Thursday, April 4, 2013

তমলুকের শক্তিপিঠ দেবী বর্গভীমায়




আমরা সেদিন হঠাত বেরিয়ে পড়েছিলাম পাঁচজনে । গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্‌ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর অগতির গতি স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স । এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে । সেদিন ছিল শ্রাবণের আধো আলো আধো ছায়ায় মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের একটা ছুটির দিন ।

কোলকাতা মুম্বাই রোড ধরে ন্যাশানাল হাইওয়ে সিক্সের ওপর দিয়ে কোলাঘাট । কোলাঘাট থেকে হলদিয়া হাইওয়ে ধরে দীঘার রাস্তা ধরালাম । রোদবৃষ্টির খেলা চলল সাথে । সবুজ ক্ষেত, শ্রাবণী বনানীতে এবার বর্ষা অধরা । বৃষ্টিতে এদের সজীবতা আরো প্রকট হয় । কিন্তু এবার এদের শ্যামলতা কিছুটা নিষ্প্রভ । ধান নেই মাঠে । তবুও হাওয়ায় মৌসুমী গন্ধ । ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি নিয়ে তমলুক এল। বাঁদিকে বেঁকে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে কেলোমাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে লেভেলক্রসিং টপকে যাচ্ছি তখন । দীঘার ট্রেন এই রেলপথে যায় বুঝি । স্টেশনের নাম শহীদ মাতঙ্গিনী । এবার তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে । 
 

দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি) তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম । 
 
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী । মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে । মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে । 

 
মন্দিরে পুজো চড়িয়ে প্রসাদ খেয়ে এবার মহাপ্রভু নিরামিষ ভোজনালয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহারপর্ব । সেখান থেকে যাওয়া হল তমলুক রাজবাড়ি দেখতে । বিশাল চত্বরে রাজবাড়ির অবশেষ । তাক লাগানো বারমহল, অন্দরমহল, বিশাল দালান, সংলগ্ন মন্দির ঘুরে দেখলে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয় । মহাভারত্, ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ময়ূরধ্বজ রাজবংশের এই বাসস্থানের কিছুই পড়ে নেই । আছে শুধু বট-অশত্থ্ব-পিপলের শিকড়ে জীর্ণ রাজবাড়ির দেওয়াল । থাম, অলিন্দ ইত্যাদির পাশাপাশি আবডালের চিক-মহল লক্ষ্য করলাম যেখান থেকে হয়ত রক্ষণশীল মহিলারা উঁকি দিতেন বারমহলে । নূপুরের ছন্দে আর এস্রাজের অণুরণনে হয়ত বা ভেসে যেত রাজবাড়ির আনাচকানাচ । মাথার ওপর দিয়ে চামচিকে উড়ে গেল । কিন্তু তবুও লাল ইটের স্থাপত্য কীর্তি আজো জ্বলজ্বল করে ঝলমলে রোদে । মনে হল "কালের ধ্বনি শুনিতে কি পাও?" পাশেই বিশাল পুকুরের জলে হাত পা মুখ ধুয়ে ঠান্ডা হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায় জিরেন নিয়ে আবার ঘরে ফেরার পালা । কোলকাতা থেকে দীঘা, শঙ্করপুরের রাস্তায় ফেরার পথে ঘুরে আসা যেতেই পারে এই দুটি স্থান । 
 সকালবেলা ৪ এপ্রিল ২০১৩ 
 

No comments:

Post a Comment