড়ের গায়ে জড়াজড়ি করে পড়ে রয়েছে সাত-আটটা সাপ । এবার খানিক সংকীর্ণ জলপথ । কাছ থেকে পাহাড়কে দেখছি ।  পেছনে গভীর জঙ্গল । পাহাড়ের গায়ে কি বিচিত্র চিত্রকল্প। মাঝির কবিতায় তা আরো স্পষ্ট । ছোট ছেলেমেয়ে একজোড়া,গায়ে জামা-প্যান্ট পরা । আবার কোথাও খাজুরাহের পুতুল তো কোথাও কালভৈরবের কালো মূর্তি । কোথাও আবার পাহাড়ের গায়ে মহাদেবের নন্দীর মত একটা বিশাল ষাঁড় । এবার পাহাড়ের মধ্যে গুহা দেখা গেল । একটা আইল্যান্ড এল । ইন্দোরের মহারাণী স্থাপন করেছিলেন শিবলিঙ্গ । এবার আরো গভীর ৪৫০ফুট । গাঁয়ের ছেলে আদুড় গায়ে মাছ ধরতে  ব্যস্ত। অনেক হিন্দী ছায়াছবির শুটিং হয়েছে এখানে । 


রাজকাপুরের আওয়ারা থেকে রেখার খুন ভরি মাং, যিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় থেকে শাহরুখের অশোকা , রেখা-সুনীল দত্তের প্রাণ যায় পর বচন না যায়  এদের মধ্যে অন্যতম । ভাবছি কোথায়  সেই দ্বীপের ওপর নৃত্যরতা, স্বল্পবসনা রেখাকে কোথা থেকে একটা বিশাল মাছ ঘাই মেরে আমার কল্পনার সূতোগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিল । এতক্ষণে বুঝলাম জলের আঁশটে গন্ধের রহস্য । নৌকোর মাঝি থামেনা । সে অনবরত ছড়া কেটে চলেছে " চাঁদনী রাত মে, ক্যামেরা হাথ মে, ফ্যামিলি সাথ মে আউর  কেয়া? আপ বলিয়ে জি! সে পরখ করছে আমরা মন দিয়ে তার কবিতা শুনছি কি না । আমার মা জোড় হাতে নর্মদাকে প্রণাম করে বলে উঠলেন
" নর্মদে শর্মদে নিত্যং পাপতাপবিনাশিনী, শংকর স্বেদসম্ভূতে সনাতনী নমোহস্তুতে " 
এবার চেয়ে দেখি কতকত মৌচাক লাইমষ্টোনের ওপরে বাসা বেঁধেছে মনের সুখে ।


এইভাবে নর্মদা বয়ে চলেছে আবহমান কাল ধরে সাতপুরা আর বিন্ধ্যর মাঝখান দিয়ে । দূরে শঙ্করকুন্ড আর বাণকুন্ড যেখানে জল গিয়ে পড়ছে আর অবিরত সৃষ্টি করে চলেছে প্রাকৃতিক উপায়ে শিবলিঙ্গ । নদী যেখানে গভীর সেখানে তার জল তত শান্ত আর গভীরতা কমে যায় আর তার স্রোতস্বিনী নাম সার্থকতা পায় । দূর থেকে মাঝি দেখাল বগলামুখী আর ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির । আমরা কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেল কবিতার মাঝদরিয়া । একঘন্টা পেরিয়ে ঘাটে এসে নৌকা খানা ভিড়ল ।  চেয়ে দেখি শ্বেতপাথরের মূর্তি, গয়না আর থালাবাটির পসরা ।


 আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিম দিনাজপুর,  রবিবারের ক্রোড়পত্র ৬ই জানুয়ারি ২০১৩